
আজ
শুভ বড়দিন! ঈশ্বর ধার্মিক ও প্রেমময় বলেই বড়দিন। পবিত্র বাইবেলে ঈশ্বরের
প্রেমের বিষয়টির চেয়ে অনেক বেশিবার উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরের ধার্মিকতার
কথা। ‘ঈশ্বরের ধার্মিকতা’র দ্বারা মূলত বোঝানো হয় ঈশ্বরের ন্যায়পরায়ণতাকে।
এর সঙ্গে আছে তাঁর সিদ্ধতা, বিশ্বস্ততা, পবিত্রতা ইত্যাদি নৈতিক গুণ।
ঈশ্বর
অনন্ত অসীম প্রেমময়। তবে ঈশ্বরের শর্তহীন প্রেম বলে কোনো কথা বাইবেলে নেই।
ঈশ্বর ন্যায়বান বলেই পাপের দণ্ড আছে। পাপ ও অপবিত্রতার সঙ্গে ‘স্বগৌরব
রক্ষণে উদ্যোগী’ ঈশ্বরের কোনো আপস নেই। তাঁর প্রেম ও অনুগ্রহ পেতে হলে
মানুষকে অনুতাপসহ মন পরিবর্তন করে তাঁর দিকে ফিরে আসতে হবে।
পাপ তথা
শয়তানের হাত থেকে মানুষ ও পুরো সৃষ্টিকে পরিত্রাণ করার জন্য যিশুখ্রিস্ট
মানবরূপে জগতে এসেছেন। তাঁর মধ্যে যে প্রেম প্রকাশিত, ঈশ্বরের সে প্রেমের
পশ্চাতে আছে তাঁর ধার্মিকতা। ঈশ্বরের এই বৈশিষ্ট্য হেতু তিনি অবশ্যই পাপের
দণ্ড দেবেন।
খ্রিস্টের ক্রুশীয় মৃত্যু সে কারণেই হয়েছিল। খ্রিস্টের
জন্মে প্রকাশিত স্বর্গীয় প্রেমের মর্মমূলে আছে পাপের প্রতি পবিত্র ঈশ্বরের
ঘৃণা এবং ‘স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী’ ঈশ্বরের ন্যায়বিচার। তাই বড়দিনে পাপী
মানুষের জন্য স্বর্গীয় প্রেমের প্রকাশ দেখি। খ্রিস্টের ক্রুশীয় মৃত্যুতে
প্রকাশিত তাঁর ধার্মিকতা ও ন্যায়বিচারের আলোতে আমরা তাঁকে দেখি। পাপীর
স্থলে তার সমুচিত দণ্ড খ্রিস্ট ভোগ করেছেন; তাতে সরল বিশ্বাসে পাপী লাভ করে
পরিত্রাণ।
তাঁর দ্বারা পাপী মানুষ পাপের দণ্ডমুক্ত হয়, আর ন্যায়বিচারও
প্রতিষ্ঠিত থাকে। এভাবেই খ্রিস্টের আত্মদানের মাধ্যমে দিয়াবল ও মন্দতার বশে
চলে যাওয়া মানুষ স্রষ্টা ও মঙ্গলময় ঈশ্বরের সঙ্গে সম্মিলিত হতে পারে।
খ্রিস্ট
যখন বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মতুল্য প্রেম করো।’ এর অর্থ, আমরা
যেন সব মানুষকেই যথাসাধ্য ভালোবাসতে ও সম্মান করতে চেষ্টা করি। মানবহিতৈষী
এই চিন্তা আমাদের নিজেদের পরিবারে ও সমাজের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
দুস্থ, নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলা, কাজ করা সব ধর্মেরই
শিক্ষা। যিশুখ্রিস্ট আমাদের বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতায় সে শিক্ষা ব্যবহার করতে
তাঁর আত্মদানের মধ্য দিয়ে তাঁর আদর্শ স্থাপন করেছেন। তাঁর শিক্ষা ছিল
সেদিনের সমাজে প্রচলিত শিক্ষার চেয়ে স্বতন্ত্র। তাঁর সময়ে প্রচলিত একটি কথা
ছিল, ‘তুমি যে ব্যবহার অন্যের কাছ থেকে চাও না, সেরূপ ব্যবহার অন্যকে দিয়ো
না।’ এই না-বোধক কথার স্থলে যিশু বললেন, ‘তুমি অন্যের কাছ থেকে যে ব্যবহার
পেতে চাও, প্রথমে তুমি অন্যকে সে ব্যবহার দাও।’
এ বছর পবিত্র বড়দিনের
উপাসনায় বাংলাদেশের ১৩ লাখ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টের নামে ঈশ্বরের
কাছে প্রার্থনার অর্ঘ্য নিবেদন করবেন। সে প্রার্থনার একটি প্রধান অংশ হবে,
যেন ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নির্বিঘ্ন,
