সোমবার ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
৮ পৌষ ১৪৩২
এত ঘৃণা, প্রতিহিংসায় সমাজ টেকে?
মাহবুবুল হক ভূঁইয়া
প্রকাশ: সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম আপডেট: ২২.১২.২০২৫ ১:৩৩ এএম |

 এত ঘৃণা, প্রতিহিংসায় সমাজ টেকে?
কারও উক্তি দিয়ে লেখা শুরু করাটা কখনো কখনো ক্লিশে, গতানুগতিক মনে হয়। কিন্তু দুদিন ধরেই মহাত্মা গান্ধীর “চোখের বদলে চোখ নিলে পুরো পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে” উক্তিটি মাথায় ঘুরছে। গুগল ঘেঁটে এই উক্তি গান্ধী কবে, কোথায়, কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন খুঁজে পাওয়া গেল না। মনে হলো, বাংলাদেশের সমসাময়িক দশা দেখেই হয়তো বলেছেন। সেটি যে নয়, তা তো বটেই। কিন্তু গান্ধীর এই উক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রাসঙ্গিকতা বেশ ভালোভাবেই মিলে যায় বলে মনে হলো।
আজকাল ফেইসবুক খুললেই ঘৃণা, প্রতিহিংসা একরকম আকাশ ছুঁয়েছে বলে মনে হয়। ফেইসবুক যদি সমাজের বাস্তব অবস্থার অর্ধেক প্রতিফলনও হয়, তাহলে এ পরিবেশ মানুষের মানসিক সুস্থতার সঙ্গে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এত ঘৃণা, প্রতিহিংসার কারণ আসলে কী? এই যে ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, কেউ বলছেন নির্বাচনে বাধা তৈরির জন্য এটি করা হয়েছে। আবার কেউ আওয়ামী লীগের প্রতিশোধপরায়ণতার কথা বলছেন। এর কোনোটাই হয়তো কারণ হিসেবে ভুল নয়, কিন্তু এগুলো কি মূল কারণ?
বাংলাদেশের নাগরিকেরা স্বাধীনতার পর থেকে স্থায়ী ও ধারাবাহিক ট্রমার মধ্যে বসবাস করছেন এবং ওই ট্রমাই সমাজে ঘৃণা ও প্রতিহিংসার কারণ হিসেবে কাজ করছে, এই হাইপোথিসিসের মধ্য দিয়ে এই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। প্রথমেই বলে নিই, এটি কোনো গবেষণালব্ধ ফলাফল নয়, ফলে একেবারে কার্যকারণ হিসেবে বিবেচনা করাটা ভুল হবে। পাঠক বরং এটিকে বিশ্লেষণ হিসেবে পড়তে পারেন, সেটিই যুক্তিযুক্ত। আমাদের মনে যে দুটি বড় ঘটনা এই স্থায়ী ও ধারাবাহিক ট্রমা তৈরি করেছে তার প্রথমটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিতীয়টি শেখ হাসিনার শাসনামল। প্রথমটির কারণে সৃষ্ট ট্রমার সময়কাল লম্বা ও প্রভাব ব্যাপক। দ্বিতীয়টির সময়কাল কম, কিন্তু প্রভাব গুরুতর।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর রাষ্ট্রে যে প্রক্রিয়ায় রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টিকে চাপা দেওয়া হয়েছে, সেটি স্বাধীনতাকামী পক্ষ ও বিরোধীদের মধ্যে একটি স্থায়ী ও ধারাবাহিক ট্রমা তৈরি করেছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ বিচার না হওয়ায় যুদ্ধের সময় নিহত, আহত, ধর্ষণের শিকার মানুষদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো ভুক্তভোগীদের সঙ্গেই বাস করতে শুরু করল, কিছুকাল পরে মন্ত্রী-এমপিতে পরিণত হলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেটি ঘটনার শিকারদের মনে ট্রমা তৈরি করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
অন্যদিকে বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় সমাজে দিনের পর দিন যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষকে ধারাবাহিকভাবে এই ঘটনার দায় বহন করে চলতে হচ্ছে। ওই দায় স্বয়ং যুদ্ধাপরাধীদের যেমন নিতে হচ্ছে, তাদের পরিবারকেও নিতে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনার দিকে তাকানো যাক। সম্প্রতি সুনামগঞ্জ-২ আসনের বিএনপি প্রার্থী নাছির উদ্দিন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বী শিশির মনিরকে রাজাকারের ছেলে বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তাঁকে বিচার করার মানদণ্ড হিসেবে বাবার পরিচয় সামনে নিয়ে আসা হলো। শিশির মনিরকে নিশ্চয়ই আমরা তার বাবার অপরাধের দায় দিতে পারি না। শিশির মনিরের রাজনীতির সমস্যা অন্য জায়গায়, সেটিকে সেভাবেই বিচার করা উচিত।
শিশির মনিরের দল জামায়াতে ইসলামী ধর্মের ব্যবহার ও অপব্যবহার করে রাজনীতি করে, যেটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সমস্যাজনক। তাই বাংলাদেশকে জামায়াতের ৭১-এর ভূমিকার প্রশ্নে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত। সেটি দল হিসেবে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে একটি উপসংহারের মাধ্যমে হতে পারে। এ উপসংহার এমন হওয়া উচিত, যাতে ভুক্তভোগী পক্ষও আশ্বস্ত হয় এবং বিপক্ষ পক্ষটিও যাতে এ নিয়ে আর আক্রমণের শিকার না হয়। যতদিন এটি আমরা না করতে পারি, এই বিষয়ে সমাজে বিভক্ত থাকবে এবং এটি কেন্দ্র করে ঘৃণা, প্রতিহিংসা অব্যাহত থাকবে।
এবার দ্বিতীয় ঘটনা, শেখ হাসিনার শাসনামলের গুরুতর প্রভাবের দিকে তাকানো যাক। শেখ হাসিনার শাসনামল গুম, খুন, মামলা-হামলা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকাসহ আরও অসংখ্য কারণে সমাজের অধিকাংশ মানুষের মনে ট্রমা তৈরি করেছে। তবে এখনও আশার কথা হলো এই ঘটনা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক এবং এটিকে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ের মতো স্থায়ী ও ধারাবাহিক ট্রমায় পরিণত হওয়ার সুযোগ না দিয়ে সমাধানের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্রকে দুটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত, শেখ হাসিনার পুরো শাসনামল এবং ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে যেসব ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ প্রক্রিয়া চলছে।
কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। বিচারের নামে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব এমন এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হলো, যার সুনির্দিষ্ট দলীয় পরিচয় রয়েছে। এ কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, চাইলে এই বিতর্ক এড়ানো যেত না। সুতরাং, এখনও এসব বিতর্ক সংশোধন করে যদি ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করা যায় তাহলে ঘটনার শিকার মানুষদের মনে সান্ত্বনা তৈরি হবে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে ট্রমা তৈরির ঝুঁকি কমবে।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের যেসব সমর্থক বা কর্মী সরাসরি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন, তাদেরকে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন অথবা অন্য যে প্রক্রিয়া যুক্তিযুক্ত হয়, সেটির মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ করে দিতে হবে। তবে বিচার নিশ্চিত করলেই পুরো আওয়ামী শাসনামলে ট্রমার শিকার মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি মিলবে না। এ সংখ্যা এত বড় যে, ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং সম্ভব হবে কি না, জানি না। তবে একটি জাতিগত ও সামষ্টিক বোঝাপড়ার বন্দোবস্ত করতে হবে, যাতে তারা অপরাধীদের বিচারের বিষয়টি মেনে নিতে পারেন। পাশাপাশি যারা প্রত্যক্ষ অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। আমরা যদি এ কাজগুলো করতে না পারি, তাহলে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ আওয়ামী শাসনামলের অপকর্মের দায়ে জেলে আছেন বা দেশে-বিদেশে পালিয়ে আছেন, তাদের পরিবার-পরিজনসহ আরেকটি ট্রমায় আক্রান্ত গোষ্ঠী তৈরি হবে, যার ভার যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর মতো জাতিকে দীর্ঘকাল বহন করতে হবে।
দেখুন, দুটি বড় ট্রমা জিইয়ে রেখে একটি শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক সমাজ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর পদ্ধতিগত সমাধান হয়নি। তখন বিচার এবং ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ের চূড়ান্ত সমাধান হলে আমাদের এ ইস্যু আজ অবধি টানতে হতো না। আর এই বিষয়কে কেন্দ্র করে সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে স্থায়ী ট্রমার তৈরি হতো না। এই ইস্যু নিয়ে রাজনীতি থাকত না। অস্থিরতা থাকত না। পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হতো না। ঘৃণার চাষও হতো না।
একইভাবে আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে সৃষ্ট ট্রমার স্থায়ী মীমাংসা না হলে সেটি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ হবে, অপরাজনীতি হবে এবং ঘৃণার চাষ হবে। তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষের। ফলে এই ইস্যুর মীমাংসা, যত তাড়াতাড়ি হবে তত ভালো। আজ হাদিকে যে হামলার শিকার হতে হলো, সেটিকে শুধু নির্বাচন বানচালের কারণ হিসেবে দেখলে সাময়িক সমাধান মিলতে পারে। কিন্তু ধরুন নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে কি এ ধরনের আক্রমণ থেমে যাবে? আমরা যদি মানুষের মধ্যে থেকে ঘৃণা, প্রতিহিংসা সর্বোপরি এই সামগ্রিক ট্রমা দূর করতে না পারি তাহলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। আমরা একে অপরের ক্রমাগত নিপীড়ন ও ট্রমার কারণ হয়ে দাঁড়ালে, সমাজে ঘৃণা ও প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছু রইবে না। যদি চোখের বদলে চোখ নিলে পুরো পৃথিবী অন্ধ হয়ে যায়, আমরা নিশ্চয়ই ওই পথে হাঁটতে চাই না।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সটি অফ মিনেসোটা টুইন সিটিজে জার্নালিজম স্টাডিজে পিএইচডি অধ্যায়নরত।












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
অনলাইন-অফলাইনে পর্যবেক্ষণে প্রার্থীরা
কুমিল্লায় ৫৪ টি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ
১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ড. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ইসলামী সরকার গঠিত হবে: এমদাদুল হক মামুন
কুমিল্লা-১০ আসনে নারী নেত্রী শিউলীর মনোনয়নপত্র সংগ্রহ
দেবিদ্বারে ২০০ নেতাকর্মীর বিএনপিতে যোগদান
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় যৌথবাহিনীর অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ চিহ্নিত সন্ত্রাসী শামীম গ্রেপ্তার
কুমিল্লা দ. জেলা বিএনপির কমিটিতে তিনজনের অন্তর্ভূক্তি
জানাজায় অংশ নেয় লাখো মানুষ
বুড়িচংয়ে ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার
অবৈধ দুই ইটভাটা বন্ধ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২