আমার
জন্মের অনেক আগেই তিনি চলে গেছেন। চোখে দেখিনি, কথাও হয়নি কখনো। কিন্তু
নামটি শুনে শুনে আমার ভিতরে গেঁথে গেছে এক ধরনের গর্ব, শ্রদ্ধা, আর বিস্ময়।
তিনি আমার পিতামহ-স্বর্গীয় অনাথ বন্ধু মজুমদার। সময়ের হাত ধরে আজ যখন
কুমিল্লা শহর বদলে যাচ্ছে, তখন বারবার মনে হয়-এই শহরের ইতিহাসে কিছু নাম
হয়তো লেখা নেই, কিন্তু তারা প্রতিটি মোড়, প্রতিটি ইটের ভেতর এক নিঃশব্দ
উপস্থিতি হয়ে বেঁচে আছেন। আমার দাদু সেই নামগুলোর একজন। এই লেখাটি তাঁর
জন্য-একটি গভীর ভালোবাসা ও ঋণের স্বীকারোক্তি।
তাঁর জন্ম হয়েছিল
চৌদ্দগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবার বরদৈন মুন্সী বাড়িতে। তিনি ছিলেন
বিখ্যাত ভৈরব মজুমদারের চতুর্থ প্রজন্ম। ঐতিহ্য, শিক্ষা আর মাটির সঙ্গে
মিশে থাকা আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর রক্তে। সেই বনেদি পারিবারিক প্রেক্ষাপটেই
তিনি গড়ে ওঠেন এক ভিন্ন ধারার মানুষ হিসেবে।
শিক্ষাজীবনের শুরু হয়
নোয়াখালী জিলা স্কুলে। সেখান থেকে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯১৬ সালে তিনি এই কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। সেই
সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক বিরল কৃতিত্ব-বিশেষ করে যিনি পরবর্তীতে
ব্যবসা, ব্যাংকিং ও সমাজসেবায় নিজেকে যুক্ত করবেন, তাঁর জন্য এই শিক্ষাগত
পাথেয় ছিল সত্যিকারের আলোকবর্তিকা।
চাকরিজীবনের শুরুটা ছিল একজন স্কুল
ইন্সপেক্টর হিসেবে। কিন্তু তাঁর অন্তর্গত ব্রিটিশবিরোধী চেতনা তাঁকে
বেশিদিন সরকারি চাকরির শৃঙ্খলে আটকে রাখেনি। তিনি নিজে মুক্ত ছিলেন, আর
চেয়েছিলেন নিজের হাতে কিছু গড়তে। তখনকার দিনে ব্যবসাকে শিক্ষিত মানুষের
পেশা হিসেবে দেখা হতো না। কিন্তু তিনি নিজেই গড়লেন সেই দৃষ্টান্ত-শিক্ষিত
মানুষও ব্যবসা করতে পারেন, শুধু পারেনই না, আরও নৈতিক, মানবিক ও
প্রগতিশীলভাবে করতে পারেন।
তাঁর ব্যবসায়িক যাত্রার শুরু দেশীয় খদ্দর
কাপড়ের মাধ্যমে। কুমিল্লা অভয় আশ্রমের অধ্যক্ষ নৃপেন বোসের পরামর্শে তিনি এ
পথে আসেন। রেইসকোর্সের খবির উদ্দিনের মতো বন্ধু তাঁর এই সিদ্ধান্তে নাখোশ
হলেও, তিনি পিছিয়ে যাননি। চড়কার খদ্দরের কাপড় সংগ্রহের জন্য তিনি নিজেই
সাইকেল চেপে কুমিল্লা থেকে ফেনী, সোনামুড়া, চান্দিনা যেতেন। হাওড়ার বিখ্যাত
হাটে তিনি খদ্দরের চাদর তুলে ধরেন-যা দুই বাংলায় সমাদৃত হয়। গদিতে বসে
ব্যবসা করা এক শিক্ষিত মানুষের দৃশ্য-তখনকার দিনে ছিল এক মৌলিক দৃশ্যপটের
বিপ্লব।
এরপর শুরু হয় তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়ের যাত্রা-ব্যাংকিং জগতে
পদার্পণ। ১৯২৫ সালের দিকে তিনি ইস্টার্ন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক হন। ব্যাংকটির শাখা ছড়িয়ে ছিল পশ্চিমবঙ্গ, জলপাইগুড়ি থেকে শুরু করে
পূর্ববাংলা পর্যন্ত। এই ব্যাংকের গঠন ও বিস্তারে সহায়তা করেছিলেন নবাব
মোশারফ হোসেন। এর বাইরে তিনি কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক ও কুমিল্লা ব্যাংকিং
