
বলছিলাম
ডা. তৃপ্তীশচন্দ্র ঘোষ ও ডা. মল্লিকা বিশ্বাসের কথা। তাদের সঙ্গে আমার
চতুর্মূখী আত্মীয়তা। তবে প্রথাগত নয়। স্বাভাবিকের চেয়েও ব্যতিক্রম।
আমার
স্ত্রী ষাটের দশকে টাঙ্গাইল মির্জাপুর আরপি সাহার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
ভারতেশ^রী হোম-এর শিক্ষিকা। তখনও আমার সঙ্গে বিয়ে হয়নি, তবে যোগাযোগ ছিল।
বিয়ে হবে, এ সিদ্ধান্ত ছিল দৃঢ়। তার সহকর্মী রতন সাহা একই সাথে শিক্ষিকা,
বান্ধবী, অনেকটা প্রাণেশ^রী। তার ভালোবাসার লোকটি নাগরপুর ডিগ্রি কলেজের
প্রধান করণিক। নাম নীতিশ চন্দ্র ঘোষ। সুতরাং দু’বান্ধবীর প্রস্তুতি নেয়ার
বিষয়টি ছিল অভিন্ন। ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে আমি ও আরতি এবং নীতিশ ও রতন
ঘর বাঁধি। নীতিশবাবুর ছোট ভাই তৃপ্তীশ তখন স্কুলের ছাত্র। এভাবে এ পরিবারের
সঙ্গে একধরনের সখ্যতা। এ সখ্যতার প্রধান ভিত্তি হলো আমার বড়শালা, আরতির
জ্যেষ্ঠভাই উপেন্দ্র চন্দ্র দাশ। ভারতেশ^রী হোমসের সিনিয়র ইংরেজি শিক্ষক,
পরিবার-পরিজন নিয়ে বাসা নিয়ে থাকেন। এ বাসাটি আমাদের বিয়ের আগেই মিলন
ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। সে অনেক কথা।
তৃপ্তীশ ও আমার ছোট ভাই প্রদীপ একই
সালে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে। তাদের পরীক্ষার ফলাফল মোটামুটি
ভালো। ডাক্তারি পড়ার প্রবল শখ। কিন্তু এইচএসসির নাম্বার বিবেচনায় দু’জন
ডাক্তারি ভর্তি হতে পারেনি। তারা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে বেটানারি
বিভাগে ভর্তি হয়। তখন তাদের বন্ধুত্ব। ২/৩ মাস ক্লাস করার পর অনুভব করল
ভবিষ্যতে তারা ‘গুরুর ডাক্তার’ হবে, এ কেমন কথা। এর চেয়ে বিশ^বিদ্যালয়ে
কোনো একটি বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করাই সম্মানজনক। তাই কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের
পড়া ছেড়ে পরবর্তী বর্ষে বিজ্ঞান বিষয়ের যে কোনো একটিতে উচ্চতর ডিগ্রি
শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা করবে, তা ভেবে ঢাকা চলে আসে, দু’জন
জগন্নাথ হলে থাকে, অভিভাবক থেকে মাসোয়ারা নেয়। কিন্তু কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের
পড়া যে ছেড়ে দিয়েছে তা জানায়নি। সংক্ষেপে বলছি- পরের বৎসর দু’জনে
ডাক্তারিতে পড়ার সুযোগ পায়, আমার ভাই প্রদীপ সিলেট মেডিকেল কলেজে ও তৃপ্তীশ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে এমবিবিএস পাশ করে ডাক্তার হয়। তৃপ্তীশ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়তে গিয়ে মল্লিকা বিশ^াসের সঙ্গে পরিচয়-পরবর্তীতে
পরিণয় সূত্রে আজ তৃপ্তীশ-মল্লিকা দম্পতি বিশেষ কুমিল্লার অত্যন্ত পরিচিত
জনপ্রিয় জুটি হিসেবে আমাদের অঘোষিত আত্মীয় হয়ে উঠেছে।
যেহেতু তৃপ্তীশ
আমার ছোট ভাই এর বন্ধু, আমার স্ত্রীর বান্ধবীর দেবর, সুতরাং সম্পর্কটা
কিছুতেই ফেলনা নয়। এ সূত্রে মল্লিকা আমার ভ্রাতৃবধু প্রতিম। পারিবারিক
