
দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিছক কোনও ব্যক্তিগত বা দলীয় ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর অর্থবহ সন্ধিক্ষণ। প্রায় ১৭ বছর পর স্বদেশে তার উপস্থিতি এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন দেশ একদিকে দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্ষত বহন করছে। অন্যদিকে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে তাকে ঘিরে যে বিপুল জনসমাগম, জনউচ্ছ্বাস ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে- তা কোনও ‘ব্যক্তিপূজার’ বহিঃপ্রকাশ নয় বরং এটি একটি রাষ্ট্রের ভেতরে জমে থাকা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। সেই বাস্তবতায় তারেক রহমান সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। এই সম্ভাবনা তাকে কেবল ক্ষমতার দোরগোড়ায় নয়, ইতিহাসের বিচারের কাঠগড়াতেও দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কারণ মানুষ এখন আর শুধু সরকার পরিবর্তন চায় না বরং রাজনীতির চরিত্র বদলাতে চায়।
এই প্রত্যাশার কেন্দ্রে রয়েছে তারেক রহমানের ঘোষিত ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি। বিশেষ করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে যে গুরুতর প্রশ্ন ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, তা এখনও জনমনে গভীরভাবে অনুরণিত।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিকতা ও জাতীয় স্বার্থের ভারসাম্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সীমান্ত হত্যা, নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য ঘাটতি কিংবা নিরাপত্তা সহযোগিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বাংলাদেশকে বহু ক্ষেত্রেই একতরফা সমঝোতার পথে হাঁটতে হয়েছে। সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে কিছু চুক্তি ও বোঝাপড়া জাতীয় সংসদ কিংবা জনপরিসরে পর্যাপ্ত আলোচনার সুযোগ না দিয়েই সম্পন্ন হয়েছে-যা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই প্রেক্ষাপটে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ কেবল একটি স্লোগান নয়- এটি একটি মর্যাদাশীল, ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতির দাবি।
তবে এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য কেবল ক্ষমতায় যাওয়া যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন রাজনীতির ভেতরেই সংস্কার। বিএনপির জন্য এখানেই শুরু হয় সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। দলটির ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অন্তর্দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং রাজনীতি এবং পূর্ব সরকার আমলের অনুকরণে গড়ে ওঠা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতির অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদি বিএনপি সত্যিই একটি নতুন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে চায়, তবে এই সংস্কৃতির সঙ্গে আপসের কোনও জায়গা থাকতে পারে না। দুর্নীতিবাজ, দখলদার ও জনবিচ্ছিন্ন নেতাকর্মীদের হয় সংশোধনের পথে আনতে হবে, নতুবা রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
এখানে কোনও ‘কিন্তু’ চলবে না। কারণ পুরনো রোগ নিয়ে নতুন রাষ্ট্র গড়া যায় না।
এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তরুণ ও জেন জেড প্রজন্ম। ২০২৪ সালের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে- এই প্রজন্ম শুধু প্রতিবাদী নয়; তারা সচেতন, নীতিনিষ্ঠ এবং বিকল্প রাজনীতির দাবিদার।
বিএনপি যদি পুরনো ধাঁচের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে এসে তরুণদের নেতৃত্বে সুযোগ দেয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্ত করে এবং নৈতিক রাজনীতির চর্চা নিশ্চিত করে, তাহলেই দলটি সত্যিকার অর্থে গতানুগতিক রাজনীতির বৃত্ত ভাঙতে পারবে।
এই প্রেক্ষাপটে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে জনপ্রিয় হয়েছিলেন কেবল মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের কারণে নয়; বরং শৃঙ্খলা, উৎপাদনমুখী অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন এবং ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির কারণে। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আজ দেশের মানুষ তারেক রহমানের মধ্যে সেই ধারাবাহিকতাই খুঁজছে- শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, কাজ ও নীতির মাধ্যমে।
এই প্রত্যাশার বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে। তারেক রহমানের ঘোষিত ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার রূপরেখা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ব্যতিক্রমী দলিল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালীকরণ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতিবিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, সংখ্যালঘু ও নারীর নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার-এই দফাগুলো একটি আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক শর্তের কথাই বলে। এতে স্পষ্ট হয়, তিনি ক্ষমতা দখলের চেয়ে ক্ষমতার ব্যবহার নিয়েই বেশি ভাবছেন।
তবে বাস্তবায়নই হবে চূড়ান্ত পরীক্ষা। দীর্ঘ নির্বাসনের পর দেশে ফিরে তাকে প্রমাণ করতে হবে-তিনি শুধু দলীয় নেতা নন বরং একটি ভাঙাচোরা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল অভিভাবক হতে সক্ষম।
প্রশাসন পুনর্গঠন, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, অর্থনীতিতে আস্থা ফেরানো এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বদলে ন্যায়ভিত্তিক বিচার নিশ্চিত করতে হলে তাকে দলীয় গণ্ডির বাইরে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গড়তে হবে।
নতুন বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তারেক রহমানের সামনে আজ এক বিরল সুযোগ। তিনি চাইলে ক্ষমতার রাজনীতিকে দায়িত্বের রাজনীতিতে রূপ দিতে পারেন। কিন্তু তা সম্ভব হবে কেবল তখনই, যখন নতুন বাংলাদেশ মানে শুধু নতুন সরকার নয়, নতুন রাজনৈতিক নৈতিকতা- এই সত্যটি তিনি কাজে প্রমাণ করবেন।
ইতিহাস এখন তার দিকেই তাকিয়ে। এই মুহূর্তে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোই নির্ধারণ করবে-তারেক রহমান কেবল প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবেন, নাকি সত্যিই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্জন্মের বিশ্বাসযোগ্য প্রতীক হয়ে উঠবেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
