
জুলাই
অভ্যুথানের মধ্যদিয়ে অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রধানত তিনটি বিষয়
নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমটা ছিল গণ-অভ্যুত্থানকালীন মানবাধিকারের যে
ব্যাপক লঙ্ঘন হয়েছে, নাগরিকদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার সঙ্গে যারা
সংশ্লিষ্ট ছিল তাদের বিচার। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল গণতান্ত্রিক কাঠামোকে টেকসই
করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা এবং সেটা নিয়ে
তারা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তৃতীয়ত হচ্ছে, জুলাই সনদ। অন্তর্বর্তী সরকার
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথাবার্তার পর চেষ্টা করেছে একটা সুন্দর
অবস্থায় আসা যায় কি না। আগামী নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যারাই সরকার গঠন করবে
তারা যাতে গণ-অভ্যুত্থানে যে জনপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে অর্থাৎ টেকসই
গণতন্ত্র, দায়বদ্ধ শাসনব্যবস্থা, ন্যায্যতাভিত্তিক মানবিক সমাজ গঠন, সেসব
তারা বাস্তবায়ন করবে। এ তিনটি বিষয়কে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে
সচেষ্ট থাকতে হবে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যারা আছেন তারা
সক্রিয়ভাবেই এ সংস্কার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। তারা চান আন্দোলনের সময়
যারা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন তারা যেন সুবিচার পান। আর যারা অবিচারের
কারণ হয়েছিলেন, যারা ক্ষমতার বেআইনি ব্যবহার করে মানুষের ওপর অত্যাচার
করেছেন বা ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন তাদের আইনের দায়বদ্ধতায় আনা
হোক। একটি ন্যায়ের শাসনভিত্তিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে এর বিকল্প নেই।
ইতোমধ্যে
প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করেছেন। আগামী বছরের ১২
ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনও একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে।
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তারা বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে।
নির্বাচনমুখী সব রাজনৈতিক দলও এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশের
নাগরিক সমাজও এ প্রত্যাশাগুলো ধারণ করে। জনগণ প্রত্যাশা করে বিশ্বের বুকে
একটা গণতান্ত্রিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। আমরা
এখনো অনেকটা ভালো আছি, কিন্তু গুরুত্বটা অতটা উপলব্ধি করতে পারছি না।
আন্তর্জাতিক সহযোগী যারা আছেন, অর্থাৎ যাদের আমরা উন্নয়ন অংশীদার বলি, তারা
কীভাবে আমাদের বিষয়গুলো দেখছেন। বিশ্বের প্রতিটি দেশ এখন অন্তর্বর্তী
সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে।
যেকোনো সরকার, যেকোনো দেশে সম্পর্কের ক্ষেত্রে
একটা ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। সবাইকে এ ধারাবাহিকতার
অংশীদার হতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভারতের দিক থেকেও সুযোগ রাখতে হবে। ভারত যদি এ
বিষয়গুলো সমর্থন করে তাহলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের যে
প্রত্যাশা, তা পূরণে হয়তো এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা বড় ধরনের অর্থনৈতিক
পরিবর্তনের মুখে আছি। ২০২৬ সালে আমরা উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি যাচ্ছি। ফলে
সারা পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য যে যোগাযোগ কাঠামো আছে, সেই
কাঠামোটা পরিবর্তন হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে কাঠামো পরিবর্তনের ফলে বাইরের
পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যদিয়ে
যেতে হবে। তখন উৎপাদন বাড়াতে হবে। সে কাজটা করতে হলে অভ্যন্তরীণ অনেক কিছুর
মানোন্নয়ন প্রয়োজন, সেই সঙ্গে আধুনিকীকরণ করতে হবে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার মতো অবস্থায় তুলে আনতে হবে। কাজেই আমরা যে
ধরনের সংস্কারের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি, সে ক্ষেত্রে আমি বলব, মূল চ্যালেঞ্জ আসবে
আমাদের আগামী দিনগুলোতে। আগামী দিনে যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদের এ
চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
বিচার, সংস্কার, নির্বাচন- এসবই জটিল
বিষয়। জাতীয়ভাবে আমরা যেভাবে ৫ আগস্টে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেই
ঐকমত্যটা যদি ধরে রাখতে পারি, তাহলে এ লক্ষ্য অর্জন আমাদের জন্য কঠিন হবে
না। সেই লক্ষ্য হয়তো অর্জন করতে পারব। যদি ধরে নিই নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে
