আমরা
দূর্ভাগা জাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কয়েকবার সুযোগ পেয়েছি ‘৭১ সালে স্বাধীন
হয়ে সুযোগটা জাতীয় আন্তর্জাতিক চক্রান্তে নষ্ট করেছি। ৭৫ সালের পরিবর্তন
নিজেদের ভুলের কারণে খেসারত দিয়েছি। রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতে পৌঁছতে
ব্যর্থ হয়ে দেশগড়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। ‘২৪ সালে সুযোগ হয়েছিল অপশাসন,
সীমাহীন দুর্নীতি, অপহরণ-হত্যা-গুম, গণহত্যার রক্তের উপর দাঁড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ
বিজয় সংঘটিত করা। সম্পূর্ণ নতুন মানসিকতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন বাংলাদেশ
গড়ার। অনেকটাই ভুলতে বসেছি। এখনো বিনা বাধায় ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ লালসা,
প্রতিহিংসা ও পারস্পরিক রাজনৈতিক দন্ধের মধ্যে আমরা বাস করছি। রাজনৈতিক
ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ থেকে ভবিষ্যতে দেশ কতটা মুক্ত হবে, সে
বিষয় নিয়ে কোন দলের মাথাব্যথা নাই। এসবই হচ্ছে কোন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক
দলের দুরারোগ্য ব্যাধি।
আমি কোন দরবেশও না সমাজসংস্কারকও না কিন্তু আমার
মনে হচ্ছে দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার সঙ্গে দেশ চালালে দেশ অবশ্যই
কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হবে। নৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে খুব
শক্ত শাসনের মধ্যে রাখতে হবে। দুর্জন ও অশিক্ষিতের জন্য উদার গণতন্ত্র
প্রয়োগ করা যাবে না। যেকোন দলের নেতা ও পোষ্যপুত্রের প্রতিটি অন্যায় কাজের
জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা আইনের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
সে মতে নির্বাচনের আগেই বিধিবিধান সংস্কার করতে হবে। প্রতিষ্ঠানিক ও
সামাজিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর নিরিখে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্য স্থির করতে
হবে। শিক্ষার ভিত্তিমূল নির্ধারণ, কাঠামো পরিবর্তন, স্বক্রিয় সাংস্কৃতিক
বৈশিষ্ট ও মূল্যবোধ বজায় রেখে একটা সময়োপযোগী শক্ত বাস্তবায়ন পদ্ধতি চালু
করতে হবে। এ বিষয়ে শুধু রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মতামতের উপর নির্ভর করা যাবে না।
রাজনীতি করে না এমন অসংখ্য দূরদর্শী চিন্তাশীল ব্যক্তিরা আছেন যারা
দেশচিন্তায় মগ্ন থাকেন। তাঁদের সুচিন্তিত মত গ্রহণ করা যেতে পারে।
রাজনীতিবিদরা অধিকাংশ সময় দলীয় স্বার্থের বাইরে যেতে চায় না। দলের লাভ
দেখতে গিয়ে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
দেশকে
সঠিক মাত্রায় এগিয়ে নেয়ার জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন
তার সঙ্গে আরও কিছু ভাবনা জুড়িয়ে দিয়ে বা প্রতিস্থাপিত করে আরও শক্তিশালী
করা যায়। যেমন ঃ-
১। সংবিধানের মূলনীতি হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা,
সামাজিক সুবিচার, বৈষম্যবিরোধী সমাজ ও গণতন্ত্রকে অন্তর্ভূক্ত করার
প্রস্তাব করা যায়।
২। রাষ্ট্রপতির কার্যবিধি বা সংসদে প্রদত্ত ভাষণ
রাষ্ট্রপতি নিজেই তার সচিবালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর
সঙ্গে আলোচনা হবে তবে প্রধানমন্ত্রী তাহা নির্ধারণ করতে পারবেন না।
৩। সুপ্রীম কোর্টের রায় রাষ্ট্রপতি বাতিল বা পরিবর্তন করতে পারবেন না।
