
দেশ আজ এক ভয়ংকর মবতন্ত্রের শিকার। তার থেকে রক্ষা পাচ্ছে না গণমাধ্যমও। পরিস্থিতি এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে সাংবাদিকদের মত প্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে উঠেছে। দেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, উদ্যোক্তা, সম্পাদক, পেশাজীবী, কবি, শিক্ষক, ব্যাংকারসহ সর্বস্তরের মানুষ এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
ফলে ২৪-এর অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে আজ আকাশ-পাতাল পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নুরুল কবিরকে হেনস্তার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক যৌথ প্রতিবাদসভায় সবাইকে রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানান নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সংবাদপত্র সম্পাদকদের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’ ও মালিকদের সংগঠন ‘নিউজ পেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)’ যৌথভাবে এই প্রতিবাদসভার আয়োজন করে। সভায় বক্তারা গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও নৃশংসতার ঘটনায় সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাকে ‘ভয়ংকর ও রহস্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তাঁরা বলছেন, এই ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকার তার নৈতিক বৈধতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই বলেও তাঁদের মত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আজ যে বাংলাদেশ দেখছি, এই বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি কোনো দিন দেখিনি। আজ ডেইলি স্টার, প্রথম আলো নয়, আজ গণতন্ত্রের ওপর আঘাত এসেছে।
স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও কথা বলার অধিকারের ওপর আবার আঘাত এসেছে। জুলাই যুদ্ধের ওপর আঘাত এসেছে।’ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানান তিনি। গণমাধ্যমে হামলা ছাড়াও ছায়ানট ও উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পোড়ানো, ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার মতো ঘটনাগুলো তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কী বানাচ্ছি বাংলাদেশে? কেন বানাচ্ছি?’ তিনি এসব প্রতিরোধের আহবান জানান।
দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নুরুল কবির বলেন, ‘সংবাদকর্মীরা কাজ করার সময় পত্রিকা অফিসের মধ্যে আগুন লাগানো এবং ফায়ার সার্ভিস আসার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে খুব পরিষ্কারভাবে একটি গোষ্ঠীর লক্ষ্য ফুটে উঠেছে।
তারা মধ্যযুগীয় কায়দায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করতে চেয়েছে।’ এভাবে কণ্ঠ স্তব্ধ করা যাবে না জানিয়ে নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘আমরা সারা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের নিয়ে আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি একটা মহাসম্মেলন করব। সেই মহাসম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি আমরা ঘোষণা করব।...যত দিন বিচার না হবে এবং সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাওয়া না যাবে, তত দিন পর্যন্ত আমাদের এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নানাভাবে আক্রান্ত। গত বছর ১৯ আগস্ট রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপেও ধ্বংসাত্মক হামলার ঘটনা ঘটেছিল। তখন অনেকেই তাকিয়ে দেখেছে। প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি। সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই আজ পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে এসেছে। এই অবস্থা সুস্থতার লক্ষণ নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর যেকোনো হামলা, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে।
