
দেশ-বিদেশে তথ্য ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সংবাদপত্র। আমাদের দেশীয় সংবাদপত্রে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিয়ে সগৌরবে এখনো টিকে আছে মফস্বল সাংবাদিকতা এবং সংবাদপত্র।
ঢাকার বাইরের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের অঙ্গনে নতুন ধারার সূচনা করে যেসব সাংবাদিক-সম্পাদক ব্যাপকভাবে পাঠকপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন, তাদের অন্যতম কুমিল্লার আবুল কাশেম হৃদয় (মোহাম্মদ আবুল কাশেম)। স্থানীয়ভাবে আবুল কাশেম হৃদয় সাহসী সাংবাদিক-সম্পাদক হিসেবে সমাদৃত।
জাতীয় সংবাদ বর্জিত স্থানীয় রাজনৈতিক সংবাদনির্ভর ভিন্ন ধারার সংবাদপত্রের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, আঞ্চলিক সংবাদপত্রবিমুখ পাঠকদের মাঝে আঞ্চলিক পত্রিকা পড়ার মানসিকতা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর সম্পাদিত দৈনিক কুমিল্লার কাগজ বিপুল সংখ্যক পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এর নিউজ ট্রিটমেন্ট, শিরোনামের আধুনিকতা ও চমক, সেকআপ, গেটআপ সব নতুন, আলাদা, দৃষ্টিনন্দন। দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে অনুসরণ করে নতুন কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি পুরোনো সবগুলো সংবাদপত্রও কুমিল্লার কাগজের আঙ্গিককে অনুসরণ করে প্রকাশিত হয়ে পাঠক সমাদৃত হয়েছে। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকতায়ও এ এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। আঞ্চলিক সংবাদপত্র হয়েও সময়ে সময়ে অসাধারণ সাহসী সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক কুমিল্লার কাগজ উঠে আসে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
২০০৪ সাল থেকে আর্থিক বিবেচনায় অফসেট কাগজে চাররঙা ছাপা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আবুল কাশেম হৃদয় তাতে সফল হয়েছেন। সংবাদপত্রের ইতিহাসে কুমিল্লার ইতিহাস অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং উজ্জ্বল। কুমিল্লার কাগজ, সেই ঐতিহ্যের ধারায় নবতর সংযোজন, নতুন বৈশিষ্ট্য, নতুন ইতিহাস। এর জন্য কুমিল্লার কাগজ নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ। শুধু সংবাদপত্র হিসেবেই এর সাফল্য নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ভিন্ন ভূমিকায় উপস্থিত কুমিল্লার কাগজ। পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবসসহ নানা দিবসে আয়োজন করেছে বড় মাপের অনুষ্ঠান। বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা। এছাড়া প্রতিবছর পাঁচটি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য দেশের বিশিষ্টজনদের পুরস্কৃত করে আসছে।
কুমিল্লার কাগজেই সীমাবদ্ধ নেই সাহসী তরুণ আবুল কাশেম হৃদয়। জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক কালের কণ্ঠ ও চ্যানেল আইয়ে সাহসী অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছেন। এ সাহসী রিপোর্টের জন্য তিনি হামলার শিকার হয়েছেন কয়েকবার। নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন। কিন্তু থেমে নেই তার অগ্রযাত্রা। সাহসকে পুঁজি করে সুন্দর আগামীর স্বপ্নে বিভোর তিনি।
১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর কবিতা লেখার পাশাপাশি স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ, ফিচার লিখে সাংবাদিকতা জীবনের শুরু আবুল কাশেম হৃদয়ের। 'নাইচ্চা খান বাদাম, গাইয়্যা খান বাদাম' শিরোনামে জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সংগ্রামী মহিলার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সংবাদ দিয়ে শুরু। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণে’। এরপর কিছুদিন ‘দৈনিক কুমিল্লা বার্তায়’ কাজ করেন। