দেশে মাদকাসক্তি ক্রমে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই মাদকের ছড়াছড়ি। শুধু তরুণ-যুবা নয়, কিশোর-কিশোরীরাও ক্রমেই বেশি সংখ্যায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এর প্রধান কারণ মাদকের সহজলভ্যতা।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গাজীপুর, লক্ষ্মীপুর ও ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তজুড়ে মাদকের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গাজীপুর ও লক্ষ্মীপুরের মতো জনবহুল এলাকায় মাদকের জমজমাট কারবার এবং ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে মাদকের অবাধ প্রবেশ প্রমাণ করে দেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি কেবল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে না, বরং সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে।
জানা যায়, গাজীপুরে মাসে শতকোটি টাকার মাদক কারবার চলছে, যেখানে দুই শতাধিক স্থানে মাদকের হাট এবং পাঁচ শতাধিক পাইকারি কারবারি সক্রিয়।
এসব কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মাদকসম্রাজ্ঞীরা। অন্যদিকে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত সন্তানের যন্ত্রণায় অভিভাবকরা অতিষ্ঠ। মাদক কেনার টাকা জোগাড় করতে না পেরে সন্তানরা মা-বাবাকে মারধর করছে, এমনকি খুনও করছে। টঙ্গীর বস্তিগুলো; যেমন-এরশাদনগর, মাজার বস্তি, ব্যাংকের মাঠ বস্তি ও কেরানীর টেক বস্তি মাদকের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যেখানে নারী কারবারিদের দাপট চোখে পড়ার মতো।
লক্ষ্মীপুরের চিত্রও একই রকম উদ্বেগজনক। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, জেলায় ৪২ জন মূল হোতা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে মাসোহারা দিয়ে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি হচ্ছে। মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় হত্যা এবং মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্বে গুলি চালানোর ঘটনা প্রায় নিয়মিত। অন্যদিকে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক অবাধে প্রবেশ করছে।
কাঁটাতারবিহীন সীমান্ত এলাকাগুলো মাদকের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে মাদকের হাট বসছে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই ব্যবসা চলছে।
জানা যায়, মাদকের ভয়ংকর বিস্তারের কারণে পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে এখন উচ্ছৃঙ্খল মাদকসেবীদের বাড়বাড়ন্ত। মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে বাড়ছে খুনাখুনি। মাদকের অর্থ সংগ্রহের জন্য এসব তরুণের অনেকেই চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। একটি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। মাদকের বিস্তার এভাবে চলতে থাকলে দেশের যুবসমাজ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এর লাগাম টানতেই হবে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও স্থানীয় পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে। প্রতিটি মাদক মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় সাক্ষী সুরক্ষা এবং জামিনব্যবস্থার অপব্যবহার রোধে আইনি সংস্কার জরুরি। সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি এবং আন্তর্দেশীয় সমন্বয় জোরদার করতে হবে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মাদক শুধু একজন ব্যক্তির সমস্যা নয়, এটি পারিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও এক জটিল সমস্যা।