হচ্ছে- তাহলে সম্ভাবনার জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। প্রথম যা চিহ্নিত করা
যায়, তা হলো স্থিতিশীলতা। দেশে এখনো আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এসব বিষয়ে অনেক
চ্যালেঞ্জ আছে। অন্তর্বর্তী সরকরকে এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
স্থিতিশীলতার বিষয়ে বিস্তর মনোযোগী হতে হবে। তার কারণ, স্থিতিশীলতা যদি না
থাকে তাহলে আর্থিক খাত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিদ্যমান সামাজিক অবস্থা- সব
ক্ষেত্রে অগ্রগতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৩
শতাংশ অর্জন হবে বলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মনে করছে। এটা আমাদের জন্য ভালো খবর
নয়। যেখানে আমরা ৬ থেকে ৭-এ ছিলাম। সেখান থেকে ৩-এ নেমে যাওয়াটা অশনিসংকেত।
কাজেই, অর্থনীতি যদি স্থিতিশীল রাখতে হয়, তাহলে আগামী সরকারকে যথেষ্ট
পরিমাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং দায়বদ্ধ একটা অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে
হবে। এর পাশাপাশি যা করতে হবে, তা হচ্ছে একটা দায়বদ্ধ শাসনব্যবস্থা তৈরি
করা। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
কাজেই একটা সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন হবে। আরেকটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-
তা হলো তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে হবে আগামী বাংলাদেশকে। সেটা
করতে গেলে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
আশাবাদী করে তুলতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্য অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে,
শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। দক্ষতাব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে।
এগুলো যদি আমরা করতে পারি তাহলে তরুণ প্রজন্মের যে প্রত্যাশা, সেটা আগামী
দিনে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখানে চ্যালেঞ্জ থাকবে।
বিগত
দিনগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে বলা চলে- কর্মসংস্থানমুখী অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ,
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ প্রত্যাশিত জায়গায় দাঁড়
করানো সম্ভব হয়নি। এখানে সুশাসন একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা যদি সুশাসন
বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে আগামী দিনে দেশে অভ্যন্তরীণ ও
বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করতে পারি। যার মধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি হওয়া
সম্ভব। নতুন প্রজন্ম যে অস্থিরতার মধ্যে আছে, তারা যদি আগামী দিনে আশ্বস্ত
না হয় তাহলে দেশে স্থিতিশীলতার যে কথা বলেছি, সেটা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হবে।
আরেকটা দিক হলো- জুলাই আন্দোলনের পর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি
নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। দেশে আমরা কী ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা
দেখতে চাই, তা নিয়ে সবাই প্রশ্ন করছে। সাম্প্রতিক অনেক ঘটনায় বাইরের
পৃথিবীতে আমাদের ভাবমূর্তি নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। এখানে মূল কথা
হলো বাইরের পৃথিবী আমাদের কোন দৃষ্টিতে দেখে। এ দৃষ্টিটা যদি সুদৃষ্টি হয়
তাহলে অর্থনীতি বলি, ব্যবসাবাণিজ্য বলি, কর্মসংস্থান বলি- সবকিছুতে একটা
ইতিবাচক অংশীদারত্ব সম্ভব।
বর্তমান সরকার স্বল্প সময়ের জন্য আছে, তারা
শুধু রূপরেখা বা কাঠামো দিতে পারবে। এটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া,
অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক, উদার বাংলাদেশ তৈরির যে কাজ তা বেশ
চ্যালেঞ্জ। সেই কাজটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে তরুণ প্রজন্ম যে বাংলাদেশকে
দেখতে চায়, সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। তাহলে আত্মমর্যাদা নিয়ে সারা
পৃথিবীর সঙ্গে চলতে পারব। বাংলাদেশের মানুষের সৃজনশীলতায় আমি বিশ্বাসী। এ
ধরনের অর্জন কঠিন নয় বলে আমি মনে করি। আমরা যে চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে
যাচ্ছি, এ চ্যালেঞ্জের শিক্ষা নিয়ে অথবা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে
আমরা যেন আগামী দিনে আরও ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারি- একটি সুন্দর বাংলাদেশ
গড়ার প্রত্যয়ে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
