
দেশের
মানুষের খাদ্যের জোগান দিলেও বরাবরই উপেক্ষিত কৃষি খাত। কৃষিপ্রধান দেশে
শ্রমিকরা সঠিক শ্রমমূল্য না পাওয়ার কারণে অন্য লাভজনক পেশাকে বেছে নিচ্ছে।
ফলে ভরা মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। মূল্য ও মর্যাদা উপেক্ষিত
থাকলেও থেমে নেই কৃষিখাতে শ্রমিকের কর্মঘন্টা। প্রাণ-আরএফল গ্রুপের
সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বাড়ছে কৃষিপণ্য উৎপাদন। ফলে দেশের
অর্থনীতিতে কৃষি খাতের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, দেশের
শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশ কৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪
বছর পরও এ খাতের শ্রমিকদের জন্য গঠিত হয়নি ন্যূনতম মজুরি কাঠামো। প্রতিবেশী
দেশ ভারত ও চীনের বিভিন্ন রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো রয়েছে। এছাড়া
ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো
দেশগুলোতে কৃষি শ্রমিকদের জন্য রয়েছে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো। কৃষির মূল
উপাদান শস্য উৎপাদন, সংগ্রহ ও পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের জন্য দেশে
ন্যূনতম মজুরি কাঠামো না থাকায় এ পেশায় নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে
চরম। এলাকাভেদে ও ফসলের মৌসুমভেদে শ্রমিকদের চাহিদা থাকার সময় মজুরি বেড়ে
যায়। বাংলাদেশে খাতভিত্তিক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে থাকে শ্রম
ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ নিম্নতম মজুরি বোর্ড। সংস্থাটির
তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশের ৪৭টি শিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য
ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে শিল্প ব্যতীত ‘শ্রমিক’-এর জন্য
নির্ধারিত মজুরি কাঠামোর ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বলা আছে। কৃষি ও গৃহকর্মে
নিয়োজিত শ্রমিকরা এ কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে প্রচলিত কৃষি শ্রমিকদের
জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা না থাকলেও কৃষির অন্তর্ভুক্ত চিংড়ি, মৎস্য
শিকার ট্রলার শিল্প, রাবার শিল্প, কোল্ড স্টোরেজ শিল্পের জন্য ন্যূনতম
মজুরি কাঠামো রয়েছে। ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা গেলে লিঙ্গভিত্তিক মজুরি
বৈষম্য কমবে। পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে এবং কমবে
নগরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের চাপ।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান
ব্যুরো কৃষি খাতের শ্রমিকের মজুরির তথ্য প্রকাশ করে। সংস্থাটির
তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে খাদ্য ব্যতীত পুরুষ কৃষি
শ্রমিকের দৈনিক গড় মজুরি ছিল ৫৮৩ টাকা। বিপরীতে নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে তা
৪২৫ টাকা। একবেলা খাবারের সঙ্গে পুরুষের গড় মজুরি ৫৪২ ও নারীর ক্ষেত্রে
৩৯৬ টাকা। দুইবেলা খাবারের ক্ষেত্রে পুরুষ কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৫০৬
এবং নারীর মজুরি ছিল ৩৬৭ টাকা। তিনবেলা খাবারসহ পুরুষের মজুরি ৪৮৭, বিপরীতে
নারীর মজুরি ছিল দৈনিক ৩৫৮ টাকা।
জাহিদ হাসান নামে প্রাণ-আরএফএল
গ্রুপের এক মাঠ কর্মী বলেন, প্রাণ-আরএফল গ্রুপের এগ্রো ইকুয়েপমেন্ট বিভাগের
মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন-ট্রাক্টর, পাওয়ার
টিলার, সিড ড্রিল, হারো, মই এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে। কৃষকদের
উন্নত মানের বীজ ও সার সরবরাহ করে ভালো ফলন নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি, যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং মানসম্মত ফসল
উৎপাদনে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করে। উৎপাদিত ফসলকে উচ্চ প্রযুক্তির
কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে খাদ্য ও পানীয় পণ্য তৈরি করে, যা কৃষকদের
ন্যায্য মূল্য পেতে সাহায্য করে।
বাতিসা ইউনিয়নের পাটানন্দী গ্রামের
তরুণ কৃষক মোঃ ইউনুছ বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে কৃষককের
ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এক সময় শুধুই নিজের
প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ দেখা যেত কৃষকদের।
প্রযুক্তির ব্যবহারে সে জায়গা থেকে সাধারণ মানুষ এখন অনেক অগ্রসর হয়েছে।
কিন্তু বাজারে কৃষি পণ্যের মূল্য একেবারেই অস্থিতিশীল। কৃষকের অনেক পণ্য
বিশেষ করে উৎপাদিত সবজি সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়াও কিছু পণ্য
সংরক্ষণ করতে না পারার কারণে কৃষক পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে,
এক্ষেত্রেও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উৎপাদনের সময় বাজারে জোগানের
পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সঠিক দাম পাওয়া
সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় শ্রমিকরা অন্য
লাভজনক পেশায় যোগ দিচ্ছে।
বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা নির্যাতিত কৃষক কল্যাণ
সমিতির সভাপতি মোঃ আবদুল জলিল বলেছেন, ‘কৃষি শ্রমিক, গ্রামের দিনমজুরদের
নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো মাথা ব্যথা নেই। অথচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারাই
আমাদের খাদ্যের জোগান দেন। ন্যূনতম মজুরি কাঠামো না থাকার কারণে এখনো
নারী-পুরুষের মজুরিতে ব্যাপক বৈষম্য রয়ে গেছে। এ পেশায় দুর্ঘটনা ও জীবনের
ঝুঁকি বেশি। সাপের কামড়, বজ্রপাত, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, ক্যান্সারসহ নানাভাবে
কৃষি শ্রমিকরা মারা যান। এতে তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেলেও অর্থনৈতিক কোনো
সহায়তা পান না। এসব নানা সমস্যার সুরাহা করলে কৃষিখাতের মাধ্যমে চাঙ্গা
হবে দেশের অর্থনীতি'।
