ঘূর্ণিঝড়,
জলোচ্ছ্বাস কিংবা বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে হুঁশিয়ারি সংকেত পেলেও অথবা
নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ হলেও ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে এ ধরনের কোনো
সুযোগ পায় না মানুষ। কারণ বিজ্ঞান ভূমিকম্পের মতো মহাদুর্যোগের কাছে খুবই
অসহায়। আগাম সতর্কবার্তা জানানোর উপায় এখনো খুঁজে পায়নি বিজ্ঞান। তাই বলে
হাত গুটিয়ে বসে নেই বিজ্ঞানীরাও। তারা প্রতিনিয়তই গবেষণা করে যাচ্ছেন,
কীভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস মানুষকে জানানো যায়। যুক্তরাষ্ট্রের
বিজ্ঞানীরা সে ক্ষেত্রে সামান্য সফলতাও অর্জন করেছেন। তারা সেলফোনের
মাধ্যমে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কীকরণের সামান্য উপায় খুঁজে পেয়েছেন। তবে সেটি
তেমন একটা কার্যকর ব্যবস্থা নয়; মাত্র ৮০ সেকেন্ড আগে জানা যাবে। তবু সেটি
একটি আশার বিষয়। হয়তো একদিন তা ৮০ মিনিটেও দাঁড়াতে পারে। সেসব অবশ্য
ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানে এ দুর্যোগ থেকে নিস্তার পাওয়ার অন্য কোনো উপায়
নেই বলা চলে। যেকোনো সময় ভূ-অভ্যন্তরে কম্পনের সৃষ্টি হলেই প্রলয়কাণ্ড ঘটে
যেতে পারে ভূপৃষ্ঠে।
ভূমিকম্প বিভিন্ন মাত্রার হয়। ধ্বংসলীলা ও দুর্যোগ
শক্তির পরিমাপ বোঝাতে রিখটার স্কেলের মাত্রা ব্যবহার করা হয় ভূমিকম্পের
ক্ষেত্রে। যেমন ১ থেকে ১০ হচ্ছে রিখটার স্কেলের মাত্রা। রিখটার স্কেলের
মাত্রা ৫-এর ওপরে গেলেই সেটাকে ভারী ভূমিকম্প বলা হয়। এভাবে একেক মাত্রা
বৃদ্ধি পাওয়ার মানেই হচ্ছে ১০ থেকে ৩২ গুণ শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। যেমন-
ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ থেকে ৫.৯৯ হচ্ছে মাঝারি, ৬ থেকে ৬.৯৯ তীব্র, ৭ থেকে
৭.৯৯ ভয়াবহ, ৮-এর ওপরে মহাদুর্যোগ। এই হচ্ছে রিখটার স্কেলের হিসাব। রিখটার
স্কেলের হিসাব ছাড়াও ভূমিকম্প ছোট, মাঝারি ও বড় ধরনের আখ্যা দিয়ে থাকে
অনেকেই। তবে ভূমিকম্পের ধরন যেমনই হোক না কেন, সব ধরনের ভূমিকম্পই
বিপজ্জনক।
ছোট ধরনের ভূমিকম্প তেমন বিপজ্জনক না হলেও মাঝারি ধরনের
ভূমিকম্পের তাণ্ডবে ঘরবাড়ি ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বৈদ্যুতিক
শর্টসার্কিট হয় এবং গ্যাসলাইন ভেঙে তছনছ হওয়ার পাশাপাশি জনপদে আগুন লেগে
যায় বেশির ভাগ সময়। আর বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে তো কথাই নেই, ভয়ংকর বিভীষিকা
নেমে আসে যেকোনো জনপদে। সেটি যদি সমুদ্রের তলদেশে ঘটে, তাহলেও রক্ষা নেই।
জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপে উপকূল প্লাবিত হয়ে লাখো প্রাণের বিনাশ ঘটায়। যেমন- ২৬
ডিসেম্বর ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের ৩০ কিলোমিটার গভীরে যে ভূকম্পন ঘটে,
তাতে ১৪টি দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। ওই ভূমিকম্প বিশ্বে
‘সুনামি’ নামে পরিচিতি পায়; যার পরিমাপ ছিল ৯.১ থেকে ৯.৩ মাত্রার রিখটার
স্কেল। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ভূমিকম্প দীর্ঘতম সময়ের ছিল; প্রায় ৮.৩ থেকে ১০
মিনিট এর স্থায়িত্ব ছিল। অন্যদিকে, ১১ মার্চ ২০০৯ সালে জাপানে কয়েক সেকেন্ড
স্থায়িত্বের বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার পরিমাপ ৮.৯ রিখটার স্কেল।
ওই ভূমিকম্পের ফলে ওই তারিখের দিনের দৈর্ঘ্য ১.৮ মাইক্রো সেকেন্ড হ্রাস
পেয়েছিল। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে ১৯৬০
সালে চিলিতে। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ৯.৫ রেকর্ড করা হয়েছিল।
ফলে চিলিতে বিভীষিকাময় মহাদুর্যোগ নেমে আসে এবং ঘরবাড়ি ধ্বংসের পাশাপাশি
অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। তার পর থেকে চিলি সরকার যেকোনো স্থাপনার
অনুমোদনের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করে। চিলিতে বিল্ডিং কোড
বাধ্যতামূলক করায় পরবর্তী সময়ে এর সুফলও পেয়েছে দেশটি।
দেখা গেছে, ৮
মাত্রার ভূমিকম্পেও দেশটির তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মোটামুটি এই হচ্ছে
জলে-স্থলে আঘাত হানা তিনটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের পরিণাম। এ ছাড়া বড় ধরনের
আরও কয়েকটি ভূমিকম্প বিশ্বে আঘাত হেনেছিল। ফলে জনপদ বিধ্বস্ত হওয়ার
পাশাপাশি লাখ-লাখ প্রাণের সমাধি ঘটেছিল যুগে যুগে। সুতরাং বলা যায়,