সুষ্ঠু ও অবাধ হয়। দেশের সর্বত্র যেন শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে। প্রধান
নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন এবং সারা দেশে নির্বাচনসংক্রান্ত
কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সবাই যেন তাঁদের পবিত্র
দায়িত্বগুলো যেকোনো ধরনের পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে পালন করতে পারেন।
আমাদের প্রার্থনা হোক, যেন সংশ্লিষ্ট সব নেতা, সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী
নির্বাচনসংক্রান্ত বিধিমালাকে মান্য করেন।
গতানুগতিক অর্থে ‘ধর্ম’ বলতে
যা বোঝায় যিশু তেমন কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে আসেননি। তিনি তাঁর জীবনে যে
যিহুদি ধর্ম ছিল, তার মূল শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে পালন করেছেন। তাঁর শিক্ষায়
বলা আছে, ‘তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত মন দিয়া
তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে এবং তোমার প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম
করিবে।’
প্রকৃত অর্থে, সে আজ্ঞা কেউ সম্পূর্ণ পালন করেনি। যিশু তা পালন
করে দেখিয়েছেন। তাঁর শিক্ষা এই : ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য
নয়।
বড়দিনে আমাদের আরো বিশেষ প্রার্থনা এই, যেন অশান্ত এই পৃথিবীতে
শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষে-মানুষে যদি শান্তি ও ন্যায্যতা না থাকে,
তাহলে বৈষয়িক বা বস্তুগত উন্নতি যতই হোক না কেন, তাতে মানবজাতির স্থায়ী
কোনো কল্যাণ হয় না।
দুর্বলের ওপরে সবলের অত্যাচার, মানুষে-মানুষে,
জাতিতে-জাতিতে ভেদাভেদ ও বৈষম্য এবং শোষণ ও বঞ্চনার আঘাতে মানবাত্মার
পরিত্রাণের জন্য শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষেরই ভূমিকা আছে। আমাদের
প্রার্থনা এই যে আমরা সবাই যেন এ বিষয়ে আন্তরিক হই।
ঈশ্বরের কাছে আমাদের
প্রাণের প্রার্থনা, যেন প্রকৃত দেশপ্রেমী, সৎ, ন্যায়বান ব্যক্তিরা আমাদের
সংসদ সদস্যরূপে সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হন। ্আমাদের সবার জানা ভালো
যে অনেক বৈষয়িক উন্নতি ও ধন-দৌলতের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের সাধারণ মানুষের
প্রাণের প্রথম চাহিদা ন্যায্যতার ভিত্তিতে রচিত মানবিক এক সমাজ, যেখানে
থাকবে জীবনের, মান-সম্মানের নিরাপত্তা।
এ দেশ যেন একটি অসাম্প্রদায়িক
দেশরূপে তার অস্তিত্বকে বজায় রাখতে পারে। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি হোক
এমন এক স্থান, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে সব
নাগরিক সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে সবার সঙ্গে সম্প্রীতি, একে অন্যের
প্রতি সম্মানবোধ ও ন্যায্যতার মূল্যবোধে বসবাস করতে পারবে। বড়দিনকে ঘিরে
থাকা মানবসৃষ্ট প্রথা বা সব বাহ্যিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার ঊর্ধ্বে উঠে
খ্রিস্টের ন্যায্যতা, প্রেম ও মানবসেবার আদর্শে চলার জন্য আজ আমাদের জীবনে
তৈরি হোক বড় এক মাইলফলক!
লেখক : খ্রিস্টীয় পুরোহিত ও ঈশতত্ত্বের শিক্ষক
