
বেগম
রোকেয়ার একটি পরিচিত উক্তিকে স্মরণ করেই শুরু করা যাক। ১৯০৫ সালে রোকেয়া
তার ‘মতিচুর’ বইতে লিখেছেন, ‘পুরুষদের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা
করিতে হয় তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী
ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী জজ সবই হইব। আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই? কি চাই? যে
পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন
ব্যবসা করিতে পারিব না?’
রোকেয়া একটি স্বপ্নের কথাও লিখে রেখে গেছেন;
সুলতানা নামের গৃহে অবরুদ্ধ এক বাঙালি মেয়ে স্বপ্ন দেখছে যে চলে গেছে সে
আশ্চর্য এক দেশে, যেখানে অপরাধ নেই, মশা নেই, পুলিশও নেই। এই অদ্ভুত
ব্যাপার সম্ভব হলো কী করে, কারণটা কী? কারণ হলো পুরুষ সেখানে গৃহবন্দি,
তারা পুরুষালি দৌরাত্ম্যের সুযোগ পায় না। সুলতানার এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত
হয়নি, হবেও না। হলে আমরা এক চরম থেকে অন্য চরমে নিক্ষিপ্ত হতাম,
পুরুষ-নারীনির্বিশেষে। কিন্তু ভেতরের বক্তব্যটা তো জোরালো এবং স্পষ্ট। সেটা
এই যে, পুরুষই হলো নষ্টের মূল।
আসলে পুরুষ নয়, রোকেয়া লড়ছিলেন
পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। পুরষতান্ত্রিকতাই হচ্ছে নাটের গুরু। এই
পুরুষতান্ত্রিকতা আসলে একটি ব্যাধি, তবে সে আবার আদর্শও এবং সেজন্যই এত
বেশি মারাত্মক। পুরুষতান্ত্রিকতাই নারীকে গৃহকার্যে আটক রাখে, নারীর
জগৎটাকে ছোট ও অগভীর করে দিতে চায়, তাকে দিয়ে পরিশ্রম করিয়ে নেয় কিন্তু
পরিশ্রমের স্বীকৃতি দেয় না। ওই ব্যাধি এবং আদর্শই। এককালে নারী শিক্ষা বলতে
গৃহকর্মে নিপুণতাকেই বোঝাত; এবং এখন যে ছাড় দিয়েছে সেটা নিতান্ত বাধ্য
হয়ে। এবং এ কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কালে কলকাতায় সরকারি উদ্যোগে
নারী শিক্ষয়িত্রীদের প্রশিক্ষণ দানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত নরমাল স্কুলটি
বন্ধ হয়ে যায়।
পুরুষতান্ত্রিকতার ব্যাধি একটি দুষ্ট আদর্শ, বলা যায়
কুসংস্কার। এ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরকে লড়তে হয়েছে, যখন তিনি
বিধবা বিবাহের পক্ষে এবং বাল্য বিবাহের বিপক্ষে কাজ করছিলেন। তার আগে
রামমোহন লড়েছেন সতীদাহ প্রথা নিবারণের চেষ্টা করতে গিয়ে। শেষ জীবনে রামমোহন
ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। বিদ্যাসাগর কলকাতাতেই
ছিলেন এবং শেষ বয়সে এতটাই ক্লান্ত ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে, কলকাতার
সংশ্রব এড়িয়ে সাঁওতাল পরগনায় গিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন।
মহিলা নরমাল
স্কুলের ব্যাপারটা লক্ষ্য করার মতো। বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত
উৎসাহী ছিলেন। মেয়েদের শিক্ষিত করতে হলে যে পুরুষ শিক্ষকদের ওপর নির্ভর
করলে চলবে না, মহিলা শিক্ষক প্রয়োজন হবে এটা তিনি না বুঝলে কে বুঝবেন?