ভূমিকম্প অন্যান্য দুর্যোগের চেয়েও ভয়াবহ একটি দুর্যোগ। কারণ এ দুর্যোগ
শুধু মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর প্রাণই কেড়ে নেয় না, যেকোনো জনপদকেও বিলীন
করে দেয়। অর্থাৎ, সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বড় ধরনের ক্ষেত্রই হচ্ছে
ভূমিকম্প। ভূমিকম্প নিয়ে অনেক মিথও আছে। অনেকের ধারণা, মানুষের অধিক পাপের
কারণে সৃষ্টিকর্তা অসন্তুষ্ট হয়ে শাস্তিস্বরূপ ভূমিকম্প প্রদান করেন।
আসলে
এসব হচ্ছে ভিত্তিহীন রসগল্প। ভূমিকম্প শুধু পৃথিবীতেই নয়, সৌর জগতের
অন্যান্য গ্রহেও আঘাত হানে। ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটের ওঠানামার কারণই
হচ্ছে ভূকম্পন বা ভূমিকম্পের প্রধান কারণ। এ ছাড়া অগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ,
শিলাচ্যুতি, তাপ বিকিরণের কারণেও ভূমিকম্প হয়। তবে সে ধরনের ভূমিকম্প
টেকটোনিক প্লেটের ওঠানামার মতো অতটা ভয়ংকর হয় না।
ভূমিকম্প যেকোনো
মুহূর্তেই আঘাত হানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা
জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, সমগ্র বিশ্বে বছরে লাখ লাখ
ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে অনেক কম্পন অনুধাবন করা যায়ও না। সংস্থাটি আরও
জানিয়েছে, বছরে গড়ে ১৭টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, রিখটার স্কেলে ওই
ভূমিকম্পের মাত্রা ৭-এর ওপরে থাকে। আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প বছরে একবার হয়ে
থাকে। তবে পৃথিবীতে যত ভূমিকম্প আঘাত হানে, তার ৯০ শতাংশই প্রশান্ত
মহাসাগরীয় এলাকায় ঘটে।
ইতিপূর্বে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প না ঘটলেও
বর্তমানে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি। ভূতাত্ত্বিক জরিপে জানা যায়,
বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ নম্বরে
রয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট
অঞ্চল। কারণ এ অঞ্চল ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ফলে
এখানে বারবার ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অল্প সময়ের
ব্যবধানে বারবার মৃদু ভূমিকম্প উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়, যা
বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের আশঙ্কার কারণ।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের
ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বাংলাদেশকে সতর্কও করেছে। বিষয়টি মাথায় নিয়ে
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে রিখটার স্কেলের মাত্রা ৭
ছাড়িয়ে গেলেই রাজধানী ঢাকা শহরের প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যা সম্প্রতি
মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে ঘটেছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আর
ভূমিকম্পের মাত্রা ৮ ছাড়িয়ে গেলে শহরে দেড়-দুই লাখ লোকের মৃত্যু ঘটবে।
এমনিতেই বাংলাদেশের অবস্থান ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মিজ তিনটি সক্রিয়
টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত।
ফলে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ ও
পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিনিয়ত মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হলেও মানুষ তা টের পায় না।
সুতরাং বলা যায়, ভূমিকম্প মহাদুর্যোগ হয়ে যেকোনো সময় বাংলাদেশে বড় ধরনের
আঘাত হানতে পারে। কাজেই আমাদের যথেষ্ট সতর্ক হতে হবে। ভবন নির্মাণ এবং
যেকোনো ধরনের স্থাপনার ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে সঠিক গ্রাউন্ড মোশন
নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে পুরোনো ভবনকে টেকসই মজবুতভাবে সংস্কার করতে
হবে। খুব বেশি পুরোনো দালান বা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলতে হবে। ঢাকা শহরের
জন্য বিষয়টি আরও ভয়ংকর হতে পারে। ভূমিকম্প ৭ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রাজধানী
ঢাকা শহরের চিত্র পাল্টে যাবে। ঘনবসতি ও জনবহুল এ শহর হবে তখন মৃত্যুপুরী।
কাজেই এখনই সতর্ক হতে হবে সবাইকে। টেকসই স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি ঘনবসতি
ভবন নির্মাণ প্রতিহত করতে হবে। তবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা
সম্ভব হতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক লেখক