মেলবন্ধনটা দৃঢ় বলা যেতে পারে। আমি তাদের কাছে মান্যজন হিসেবেই বিবেচ্য-
এটা আমি মনে করি। কারণ, তাদের আচরণে দৃশ্যমান, আন্তরিকতার ঘাটতি নেই বলেই
জানি।
আমার ভাই প্রদীপ এখন স্কয়ার হাসপাতালের ক্যানসার রোগের বিশেষজ্ঞ।
শুনেছি ভালো ডাক্তার। আমার পুত্রবধুর বেস্টক্যানসার চিকিৎসা করে নিরাময়
করেছে। তৃপ্তীশ ডাক্তারি পাশের পর রাশিয়ায় গিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা ও ডিগ্রি
অর্জন করে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বনামখ্যাত। কুমিল্লায় তার আস্তানা,
এদিক দিয়ে আমি একজন নিকটজন আত্মীয়তুল্য দম্পতির তত্ত্বাবধানে সকল সুবিধা ও
সুযোগ পেয়ে আসছি। মল্লিকা বিশ^াস শুধু ডাক্তার নয়, একজন কবি। তার কবিতা
আমাকে ভাবায়, ভালো লাগে। কারণ সে কবিতার মাধ্যমে জীবনকে নানাভাবে উপস্থাপন
করে, জীবনের অমিয় রসধারা ব্যক্তিগত অনুভূতির সাথে মিশিয়ে একধরনের মায়াবী
ভাব বিস্তার ঘটাতে পারে। যেহেতু আমি লেখালেখি করি, কবিতা নয়, গদ্য, তারপরও
কোথাও মিল খুঁজে পাই। তার প্রধান কারণ ৩৫ বছর কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে
কবিতা পড়াতে হয়েছে, কবিতা পড়তে হয়েছে, কবিতার জগৎ সাগর-সম। বুঝলে সীমাহীন,
না বুঝলে কলাপাতা। মল্লিকা গায়িকা, তার কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেকটাই
মৌলিক। রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের স্থানীয় পর্যায় নেতৃত্ব দিতে গিয়ে এ
ক্ষেত্রে অনেকটাই নিবেদিত। কন্ঠ মাধুর্য-সাবলীল, চলনে-বলনে আচরণে
রবীন্দ্রায়ন প্রতিভূ। এদিক দিয়ে তৃপ্তীশ কবিতা বা গান লিখলেও প্রসারিত নয়।
তার ক্ষেত্র হৃদয়যন্ত্র নিয়ে। হৃদয়ের ভাষা আলাদা, অনুভূতি স্পর্শকাতরতায়
শিহরিত, হৃদয় হাসায়-কাঁদায়। এই হৃদযন্ত্রটির কারিগর হচ্ছে ডা. তৃপ্তীশ
চন্দ্র ঘোষ। হৃদয়ের ভাষা না বুঝলেও হৃদয়ের ধ্বনি সচল রাখার কলাকৌশল বিষয়ে
আপসহীন রক্ষাকর্তা। এটা তার পেশা। কিন্তু আমি সেভাবে মূল্যায়ন করছি না,
তাকে তেমনভাবে বিবেচনায় নিচ্ছি না। আমি দেখেছি, আমার মতো অনেকেই জানেন-
তিনি এক্ষেত্রে অত্যন্ত মানবিক। তিনি মানুষের হৃদয়কে সুস্থ রাখার জন্য
ব্যক্তি-উদ্যোগে হার্ট ফাউন্ডেশন করেছেন, বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছেন, যার
হৃদয় নড়বড়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে অভয়বাণী শুনিয়ে নিজের পেশাগত দায়িত্ব
পালন করছেন। আজ কুমিল্লায় হার্ট ফাউন্ডেশন বলতে দ্বিধাহীন ডা. তৃপ্তীশের
কথা অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ,
হৃদয়ের এ কুল, ও কুল দুকুল ভেসে যায়, হায় সজনি,
উথলে নয়নবারি।
যে দিকে চেয়ে দেখি ওগো সখী
কিছু আর চিনিতে না পারি।।
পরানে পড়িয়াছে টান,
ভরা নদীতে আসে বান,
আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো,
বাঁধ আর বাঁধিতে নারি।।
সুতরাং হৃদরোগ বড় কথা নয়, মানুষের প্রাণের যে স্পন্দন তা যিনি নিরাময় করে রাখেন, তাকে মনবিক বলাই যুক্তিযুক্ত, শ্রেয়।
ডা.
