
প্রতিবছর
১২ই ডিসেম্বর সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস হিসাবে পালিত হয়। দিবসটি
পালনের মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিটি নাগরিকের জন্য আর্থিক বোঝা ছাড়াই মানসম্মত
চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের দেশে দিবসের প্রাক্কালে এ ধরনের একটি
প্রতিবেদনে দেখা যায় স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের ৪৪ শতাংশ
পরিবার আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে এবং অনেকে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে
যাচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ^ ব্যাংকের এ হিসাবটি শুধু একটি
পরিসংখ্যান নয়। এটি লাখো মানুষের দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। বিশেষজ্ঞদের মতে,
ব্যয় মেটাতে না পেরে দারিদ্র জনগোষ্ঠী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে
অথবা ধারদেনা ও সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আরো দরিদ্র হচ্ছে।
এটি দেশের সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (টঐঈ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে এক
বিশাল অন্তরায়। ইউ.এইচ.সি হল অসুস্থতার কারণে কেউ যেন আরো বেশি দরিদ্র না
হয়। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন।
২০১২ সালে একটি স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্র
তৈরি করা হয়। শুরুতে এ লক্ষ্য অর্জনে জোর দেয়া হলেও ২০১৫ সালের পর থেকে তা
অনেকটাই থমকে আছে। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশের স্কোর
ছিল ১০০ তে ৪৫। এরপর ২০২১ সালে হয় ৫২ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে এ স্কোর
দাঁড়িয়েছে ৫৪ তে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালে এ স্কোর হবে ৭৪। ২০২১
সালে চিকিৎসার জন্য রোগীরা গড়ে ৬৪ শতাংশ অর্থ নিজের পকেট থেকে খরচ করত, যা
প্রতিবছর বেড়ে ২০২২ সালে ৬৯ শতাংশে পৌঁছে। বর্তমানে এ ব্যয় ৭০ শতাংশ
ছাড়িয়ে গেছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ জানান। যদিও কৌশলপত্রে উল্লেখিত লক্ষ্য ছিল
২০৩২ সালের মধ্যে সেটি ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনা। জাতিসংঘের আহ্বানে ২০১৭ সাল
থেকে প্রতিবছর ১২ই ডিসেম্বর বিশ^ব্যাপী দিবসটি পালিত হয়। দিবসটির এবারের
প্রতিপাদ্য “অসাধ্য স্বাস্থ্যব্যয়ে ক্লান্ত রোগীরা।”
সার্বজনীন
স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার, মাতৃ ও
শিশু স্বাস্থ্য, জরুরী অবস্থায় সুরক্ষা প্রদান, যার মধ্যে টিকাদান, রোগ
নির্ণয় ও চিকিৎসা এবং পবিবেশগত ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা অন্তর্ভূক্ত। গ্লোবাল
বারডেম অব ডিজিজÑ২ অনুসারে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ৩৬ শতাংশ হয় হৃদরোগে। এরপর
ফুসফুসের বিভিন্ন সংক্রমণ ও যক্ষ্মায় মৃত্যু ১৯ শতাংশের। ৯ শতাংশ
দীর্ঘস্থায়ী শ^াসতন্ত্রের রোগ, ৮ শতাংশ কোষের বৃদ্ধিজনিত টিউমার, ৫ শতাংশ
ডায়াবেটিস ও কিডনী রোগ, ৫ শতাংশ মাতৃ ও শিশুমৃত্যু, ৪ শতাংশ পরিপাকতন্ত্রের
রোগ, ৪ শতাংশ অন্ত্রের প্রদাহ, ২ শতাংশ স্থায়ুজনিত সমস্যা এবং ৮ শতাংশ
অন্যান্য রোগে মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশের
প্রায় অর্ধেক মানুষ আর্থিকভাবে হোচট খাচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও
বিশ^ব্যাংকের হিসাব বলছে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ে দেশের ৪৪ শতাংশ পরিবার
আর্থিক সংকটের মোকাবেলা করে অনেকেই কপর্দকহীনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এটি
বাংলাদেশের সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (টঐঈ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড়
অন্তরায় বলে স্বীকার করেন বিশেষজ্ঞগণ। বিশেষজ্ঞগণ আরো বলেন, স্বাস্থ্য খরচ
মেটাতে গিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা
গ্রহণে বিরত থাকে বা চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয়
সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সহনীয় বা সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া নিশ্চিত করাই হচ্ছে
সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য। অর্থাৎ একটি দেশের সব নাগরিক আর্থিক
বোঝা ছাড়াই প্রয়োজন অনুযায়ী মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা পাবে এবং অসুস্থতার
কারণে কেউ আরো বেশি দরিদ্র হবে না।
বর্তমান স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় না আছে
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, না আছে কোন আইন বা নীতি, না আছে পরিমিত বরাদ্দ।
প্রাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে গুণগত মানের সর্বোচ্চ পরিমাণ সেবা প্রদানের চেষ্টা
করা হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বর্তমান উপকরণভিত্তিক
ও লাইন-আইটেমভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ ব্যবস্থার কাঠামোগত ত্রুটি দূর করতে
পারলে এ ক্ষেত্রে সফলতা আসতে পারে। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন উত্তমরূপে গঠন
করে বরাদ্দবৃদ্ধি ও এর সদ্যবহার নিশ্চিত করা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এ
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে গত ১০ বছরে সরকারের
কোন কর্মসূচী ছিল না। এ জন্য কোন ফান্ড রাখা হয়নি এবং কোন উদ্যোগও ছিল না।
চিকিৎসা
ব্যয় মেটাতে গিয়ে লাখো মানুষ ব্যাপক ঋণ, ছোট সঞ্চয় থেকে চিকিৎসা ব্যয়
এমনকি সহায় সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এমন অবস্থায় ‘সার্বজনীন
স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস’ কেবল প্রতীকী কর্মসূচী হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজন
অবিলম্বে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং কাঠামোগত সংস্কার। স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ
জাতির জন্য শুধু ব্যয় নয়Ñ ইহা জাতিগঠনমূলক ও উৎপাদনশীল খাতের নিয়ামক।
রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি বিষয়টি এখনও অবলোকন করা না হয় তবে সার্বজনীন স্বাস্থ্য
সেবার লক্ষ্য অর্জন মহাকাশ বিজয়ের যাত্রার মতই দুরাশার অন্ধকারে নিপতিত
হবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
