
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও বাংলাদেশের বিমা খাত সেভাবে আশা জাগাতে পারেনি। উপরন্তু খাতটি আস্থাহীনতাসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। বিশ্বব্যাপী বিমা খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা এখনো অনেকাংশে অব্যবহৃত রয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে বিমার আওতায় আছেন দেশের মাত্র ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের বিমা খাতে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুশাসনের অভাব, দুর্বল বিনিয়োগ কৌশল, সীমিত পণ্যের বৈচিত্র্য এবং ডিজিটালাইজেশনের অভাব একে পিছিয়ে দিচ্ছে। বিমা খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এ খাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুশাসন, দক্ষ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা এবং গ্রাহকবান্ধব বিমাপণ্য সরবরাহ করা। সেই সঙ্গে বিমা খাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নীতিবান মানবসম্পদ, আইডিআরএর সঠিক নজরদারি এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেবার সমন্বয় ঘটাতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসনের অভাবেই অনেকটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের বিমা খাত। অনেক কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশে অনিয়ম, প্রিমিয়াম ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্বসহ একাধিক কারণে জনগণের আস্থা হারিয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে বিমা খাত পিছিয়ে রয়েছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, আর্থিক সাক্ষরতার অভাব ও বিমা সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিনের দুর্বল সুশাসন, জবাবদিহির অভাব ও কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম খাতটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তৃতীয়ত, ডিজিটালাইজেশন ও আধুনিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার বিমা সেবাকে ধীর ও জটিল করেছে। এ ছাড়া আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্য, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ব্যাপকতা এবং আইনের প্রয়োগ দুর্বল হওয়াও খাতটির বিকাশে প্রতিবন্ধক। তাই বিমা খাতে গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রথম ও প্রধান উদ্যোগ হওয়া উচিত স্বচ্ছতা ও সময়মতো দাবি নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি আরও শক্তিশালী করে অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে খাতটির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে।
খাত বিশেষজ্ঞ ও চার্টার্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সের সাবেক সিইও জিয়াউল হক বলেন, বিমা খাতকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত করা সম্ভব হলে গ্রাহক প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার তথ্য জানতে ও দেখতে পারবেন। এতে একদিকে যেমন বিমার প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়বে, অন্যদিকে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে। দেশের বিমা খাত ডিজিটালাইজেশনে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অর্থনীতিতে বিমা খাতের অবদান বাড়াতে হলে প্রযুক্তিগতভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বিমা খাতকে কেবল ব্যবসা নয়, জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোর অংশ হিসেবে দেখতে হবে।
বিমা খাত সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ এখনো সচেতন নয়। সাধারণ মানুষ মনে করেন বিমা মানে ঝামেলা বা অর্থের অপচয়। বাস্তবে একটি ভালো বিমাপণ্য জনগণের আর্থিক সুরক্ষার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হতে পারে। বিমা খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত জরুরি।
বিশ্বের প্রায় সব দেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান বাড়ছে। বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে বিমা খাতের অবদান বাড়ার পরিবর্তে কমছে। বর্তমানে জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা দুই বছর আগেও ছিল প্রায় ১ শতাংশ। এ খাতের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালাতেও নজরদারি বাড়াতে হবে। তাহলে এ খাত শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই দেবে না, জাতীয় উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