কিন্তু শিক্ষয়িত্রী তৈরি করার জন্য সরকার যখন একটি মহিলা নরমাল স্কুল
প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে তখন বিদ্যাসাগর তাতে সাড়া তো দেনইনি, উপরন্তু
বিরোধিতা করেছেন। নীতিগতভাবে কাজটির প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ছিল, কিন্তু
তার বাস্তববাদী সামাজিক বুদ্ধি তাকে বলে দিয়েছিল যে, ওই স্কুলটি চলবে না।
কারণ সামাজিক কুসংস্কার। নরমাল স্কুলে ভদ্রঘরের পড়ুয়া পাওয়া যাবে না,
অভিভাবকরা তাদের পাঠাবেন না; কেননা সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে অবরোধ প্রথা
এমন প্রবল ছিল যে, বয়স্ক মেয়েদের তারা কিছুতেই শিক্ষিকার চাকরি নিতে দেবে
না। তাই বিধবা ও ধর্মান্তরিত মেয়েরাই শুধু নরমাল মহিলা স্কুলে আসবে। এদের
সামাজিক মর্যাদা নিচু স্তরের। আর শিক্ষয়িত্রীরা যদি সামাজিকভাবে মর্যাদাবান
না হন তাহলে শিক্ষাদানের কাজও মুখথুবড়ে পড়বে। মেরি কার্পেন্টার নামে একজন
ইংরেজ মহিলার উৎসাহে সরকারি উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত স্কুল খোলা হয়েছিল। কিন্তু
বাস্তববাদী বিদ্যাসাগর যা ঘটবে বলে ভয় পেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাই ঘটেছে।
বিদ্যালয়টি টেকেনি। এটা ১৮৬৭ সালের ঘটনা।
বিদ্যাসাগরের পরের মানুষ বেগম
রোকেয়া। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন এমন এক পৃথিবীর যেখানে মেয়েরা অবাধে চলাফেরা
করবে। বলা বাহুল্য, সে স্বাধীনতা তিনি নিজে ভোগ করেননি; অবরোধ না মানলেও
পর্দা তাকে ঠিকই মানতে হয়েছে, পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে।
এই
পুরুষতান্ত্রিকতাকে রোকেয়া ধর্মের প্রচারিত বক্তব্যের মধ্যেও দেখেছেন এবং
তা বলেছেনও। যেমন- ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ
ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।’ এবং ‘তবেই
দেখিতেছেন ঐ ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নয়।
মুনিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার
বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। কিন্তু স্ত্রী-লোকদের সে-রূপ যোগ্যতা কই যে
মুনি ঋষি হইতে পারিতেন?’
যোগ্যতা নেই এসব কারণে যে, তাদের যথাযথ শিক্ষা
দেওয়া হয় না। সে ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাকে বিদ্যাসাগর অত্যন্ত অধিক গুরুত্ব
দিতেন, সমান গুরুত্ব রোকেয়াও দিতেন। সুলতানা যে স্বপ্নরাজ্যে ভ্রমণ করে
এসেছে সে রাজ্য পুরুষতান্ত্রিকতাকে যে ছিন্নভিন্ন করা হলো সেই অসাধারণ
কাজটি কীভাবে ঘটল? ঘটল শিক্ষার জোরে। রোকেয়া বলেছেন, ‘শিক্ষার নির্মল
জ্যোতিতে কুসংস্কার রূপ অন্ধকার দূরীভূত হইয়া গেল।’ শিক্ষা কি পারে
কুসংস্কার দূর করতে? হ্যাঁ, অনেকটা পারে, কিন্তু সবটা পারে না।
সবটা
পারে না যে তার প্রমাণ তো আমাদের চারদিকে কেবল ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই, অত্যন্ত
