
পৌষের মিষ্টি সকাল। কুয়াশার চাদর সরিয়ে পূর্ব দিগন্তে সবে মাত্র উঁকি দিয়েছে ঝলমলে সূর্য। প্রকৃতির এমন আড়ষ্টতা জড়ানো দিনেই যেন জেগে উঠল পুরো বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষের অপেক্ষার অবসান হলো।
তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র-সবখানে সাজ সাজ রব। দীর্ঘ দেড় যুগের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে নিজ ভূমিতে পা রাখলেন এই বাংলার ভূমিপুত্র, যাঁর বীরোচিত প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় একটি জাতি দীর্ঘদিন ধরে ছিল অপেক্ষমাণ। আজ তাঁকে বরণ করে নিতে লোকে-লোকারণ্য রাজপথ। পুষ্পমাল্যের চেয়েও দামি চোখের পানি।
জনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর আনন্দাশ্রুতে মায়ের কোলে ফিরে এলেন একজন সন্তান, একজন বাবা এবং একজন প্রিয় অভিভাবক। তিনি আর কেউ নন-এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের অতন্দ্র প্রহরী, একজন সেবক, একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক জননেতা তারেক রহমান।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান তারেক রহমান দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন একটি অস্থির সময়ে। ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁকে কেবল রাজনীতি থেকেই নয়, চিরতরে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল।
দুর্নীতির মিথ্যা গালগল্প ছড়িয়ে তাঁকে দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আলাদা করার মিশন ছিল তাদের। এসব চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মধ্যেই ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। ১৭ বছর তিন মাস ১৪ দিনের প্রবাসজীবনে তিনি দল, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দূরে থেকেও যেন খুব কাছের এক অতি প্রিয়জন। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত তারেক রহমান ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নানা সংকটেও দেশের প্রতি তাঁর গভীর দায়িত্ববোধ কখনো ভুলে যাননি, বরং এই বিচ্ছেদ ও ষড়যন্ত্র তাঁর দেশপ্রেমকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
দেশপ্রেম হোক দেশ গড়ার শক্তিলন্ডনে প্রবাসজীবনের দীর্ঘ সময়ে তিনি নিজ দল বিএনপিকে সুসংগঠিত করেছেন। খুনি হাসিনার শাসনামলে বিএনপিকে ধ্বংস করার সব চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তারেক রহমানের নেতৃত্বের নৈপুণ্যের কাছে পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রভুদের চক্রান্ত। তিনি দিনরাত এক করে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। তাঁর নির্দেশনা ও পরামর্শে বিএনপি আজ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরো গোছানো ও শক্তিশালী।
বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান যখন পথহারা হয়ে পড়েছিল, তখন তারেক রহমানের নির্দেশনাই ছিল নিয়ামক শক্তি। একটি ভণ্ডুল হতে যাওয়া আন্দোলন কিভাবে সফল করতে হয়, তা তিনি তাঁর ক্যারিজমেটিক নেতৃত্বের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এই নেতৃত্ব আজ সর্বজনস্বীকৃত।
গণ-অভ্যুত্থানের পর তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের জন্য সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়েছে। মানুষ মনে করে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের নতুন প্রেক্ষাপটে দেশ পুনর্গঠন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় একজন বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্ব অপরিহার্য, যার হাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকবে নিরাপদ, যার দৃষ্টিতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পাবে সমান মর্যাদা। এমন জাতীয় নেতার আলোচনায় সবার আগে আসে তারেক রহমানের নাম।