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কিছুদিন বিরতির পর যোগ দেন ‘সাপ্তাহিক অভিবাদনে’। এ সময় পত্রিকাটির রিপোর্টিং, সম্পাদনা, পেস্টিং, প্রেসে ছাপা, পত্রিকায় টিকেট-লাগানোসহ সব কাজই তদারক করতেন তিনি। ১৯৯৭ সালে যোগ দেন প্রাচীন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সাপ্তাহিক আমোদে’। সে সময় তার বেশকিছু রিপোর্ট ব্যাপক আলোচিত হয়। ১৯৯৮ সালে ‘দৈনিক রূপসী বাংলায়’ যোগ দেন বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে। ক্রীড়া, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও নারী বিষয়ক পাতা সম্পাদনা করেন তিনি। নানা কারণে কয়েক দফা চাকরিচ্যুতি ও পুনরায় যোগদানের ঘটনা ঘটে পত্রিকাটিতে। এ সময় তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ অনার্স (বাংলা) ও এমএ পাস করেন। ১৯৯৯ সালে যোগ দেন দৈনিক জনকণ্ঠের' কুমিল্লার নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে। ২০০১-এ সেই রাজাকার কলামে লেখা অনুসন্ধানী রিপোর্টের পর সৃষ্টি হয় ব্যাপক তোলপাড়। যুদ্ধাপরাধ বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মুখর হয়ে ওঠে কুমিল্লা। মামলাসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হন তিনি। শত শত মুক্তিযোদ্ধা মিছিল করে আদালত পর্যন্ত যান আবুল কাশেম হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধারা।
ফতোয়া সম্পর্কিত দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঢাকা ও কুমিল্লায় মিছিল সমাবেশ করেন নারীনেত্রীরা। বিশিষ্ট নারীনেত্রী ড. নীলিমা ইব্রাহিমসহ ঢাকার নারীনেত্রী ও নারীরা মিছিল করেন। ঢাকা থেকে অসংখ্য নারী, নারীনেত্রী কুমিল্লায় এসে মিছিল সমাবেশ, প্রতিবাদ করেন ফতোয়ার বিরুদ্ধে। ফতোয়াবাজরা গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হন।

চ্যানেল আই সংবাদের প্রথম দিন থেকে কুমিল্লা প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন হৃদয়। ২০০৪-এর অক্টোবরে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন আঞ্চলিক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘কুমিল্লার কাগজ’। এতে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় রাজনৈতিক সংবাদকে। হৈ চৈ ফেলে দেওয়া সংবাদ বুকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত রঙিন আধুনিক ও ঝকঝকে পেপার কুমিল্লার কাগজ। প্রতি সপ্তাহে রাজনৈতিক সংবাদগুলো প্রকাশে অসাধারণ সাহসের পরিচয় দেন তিনি। পর্দার আড়ালের খবর পত্রিকার সংবাদপত্রের পাতায় তুলে ধরে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়। কুমিল্লার কাগজের সংবাদ প্রকাশে ভিন্নতা-জনপ্রিয়তা অনুসরণ করে কুমিল্লার কাগজের আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে শুরু করে পুরোনো সবগুলো আঞ্চলিক সাপ্তাহিক।
২০০৫ সালের ডিসেম্বরে জামাতুল মোজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিদের কুমিল্লার ৯টি মসজিদে প্রশিক্ষণের অনুসন্ধানী রিপোর্টে চ্যানেল আইয়ের লিড নিউজ হিসেবে প্রতিটি খবরে প্রচারিত হওয়ার পর দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে আরো সক্রিয় হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ২০০৬ সালের ১৩ মার্চ কুমিল্লার কালিয়াজুরিতে জেএমবি জঙ্গি-র্যাব বন্দুক যুদ্ধে জঙ্গি নেতা মোল্লা ওমরসহ ৪ জন নিহত ও জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের পুত্র নাবিল রহমানের গ্রেফতারের খবরটি আবুল কাশেম হৃদয় যেভাবে তুলে ধরেছেন তা দর্শক, পাঠক মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। বিশেষ করে ঢাকার সকল ইলেকট্রনিক মিডিয়া যখন তাদের সিনিয়র রিপোর্টাররা রিপোর্টটি কাভার করেন সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম চ্যানেল আই। শুধু চ্যানেল আইই রিপোর্টটি মূল রিপোর্ট হিসেবে সবার আগে প্রচার করে।