প্রত্যক্ষ, নিষ্ঠুর ও উৎকট রূপেই বিদ্যমান রয়েছে। রোকেয়া বলেছেন, পুরুষের
সমকক্ষতা লাভের জন্য দরকার হলে লেডি কেরানি থেকে শুরু করে লেডি জজ পর্যন্ত
সবকিছুই হবেন। তার সে আশা যে ব্যর্থ হয়েছে সেটা বলার উপায় নেই বৈকি। কেবল
লেডি জজ কেন, মহিলারা আজ প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেত্রী হচ্ছেন,
তারা সামরিক বাহিনীতে সোৎসাহে যোগ দিচ্ছেন, পাইলট হচ্ছেন উড়োজাহাজের, ইট
ভাঙছেন পথের পাশে দ্বিপ্রহরে, দালান তৈরির, মাটি কাটছেন মধ্যরাতে।
প্রতিযোগিতামূলক
বিদ্যায়তনিক পরীক্ষাগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো
করছে। কিন্তু তার পর? তাদের চলাফেরা কি স্বাধীন ও স্বাভাবিক হয়েছে? অবরোধ
নেই সত্য, কিন্তু গণ্ডি তো রয়েছে, কোথাও কোথাও তা সীতার গণ্ডির চেয়ে কম
বাস্তবিক নয়। আমাদের এ রাষ্ট্রে কম নাগরিকই সবদিক দিয়ে নিরাপদ বোধ করে।
সবচেয়ে ক্ষমতাবান যারা তারাই মনে হয় বেশি সন্ত্রস্ত থাকে, যে জন্য পাহারা
ছাড়া এক পা এগোয় না। নারীর নিরাপত্তাহীনতা এখানে দ্বিগুণ, প্রথমত নাগরিক
হিসেবে। দ্বিতীয়ত, নারী হিসেবে। রাষ্ট্র তার মিত্র নয়, পুরুষ তার শত্রু।
নারী
নির্যাতন আমাদের এ প্রাণপ্রিয় স্বদেশভূমিতে কোনো নতুন ঘটনা নয়। নির্যাতন
ছিল এবং রয়েছে। কিন্তু বিশেষ ভীতির ব্যাপার যেটা তা হলো এই যে, নির্যাতনের
পরিমাণ ও মাত্রা দুটোই বাড়ছে। গণধর্ষণ আগে ছিল না, এ কাপুরুষতার খবর প্রথম
শোনা যায়। একাত্তরের যুদ্ধের সময় হানাদাররা ওই কাজ করেছে। কিন্তু তারা একে
তো হানাদার, তাতে আবার সত্যিকার অর্থেই কাপুরুষ, তাই তাদের কাছ থেকে ওই
রকমের বর্বরতা যে অপ্রত্যাশিত ছিল তা বলা যাবে না। কিন্তু স্বাধীন দেশের
যুবকরা যে তাদেরই মাতৃ, ভগ্নি এবং ক্ষেত্রবিশেষে কন্যাসমদের কেবল ধর্ষণ নয়,
গণধর্ষণও করছে, সে ব্যাপারে আমাদের সান্ত্বনাটি কোথায়? জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে নরাধমেরা তাদের সহপাঠিনীদের গুনে গুনে ধর্ষণ
করে এবং ১০০টি ঘটনা ঘটাতে পেরেছে বলে জয়ধ্বনি দিয়ে উৎসব করে, তারা হানাদার
নয়, বাঙালিই; তবে হানাদারদের মতোই পুরুষ বটে। তারাও নিজেদের ‘বীর’ মনে
করে, হানাদাররা যেমন করত। পেছনে কেবল সরকারি সমর্থন যে কাজ করে তা নয়, আরও
বড় সমর্থক ও উসকানিদাতাও রয়েছে। সেটি অন্য কেউ নয়, পুরুষতন্ত্র ছাড়া। এসিড
নিক্ষেপ আগে ছিল না, এখন অহরহ ঘটছে। লাঞ্ছিত ও আতঙ্কিত নারী দাঁড়াবার কোনো
জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করছে। সবাই করে না, করলে পুরুষদের
জন্য ভয়াবহ সংকট দেখা দিত; অনেক লাঞ্ছিত মেয়েই মরার মতো পড়ে থাকে, কোনোমতে
টিকে থাকে; আদৌ বেঁচে থাকে না। উন্নতির সব আড়ম্বর ও সব ধরনের আস্ফালনের
নিচে চাপা পড়ে যায় অসহায় মেয়েদের ক্রন্দনধ্বনি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
