শনিবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
১৩ পৌষ ১৪৩২
মবক্রেসি নির্মূলে আইনি ব্যবস্থা নিন
প্রকাশ: শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৩৩ এএম |

 মবক্রেসি নির্মূলে আইনি ব্যবস্থা নিন

স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও যা ঘটেনি, এবার তা-ই ঘটল। দুটি সংবাদপত্র, দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও একজন প্রবীণ সাংবাদিকের ওপর হামলা, আগুন লাগানো ও ভাঙচুর করা হলো। দি ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, ছায়ানট, উদীচী এবং সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর এই হামলা সাধারণ কোনো হামলা নয়; সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নীতি, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকাণ্ডকে থামিয়ে দেওয়া, নাগরিকদের ভয় পাইয়ে দেওয়া– সবমিলিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর সরাসরি আক্রমণ। লক্ষণীয় যে, এই দুটি সংবাদপত্র এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল। ফলে তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, সামাজিক ন্যায়বিচার, সরকারের জবাবদিহি এবং শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন রাষ্ট্রগঠনকে সবার ওপরে স্থান দেয়। এই আক্রমণ তাই ইঙ্গিত করে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা যাবে না, অসাম্প্রদায়িক ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা যাবে না। অথচ ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, নিরপেক্ষভাবে এর স্বরূপ বিশ্লেষণ করে দেখায় বলেই সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। হামলাকারীরা ভয় দেখানোর মধ্য দিয়ে আরেকটি বার্তা দিতে চেয়েছে, সংবাদপত্র শুধু সরকার নয়, কোনো দলের নীতির বিরুদ্ধে যায়, সে রকম খবর বা বিশ্লেষণ যেন হাজির না করে। সেলফ-সেন্সরশিপ বা নিজেরাই ভীত হয়ে নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে সংবাদ প্রকাশ করা হবে, এমন বার্তাও তারা সূক্ষ্ণভাবে পুরো গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে।
এটা জোর যার মুল্লুক তার- মতো এক ধরনের ফ্যাসিবাদী আচরণ। নিঃসন্দেহে এই আক্রমণের প্রতীকী তাৎপর্য আছে। এটি স্বাধীন সাংবাদিকতাকে নিষিদ্ধ এবং ভিন্নমতকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে চিহ্নিত করে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলে। নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ বা সাংবাদিকদের মেরে ফেলার হুমকির বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়, গণমাধ্যমকর্মীরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবেও লক্ষ্যবস্তু হয়ে গেছেন। 
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে আইনের শাসন এই মুহূর্তে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গত ১৪ মাসে মব সন্ত্রাসকে মব-তন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। কোনো অপরাধ যখন এভাবে মতাদর্শ বা বয়ানে পরিণত হয়, তখন তার মারাত্মক অভিঘাত প্রথমে ব্যক্তি এবং পরে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে সুশাসন, মতপ্রকাশ ও গণতন্ত্রের ওপর। নিঃসন্দেহে এই মব-তন্ত্র চব্বিশের অভুত্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে তুলছে।
দেশের শীর্ষ দুটি সংবাদপত্র এবং শীর্ষ দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের স্থান সংকুচিত হওয়ার বিষয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছে মানবাধিকার এবং সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সক্রিয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। এই আক্রমণ যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান লঙ্ঘন করছে সে কথা তারা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে। দেশের বাইরে এই যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষকে অদূর ভবিষ্যতে তার ফল ভোগ করতে হবে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর বহুদেশ বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা ও ভ্রমণ সীমিত করে দিয়েছে। শিক্ষার্থী গ্রহণেও অনীহা দেখাচ্ছে অনেক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়। শ্রমবাজার, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য। মতপ্রকাশ, রাজনৈতিক অধিকার, শান্তিচুক্তিসহ গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের স্বার্থেই প্রয়োজন। সবারই সমালোচনামূলক সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে।
গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধ এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দি ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, হামলার কথা আঁচ করতে পেরে তারা সরকারের উঁচু মহলে যোগাযোগ করে সুরক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেনি। দুর্বৃত্তরা নির্বিঘ্নে ভাঙচুর এবং আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন, এই ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে সরকারের ভেতরের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ঘটনা প্রতিহত করার ব্যর্থতার পুরো দায়দায়িত্ব সরকারের। এ থেকে বোঝা যায়, কেন এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় থেকেছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। শুধু গণমাধ্যম নয়, সাধারণ মানুষকেও আতঙ্কিত করে তুলেছে। কিছুটা দেরি হলেও তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গতকাল পর্যন্ত ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। 
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গত সোমবার সম্পাদক পরিষদ ও মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (নোয়াব) যৌথভাবে প্রতিবাদ সভা এবং মানববন্ধন করেছে। আগের দিন রবিবার সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ডেমোক্রেসি হয়ে গেছে মবক্রেসি। সারা দেশেই আসলে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা সবাই বলছেন, এটা স্বাধীন মতপ্রকাশ, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের প্রতি আঘাত। প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ আগামী মাসে ঢাকায় সাংবাদিক মহাসম্মেলন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি ছায়ানট ও উদীচীও গানে-মিছিলে প্রতিবাদ এবং বিচারের দাবি জানাচ্ছে।
সরকারের তৎপরতা এখন পর্যন্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে বড় পরিসরে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সামাজিক মাধ্যমে অনেক ভিডিও মিলবে; যেখানে এই ঘটনায় চিহ্নিত রাজনৈতিক মহল থেকে উসকানি দেওয়া হয়েছে। হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অংশ নেওয়া দুর্বৃত্তদের চেহারাও ভিডিওতে স্পষ্ট। ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। দ্রুত তদন্ত করে আসামিদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। মবক্রেসি যে পর্যায়ে গেছে তাতে সরকারের প্রতিশ্রুত নির্বাচনও এখন হুমকির মুখে। অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করে সরকারকে মবক্রেসি নির্মূল আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকের মধ্য দিয়ে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি– কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন।

















http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা বিএনপি ‘বাঁচাতে’হাজী ইয়াছিনের অনুরোধ
জিয়াউর রহমানের সমাধিতে তারেক রহমানের শ্রদ্ধা
বাবার সমাধির সামনে জলভরা চোখে তারেক রহমান
হাদি হত্যার বিচারের দাবিতে কুমিল্লায় ইনকিলাব মঞ্চের দোয়া ও বিক্ষোভ
দেশের প্রথম বাইক ট্র্যাক ট্রেইল রেস হলো কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় দুর্ঘটনার পর বাসে আগুন দিলো স্থানীয়রা
কুমিল্লায় কুয়াশার চাদরে ঢাকা সূর্য: জেঁকে বসেছে হাড়কাঁপানো শীত
অসহায়, নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করছে মনোহরগঞ্জ উন্নয়ন ফোরাম -জসিম উদ্দিন সিআইপি
মাতৃভূমিতে তারেক রহমান
কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে হাতী প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২