কর্পোরেশনেরও পরিচালক ছিলেন। পরবর্তীতে এই ব্যাংকগুলো ভারতের অন্যান্য
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। এই সব
উদ্যোগের ভেতর দিয়েই কুমিল্লা শহর একসময় পরিচিতি পায় “ঈরঃু ড়ভ ইধহশ”
হিসেবে-আর অনাথ বন্ধু মজুমদার ছিলেন সেই স্বপ্নের অন্যতম কারিগর।
শুধু
ব্যবসা বা ব্যাংক নয়, তাঁর চিন্তা ছিল বৃহৎ পরিসরে। তিনি রাজনীতিতে নামেন
খুব অল্প বয়সেই। বজ্রপুরের রায় বাহাদুর উপেন্দ্র মিত্রকে পরাজিত করে তিনি
কুমিল্লা পৌরসভার নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পৌরসভা তখনকার সময়ে
ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র-সেই সময় পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন রায় বাহাদুর
স্বর্ণকমল রায়। পুরাতন চৌধুরীপাড়ায় প্রথমবারের মতো পৌরসভার মাধ্যমে জলের
লাইন স্থাপন তাঁরই উদ্যোগে শুরু হয়।
তিনি ছিলেন কুমিল্লা মার্চেন্টস
অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি-যা আজকের কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্স
নামে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বে শহরের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠে শৃঙ্খলা,
ন্যায্যতা ও সম্মানবোধ।
তিনি আরও একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা
করেন-র্যাডিকেল ইন্স্যুরেন্স, যা পরবর্তীতে বিক্রি হয় ডা. ক্যাপ্টেন
দত্তের হাতে। যিনি পরবর্তীতে কুমিল্লা মুরাদনগরের শ্রীকাইল কলেজ প্রতিষ্ঠা
করেন। তিনি বার্মা অয়েল কোম্পানির (ইঙঈ) এজেন্সিও কুমিল্লায় নিয়ে আসেন এবং
নারায়ণগঞ্জভিত্তিক কাপড়ের ব্যবসায় তাঁর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে।
কিন্তু
প্রতিটি উত্থানেরই থাকে কিছু অবসানচিহ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগের
অভিঘাতে তাঁর গড়ে তোলা ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অনেক ব্যবসায়ী ঋণ শোধ
না করে দেশত্যাগ করেন। কর্মচারীদের অবহেলা, অবিশ্বাস এবং ক্রমবর্ধমান
আর্থিক চাপ তাঁকে চেপে ধরে। শরীর অসুস্থ হতে থাকে, মন ক্লান্ত হয়। একসময়
তিনি নিস্তব্ধ হয়ে যান-একটি সময়ের শক্তিমান মানুষ নীরবতার কবরে আশ্রয় নেন।
১৯৬৯
সালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রেখে যান স্মৃতি, শিক্ষা, আর একটি
অসামান্য উত্তরাধিকার। আমরা আজ যে কুমিল্লা শহরে বসবাস করি, সেই শহরের
প্রতিটি খুঁটিনাটি বাঁকে হয়তো তাঁর হাতের ছোঁয়া রয়েছে। আজ তাঁর বসতভিটায়
গড়ে উঠেছে আধুনিক ভবন, বিল্ডিং, নতুন প্রজন্ম-তবুও পুরনো বাড়ির ঘাসফড়িং আর
বিকেলের রোদ যেন এখনো ফিসফিস করে বলে, ‘‘তিনি ছিলেন...’’
এই লেখা তাঁর
প্রতি আমার একান্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি, ভালোবাসার ঋণমুক্তির একটি বিনম্র চেষ্টা।
নতুন প্রজন্ম জানুক-ব্যবসা কেবল লাভের খাতা নয়, তা একেকটি সময়ের নির্মাতা,
একেকজন মানুষের আত্মত্যাগের ফল। আর সেই নির্মাতাদের একজন ছিলেন-আমার দাদু,
অনাথ বন্ধু মজুমদার।
লেখক: ভাস্কর মজুমদার
নাতি, অনাথ বন্ধু মজুমদার, পুরাতন চৌধুরী পাড়া,কুমিল্লা