২০০৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গেলে আবুল কাশেম হৃদয়কে জিম্মি করা হয়। পরে সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে। এরপর হামলার শিকার হন ২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। কুমিল্লার দেবীদ্বারে ক্যাডার বাহিনী তাকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ কুমিল্লার সাংবাদিকরা মিছিল সমাবেশ করে।
২০০৬-এর ২২ অক্টোবরে সাপ্তাহিক কুমিল্লার কাগজ দৈনিকে রূপান্তর হয়। এক-এগারো পর সংবাদপত্র শিল্পে যে বিপর্যয় নেমে আসে তার শিকার হয় কুমিল্লা কাগজও। সপ্তাহে একদিনের বদলে সাতদিনই রঙিন কুমিল্লার কাগজ পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হলেও মঙ্গলবার পাঠকরা তাদের প্রিয় রঙিন দৈনিক কুমিল্লা কাগজই হাতে পাচ্ছেন। সেই সঙ্গে চলছে বাকি ৬ দিনের সাদাকালো কুমিল্লার কাগজ পাঠক প্রিয় করে তোলার চেষ্টা। কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিদিনই রঙিন দৈনিক কুমিল্লার কাগজ পাঠকের হাতে পৌঁছাতে থাকে। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কুমিল্লার কাগজ। ২০ বছরের এই সাফল্য এখনো ধরে রেখেছে দৈনিক কুমিল্লার কাগজ।
পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয় স্থানীয়, জাতীয় সাংবাদিকতার গণ্ডি পেরিয়ে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকায় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন, ২০১৬ সালে মরক্কোয় জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন, ২০১৫ সালে ফ্রান্সে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে সাংবাদিক হিসেবে অংশ নেন। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় দ্বিপাক্ষিক সফরে যান সুইডেন এবং ২০২০ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে যান ইতালিতে। এছাড়া তিনি ব্রিটেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ভারত, কাতার, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
আবুল কাশেম হৃদয় বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা এবং লেখালেখিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি বহু স্বীকৃত গ্রন্থের রচয়িতা, যার মধ্যে রয়েছে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু (কুমিল্লার কাগজ প্রকাশনী, ২০১৮), যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী ও অবদানের উপর ভিত্তি করে রচিত। এছাড়া কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ইতিহাস (কুমিল্লার কাগজ প্রকাশনী, ২০১৮) গ্রন্থটি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিশদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। তার আরেকটি গ্রন্থ মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লা (কাশবন মুদ্রায়ন, ঢাকা, ২০০০) কুমিল্লার মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা নিয়ে গভীর গবেষণা প্রদান করে, এবং অপারেশন কিল অ্যান্ড বার্ন (কুমিল্লার কাগজ প্রকাশনী, ২০১৫) ১৯৭১ সালের অজানা ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে।
গ্রন্থ ছাড়াও, হৃদয় মানবাধিকার, ফতোয়া সম্পর্কিত বিষয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, বৈবাহিক কুসংস্কার দূরীকরণ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর নিবন্ধ এবং গল্প রচনা করেছেন। তার লেখাগুলো বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যে প্রশংসা অর্জন করেছে। এই সমৃদ্ধ গবেষণা ও লেখালেখির মাধ্যমে আবুল কাশেম হৃদয় একজন সমাজনিষ্ঠ সাংবাদিক এবং গভীর দৃষ্টিভঙ্গির গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি একজন সমাজকর্মী। কুমিল্লা বিভাগ আন্দোলন, বিমানবন্দর পুনরায় চালু, ঢাকা-কুমিল্লা সরাসরি রেললাইন চাই ইত্যাদি আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় তিনি স্থানীয় মানুষকে অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সেবা প্রদান করেন। মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসার জন্য তিনি রক্তদাতা মহান ব্যক্তিদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