তৃপ্তীশ শুধু পেশাগত পরিমণ্ডলেই সীমিত হয়ে থাকেন নি। কারণ, হৃদয়ের কথা
শুনতে হলে মানুষের কল্যাণ চিন্তা করতে হয়, না হলে পরিপূর্ণ হওয়া যায় না,
তাই দেখি- পেশাগত দায়িত্বের বাইরে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিরলস
যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শুভ উদ্যোগকে চলমান রাখছেন।
কোথায় নেই তৃপ্তীশ ? রোটারি-মেডিকেল কলেজ
প্রতিষ্ঠা-অধ্যক্ষতা-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় সার্বিক উপস্থিতি-জনসচেতনায়
হৃদরোগ প্রচারে প্রকাশনা, রাস্তায় রাস্তায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষকে
জানান দেয়া থেকে নীরবতা ভেঙ্গে সরব করে তোলার দায়িত্ব স্বউদ্যোগে করে আজ
ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন।
ডা.
তৃপ্তীশের সকল কর্মকাণ্ড কিন্তু আত্মপ্রচারণা নয়, জাগিয়ে তোলার আপ্রাণ
জয়ধ্বনি। তিনি মিছিলে সামিল হতে আহবান করেন, কারণ আমরা যেন অবহেলায় মরনের
আগে না মরি, বাঁচার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই।
জাগরণে যায় বিভাবরী-
আঁখি হতে ঘুম নিল হরি মরি মরি।।
যার লাগি ফিরি একা একা
আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা,
তারি বাঁশি ওগো বাঁশি
তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি মরি মরি।।
‘তারি বাঁশি বাজে হিয়া’- এটাই তো হৃদয় ব্যঞ্জনা। এ ব্যঞ্জনার কারিগর হচ্ছেন ডা. তপ্তীশ।
বর্তমানে
ডাক্তারি পেশার প্রতি মানুষের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এটার জন্য তারাই
অনেকটা দায়ী। কারণ, তারা জানে না, তাদেরকে নিয়ে এক শ্রেণির নিম্ন মানসিকতার
লোক, যাদের আমরা দালাল বলি, যাদের ইন্দনদাতা তথাকথিত ক্লিনিকগুলোর
কর্ণধারগণ, ফলে মানবিক পেশাধারী ডাক্তারগণ বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছেন। এমনটি
আমরা মেনে নিতে পারি না। আমরা তাও মেনে নিতে পারি না যে ডাক্তারগণ অর্থের
পেছনে ক্লান্তিহীন শ্রম দিবেন। দু:খের বিষয় হলো- রোগী অনেকক্ষেত্রে ডাক্তার
চিনল না- সে কোন ডাক্তারের চিকিৎসা নিচ্ছে। ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে যদি
আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে না ওঠে, তবে রোগী সুস্থ হবে কীভাবে। সরকারি ডাক্তার
যখন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না নিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিজে অসুস্থ হলে
চিকিৎসা নেন, তখন সাধারণ জনগণ হিসেবে প্রশ্ন জাগে। এক্ষেত্রে ডা. তৃপ্তীশ
গং বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। বলছিলাম ডা. তৃপ্তীশ ও ডা. মল্লিকার কথা।
তাদের আচরণে এমনটি নজরে আসেনি। এর হয়তো প্রধান কারণ, তারা অনেকটাই
সামাজিক। ডাক্তারি পেশা ছাড়া সামাজিক কর্মকাণ্ডে সময় ব্যয় করে, বিভিন্ন
সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করেন। এজন্য
কুমিল্লায় এ দম্পতি সকলের পরিচিত। সংকটে-প্রয়োজনে-আনন্দবেদনায় কাছাকাছি
থাকতে দেখেছি। এজন্যই বলছি তারা মানবিক ডা. দম্পতি। তাদের নীরব সহযোগিতার
কথাও জানি, এ ব্যাপারে নীরব রলাম ইচ্ছে করে। তাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রটি
বিশাল না হলেও উল্লেখযোগ্য। শেষ করছি এই বলে- ‘তোমাদের অভিযাত্রা যেন
অব্যাহত থাকে, পেছনে তাকানোর সময় যেন না হয়। রোগনিরাময়ে তোমাদের হাত যেন
এমনটাই প্রসারিত থাকে, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা পৃষ্ঠপোষকতা সহ নিজেদের উদার
দরজা-জানালা সব সময় খোলা থাকে। আমরা যেন বলতে পারি- ভিন অঞ্চলের এক দম্পতি
আমাদের অহংকারের মণিকৌঠায় স্থান করে আমাদের হয়ে গেছে। তোমরা আমাদেরই
প্রতিবেশী, আপনজন।’
অহংকার করিবে না অন্ধ
গৌরব হবে না উচ্চ পর্বত
বহমান নদী চলিবে নিরন্তর।
সাগর পানে ধেয়ে
কেবলই শঙ্খধ্বনি বাজবে
মানবের জন্য অন্তর।।
