শনিবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৫
৬ পৌষ ১৪৩২
প্রবাসী শ্রমিকদের মানবিক মূল্য
ড. আলা উদ্দিন
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১১:৫৫ পিএম আপডেট: ২০.১২.২০২৫ ১:১৯ এএম |

প্রবাসী শ্রমিকদের মানবিক মূল্য মানবসভ্যতার অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং কর্মজীবী মানুষের সংগ্রাম ও আর্থিক সংগতি লাভের ক্ষেত্রে অভিবাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। অভিবাসন উন্নত বিশ্বের অগ্রগতি ও দেশান্তরিত মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং নিঃসঙ্গতার এক জটিল সমীকরণের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য আন্তর্জাতিক অভিবাসনের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড যাদের কঠোর পরিশ্রমে দাঁড়িয়ে আছে, তারা হলেন আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ উন্নত জীবনের আশায়, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্নে পাড়ি জমান সুদূর বিদেশে। তাদের এ যাত্রা শুধু একটি ভৌগোলিক পরিবর্তন নয়, এটি এক ধরনের জীবনের বাজি ধরা, যেখানে অনিশ্চয়তা, শারীরিক কষ্ট এবং মানসিক চাপ নিয়ত সঙ্গী। এই শ্রমিকদের অধিকাংশই গ্রামীণ ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেন, যারা জীবনের সবটুকু সঞ্চয় অথবা সুদে ঋণ করে বিদেশে যাওয়ার খরচ জোগাড় করেন। তাদের চোখে থাকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন- একটি পাকা বাড়ি, সন্তানের ভালো শিক্ষা এবং পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তি।
প্রবাস জীবনের প্রথম অধ্যায়টি সাধারণত শুরু হয় চরম ত্যাগ ও সংগ্রাম দিয়ে। অপরিচিত ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং প্রায়শই অমানবিক কাজের পরিবেশের সঙ্গে তাদের মানিয়ে নিতে হয়। ভোরের আলো ফোটার আগে কাজ শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের কর্মযজ্ঞ। নির্মাণশিল্প থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতার কাজ, এমনকি গৃহস্থালীর কঠিন শ্রমের মধ্যদিয়ে তারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করেন। তাদের এ জীবন অনেকটা নিভৃতে জ্বলতে থাকা একটি মোমবাতির মতো, যা নিজের আলো দিয়ে পরিবার ও দেশের অর্থনৈতিক অন্ধকার দূর করে, কিন্তু নিজে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়।
এ ত্যাগ ও সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলটি হলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা অর্থপ্রবাহ এক অভাবনীয় শক্তি জোগায়। প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের এ রেমিট্যান্স আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। এ রেমিট্যান্সই গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করে, লাখ লাখ পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। অর্থনীতিবিদরা প্রায়শই প্রবাসী শ্রমিকদের ‘গোল্ডেন সন্স’ বা সোনার ছেলে হিসেবে আখ্যায়িত করেন, কারণ তাদের ঘাম ঝরানো উপার্জন ছাড়া দেশের এ অর্থনৈতিক অগ্রগতি কল্পনা করা কঠিন।
কিন্তু এ আর্থিক মূল্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তাদের মানবিক মূল্য এবং অধিকারের প্রশ্নটি। যাদের ঘামে দেশ চলে, যাদের পাঠানো অর্থে আমাদের অর্থনীতি এত দ্রুত এগোচ্ছে, তাদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনিবার্য। বিদেশে কর্মরত থাকাকালীন তাদের যে করুণ ও অবহেলিত জীবনের মুখোমুখি হতে হয়, তা প্রায়শই আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়।
বিদেশে আমাদের শ্রমিকরা প্রায়শই নানা ধরনের বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয়, অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়েও পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না এবং অনেক সময় তাদের পাসপোর্ট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র জব্দ করে রাখা হয়। বিশেষ করে নারী গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হন, যা তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। এ শোষণ ও বঞ্চনা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি তাদের মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
এ ছাড়া, রয়েছে মানসিক চাপ ও নিঃসঙ্গতার দীর্ঘ ছায়া। পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও দেশের পরিচিত পরিবেশ থেকে বহু দূরে একাকী জীবন কাটানো অত্যন্ত কষ্টের। উৎসবের দিনে কিংবা অসুস্থতার সময়েও তাদের পাশে কেউ থাকে না। এ মানসিক যন্ত্রণা প্রায়শই ডিপ্রেশন বা হতাশার জন্ম দেয়, যা বহু প্রবাসীর অকালমৃত্যুর কারণ হয়। যখন কোনো প্রবাসী শ্রমিকের কফিনবন্দি লাশ দেশে ফেরে, তখন তার সঙ্গে ফিরে আসে না শুধু একটি লাশ বরং একটি ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন ও অব্যক্ত কষ্টের ইতিহাস।