গত ২৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন তাঁর মা, সাবেক তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। মায়ের এই অসুস্থতায় তিনি ছিলেন ব্যথিত ও ব্যাকুল। ধারণা করা হচ্ছিল, তিনি দ্রুত দেশে ফিরবেন, কিন্তু নানা জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। এই সময়ে মাকেও উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়া যায়নি। এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই তিনি তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘দেশে ফেরার বিষয়টি আমার একক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না।’ অন্তর্র্বতী সরকারও প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, ‘তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’ অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিনি দেশে ফিরছেন। জননী ও জন্মভূমি থেকে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর এই প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়, এক অর্থে দ্বিতীয় জীবন।
তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান। পারিবারিক পরিচয়ে ক্ষমতার বলয়ে বড় হলেও ক্ষমতা তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি, বরং মা-বাবার আদর্শে তিনি হয়ে উঠেছেন দেশ ও মানবতাবাদী নেতা। সে কারণেই তিনি কোটি মানুষের কাঙ্ক্ষিত আগামীর রাষ্ট্রনায়ক।
১৯৮৯ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এর পর থেকে শুরু হয় তাঁর রাজনীতিক হয়ে ওঠার লড়াই। ক্ষমতার সুবিধা নয়, তৃণমূলের মানুষের কাছে গিয়ে রাজনীতি শিখেছেন তিনি। প্রান্তিক মানুষের সমস্যা-সংকট আর সম্ভাবনার চুলচেরা বিশ্লেষণ কিংবা উত্তরণের উপায় খুঁজতে খুঁজতে রাজনীতিকে নিজের কাছে সহজপাঠ্য করেছেন তিনি।
তারেক রহমান দলীয় তেমন কোনো পদ-পদবিতে না থাকলেও বহু আগে থেকেই তিনি ছাত্রদলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেন। তিনি নিজে রাজনীতি বুঝেছেন। যা ভেবেছেন কিংবা যেভাবে রাজনীতিকে দেখতে চেয়েছেন, তা নিয়ে কথা বলেছেন নেতাদের সঙ্গে। এভাবে খোলামেলা আলোচনায় উপকৃত হয়েছে দল। এগিয়েছে দেশ। রাজনীতিতে পরিপক্ব হয়েছেন তিনি।
তিনি ধারণ করেছেন কৃষকের স্বপ্ন, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম ও তারুণ্যের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। তাই তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও বক্তব্য এতটা বাস্তবসম্মত, যেন মানুষের হৃদয়ের ভাষাই তিনি উচ্চারণ করেন।
তবে রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ ১৭ বছরের প্রবাসজীবনে তারেক রহমান রাজনীতির যে গভীর অনুশীলন করেছেন, তার সুস্পষ্ট ছাপ পড়েছে রাষ্ট্র সংস্কারে গৃহীত বিএনপির ৩১ দফা প্রস্তাবে। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্য ও বিবৃতিতে উঠে এসেছে নয়া বন্দোবস্তের বার্তা। পুরনো রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে পরিহার করে তিনি এরই মধ্যে নতুন দিনের রাজনীতি শুরু করেছেন। রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়া শিষ্টাচার ও পরমতসহিষ্ণুতাকে ফিরিয়ে এনে তিনি একসঙ্গে এই দেশ গড়তে চেয়েছেন। তিনিই স্লোগান তুলেছেন, ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’। তিনিই বলেছেন ব্যক্তির চেয়ে দল, আর দলের চেয়েও দেশের শ্রেষ্ঠত্বের কথা। তাঁর ছোট ছোট চিন্তা এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য-বিবৃতিতে ফুটে উঠেছে একজন উদারনৈতিক নেতার প্রতিচ্ছবি, যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন সাধারণ মানুষের বুকে প্রোথিত করেন। কেননা বুক থেকেই উৎসারিত হয় দেশপ্রেম, আর দেশপ্রেম ছাড়া রাজনীতির কোনো মূল্য নেই।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে খুনি হাসিনার ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী আমল। তারুণ্যের প্রবল ঝড়ে উড়ে গেছে অহংকার ও দম্ভের রাজপ্রাসাদ। এ দেশের প্রতিটি মানুষের ভেতরে এখন রাজনীতির নতুন বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে প্রবল দেশপ্রেমের ঝড় বইছে, তারেক রহমান সেই দীক্ষা পেয়েছেন বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও মা খালেদা জিয়ার কাছ থেকে। লন্ডনের প্রবাসজীবনে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই স্বদেশপ্রেম আরো বহুগুণ বেড়েছে, কমেনি। স্বদেশের মাটিতে ফিরে এসে এই দেশপ্রেমই হোক তাঁর দেশ গড়ার মূল চালিকাশক্তি। তিনি হয়ে উঠুন দল-মত-নির্বিশেষে সব বাংলাদেশির একান্ত আস্থাভাজন ও প্রিয় নেতৃত্ব।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আপনার প্রতি রইল লাল গোলাপ শুভেচ্ছা ও বিপ্লবী অভিবাদন।
লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