৪। জাতীয় পাতাকা, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় কবি পরিবর্তন করা যাবে না।
৫।
প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় দলের নেতা হতে পারবেন কিন্তু দলীয় প্রধান থাকতে
পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ বা বিদেশে অবস্থান করলে সংসদের উপনেতা
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকিবেন।
৬। প্রধান বিচারপতির নিয়ন্ত্রণে বিচার সচিবালয় থাকবে এবং শুধু অর্থনৈতিক দিকটি বিচার মন্ত্রণালয় দেখবে।
৭। জেলা পরিষদ থাকবে এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সকল কার্যাদি জেলাওয়ারী ব্যবস্থাপনা করিবে।
৮। ফৌজদারী অপরাধে যুক্ত, ঋণ খেলাপী, ভূমিদস্যু, পাহাড়খেকু, নদীখেকু ও পরিবেশবিনষ্টকারীরা যে কোন নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
৯। কৃত্য পেশাভিত্তিক প্রশাসন চালু করতে হবে।
১০। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবী পরিবর্তন করে জেলা কমিশনার ও উপজেলা কমিশনার করা হোক।
১১। ওসি পদে থানায় ১ জন করা হোক এবং আরেক জনের জন্য অন্য একটি পদ নির্ধারণ করা হোক।
১২। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি কৃত্য পেশাভিত্তিক হোক।
১৩। এত ছোট দেশে প্রাদেশিক সরকার চালু করে মাথাভারী প্রশাসন চালু উচিত নহে।
১৪। প্রতিটি স্থানীয় পরিষদে দুইজন যেকোন পেশার প্রতিনিধি রাখা হোক।
১৫। সরকারি চাকুরিতে ২৫ এর স্থলে ১৫ বৎসর পূর্তিতে স্বেচ্ছা অবসরের বিধান প্রবর্তন করা হোক।
১৬। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হোক।
১৭। উপজেলায় ফৌজদারি ও মুন্সেফ কোর্ট স্থাপন করা হোক।
১৮। আইন পেশাজীবীদের ও আদালত প্রাঙ্গনে দলীয় কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হোক।
১৯। কৃত্য পেশাভিত্তিক দুদক ও দুদক আইন আরও গণমুখী করার নিরিখে এটর্নি জেনারেল ও প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে পরিবর্তন আনয়ন হোক।
২০। কর নির্ধারণে আয়কর বিভাগ ও আয়কর দানকারীর মধ্যে বিরোধ হলে আদালতে সমাধানের পদ্ধতি বাস্তবায়িত হোক।
২১। সকল আলোচনা ও সুপারিশের পর রাষ্ট্র সংস্কারের সকল বিষয়াদি অন্তর্ভূক্ত করে একটি জাতীয় সনদ প্রস্তুত করা হোক।
বর্তমানে
অন্তবর্তীকালীন সরকারের সবক্ষেত্রে সাফল্য না থাকলেও আকর্ষণীয় সাফল্য আছে
আন্তর্জাতিক কুটনীতিতে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান আরও
সুদৃঢ় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে
আলোচনা চলছে যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখতে পারবে। বর্তমানে বিশ^রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে
ইউনুস সরকার কৌশলী ভূমিকা রাখছে যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন
করছে। গত ৪ এপ্রিল বিমসটেক সম্মেলনে ড. ইউনুসের ভূমিকা গৌরবময়। আমেরিকায়
অতিরিক্ত করারোপের বিষয়েও ড. ইউনুসের কৌশল একটা পজিটিভ ফলাফল বয়ে আনবে বলে
অনেকেরই ধারণা। বিজ্ঞজনের মতে ড. ইউনুস ধীরে ধীরে রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার দিকে
এগুচ্ছেন। তাঁর চলার গতি ধীর এবং মাপা। ড. ইউনুস এমন এক অবস্থায় আছেন যে
তাঁর চাওয়ার ও পাওয়ার আর কিছু নাই। দুনিয়ার সকল সম্মানের যা যা পাওয়া
সম্ভব, সবই তিনি ইতিমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছেন। শুধু গ্রহণযোগ্য একটি
নির্বাচন দিয়ে দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে জনমনে প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