দেশে প্রত্যাবর্তনের পরেও তাদের সংগ্রাম শেষ হয় না। দীর্ঘ সময় বিদেশে থাকার কারণে অনেকে দেশি বাজারের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন না, ফলে তাদের অর্জিত অর্থ সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হন। এ ছাড়া, সামাজিক স্বীকৃতির অভাব এবং নিজেদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ না পাওয়ায় অনেকেই পুনরায় হতাশায় ভোগেন। এ সময়ে তাদের জন্য সমন্বিত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের অভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে- যাদের ঘামে দেশ চলে, তাদের অধিকার রক্ষায় আমরা কতটা সৎ? বাস্তবতা হলো, তাদের ত্যাগের স্বীকৃতি আমরা শুধু মুখে দিলেও, অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা যথেষ্ট নয়। প্রথমত, বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি এখনো সম্পূর্ণভাবে দালালমুক্ত ও নিরাপদ করা যায়নি। চড়া দামে ভিসা কিনতে গিয়ে বহু শ্রমিক প্রতারিত হন এবং বিদেশে গিয়েও বিপদে পড়েন। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এ প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করা এবং শ্রমিকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, বিদেশে আমাদের দূতাবাস ও শ্রম উইংগুলোর ভূমিকা আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় হতে হবে। প্রবাসীরা বিপদে পড়লে তাদের তাৎক্ষণিক আইনি সহায়তা প্রদান, নিয়োগকর্তার সঙ্গে মধ্যস্থতা করা এবং তাদের নিরাপদে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা দূতাবাসের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে যে, প্রবাসীরা তাদের পাশে দূতাবাসকে পান না। তৃতীয়ত, জাতিসংঘের অভিবাসন চুক্তি (টঘ গরমৎধঃরড়হ ঈড়হাবহঃরড়হ) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ওখঙ) কনভেনশনগুলো মেনে চলার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের মতোই ন্যায্য মজুরি ও মানবিক পরিবেশ পান।
চতুর্থত, প্রবাসে থাকা শ্রমিকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি। তাদের একাকীত্ব ও মানসিক চাপ কমানোর জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আয়োজনে দূতাবাসগুলো উদ্যোগী হতে পারে। পঞ্চমত, দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসীদের দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, তাদের বিনিয়োগের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত শুধু প্রবাসীকল্যাণ দিবস উদ্যাপন করা নয়, বরং তাদের মানবিক মূল্য ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া। তাদের অবদানকে কেবল অর্থনৈতিক চোখে না দেখে, তাদের ব্যক্তিগত ত্যাগ ও সংগ্রামকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে। এই শ্রমিকরা শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধা নন, তারা আমাদের জাতিসত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ঘামে ভেজা পথ ধরেই আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। তাই তাদের প্রতি অবহেলা বা বৈষম্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের অধিকার রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা জরুরি। 
আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো, সেই সব স্বপ্নকে মর্যাদা দেওয়া যা একটি উন্নত বাংলাদেশের জন্য হাজার মাইল দূরে বসে একটি মানুষ প্রতিনিয়ত দেখে চলেছে। তাদের প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানাতে হলে, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, একজন প্রবাসী শ্রমিকও যেন তার ন্যায্য অধিকার ও মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত না হন। এই আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে আমাদের দৃঢ় সংকল্পহোক- আমরা সেই শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াব, যারা আমাদের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের স্বপ্ন ও বেদনাকে ভাগ করে নেওয়া, তাদের প্রতি সৎ ও মানবিক আচরণ করা এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া- এটাই হোক তাদের প্রতি আমাদের সত্যিকারের ঋণ স্বীকার। কারণ, একটি দেশের সত্যিকার উন্নতি শুধু তার অর্থনৈতিক সূচকে পরিমাপ করা যায় না, বরং তার নাগরিকদের প্রতি মানবিক আচরণের মধ্যেও তা প্রতিফলিত হয়। প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা অর্থনৈতিক হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি গভীর।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়














http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
ওসমান হাদি দেশে ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে
চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল যুবক ও বৃদ্ধার
ষড়যন্ত্র করে কুমিল্লা সদর আসনের মানুষের সাথে আমার বন্ধন ভাঙ্গতে পারবে না: হাজী ইয়াছিন
ব্রাহ্মণপাড়ায় পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীকে একাধিকবার ধর্ষণ প্রধান শিক্ষক গ্রেপ্তার
ব্রাহ্মণপাড়া থানায় রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যানবাহন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
আরো ১৫ প্রার্থীর পক্ষে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ
না ফেরার দেশে চলে গেলেন ওসমান হাদি
দলীয় মনোনয়নের ‘ফাইনাল সিলেকশান’ হবে সামনে
নজিরবিহীন বিক্ষোভ ‘হাদি হাদি’ স্লোগান
অবৈধভাবে মাটি কাটায় লালমাইয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২