গেল জুন মাসে (২০২৪) বনে বাঘ দেখতে প্যাকেজ ব্যবস্থাপনায় সুন্দরবনে গিয়েছিলাম। দু’দিন অনেক ঘুরও বাঘের দেখা মেলেনি। বাঘের দেখা পাওয়াও নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। ছবিতে নানা আকৃতির বাঘ দেখেছি। ঢাকা মিরপুর বিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দি বাঘ দেখেছি। প্রাণবন্ত বলে মনে হয়নি। এগুলো শুয়ে বসে আবদ্ধ অবস্থায় আছে। তাই বড়ো ইচ্ছে হয়েছিল বনের স্বাধীন বাঘ দেখব। দেখতে পাই নি। তবে মনের মধ্যে বাঘ একধরনের বিমূর্ত প্রতিভাসে স্থান করে নিয়েছে। ঘুমালে প্রায়ই স্বপ্নে বাঘ দেখি, স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শুয়ে ঘুমাচ্ছে, গাছের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, অদ্ভুতভাবে জলত্যাগ করছে ইত্যাদি সব। কখনও কখনও হিংস্র অবস্থায় তাড়িয়ে আসছে, আমি দৌঁড়ে আত্মরক্ষা করতে চাইছি, এই বুঝি বাঘ আক্রমণ করল- অসম্ভব অস্থিরতায় চীৎকার করে উঠছি। শব্দ হচ্ছে না, শরীরও নাড়তে পারছি না- এক সময় ঘুম ভেঙে যায়। হাঁপাতে থাকি, মনে হয় অনেকটুকু পথ দৌঁড়িয়ে কোনো প্রকারে প্রাণটা বাঁচিয়েছি। বুঝে গেছি, বনের বাঘের চেয়ে মনের বা স্বপ্নে দেখা বাঘ খুবই শক্তিশালী ও হিংস্র। বনের বাঘ থেকে কোনো না কোনোভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, কিন্তু মনের বাঘ বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুর। হয়ত বাস্তবে আঘাত করে না, কিন্তু অবচেতন মনকে ভীষণভাবে হয়রানি করে।
বাঘ নিয়ে কিছুকথা। কোনো কোনো জমিদার বাড়ির বৈঠকখানায় মৃত বাঘের উপর বন্দুধারী জমিদার জৌলুষপূর্ণ পোষাকে বীর বেশে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন এমন ছবি নান্দনিকভাবে দেয়ালে টাঙিয়ে রেখে আভিজাত্য ও বীরত্বের তকমা জানান দিয়ে রেখেছে। বুঝা গেল- বাঘ শিকার করার মধ্যে বীরত্ব প্রদর্শনের একধরনের যোগসূত্র আছে। আবার কারও কারও বাড়িতে বাঘের চামড়াও দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে এমনটি দেখা যায়। বুঝা গেল বাঘ শিকার করাও ঐতিহ্যের অংশবিশেষ।
আমার মামা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যাকে সত্য ঘটনায় রূপান্তর করে গল্প বলতে পারেন। আমরা জেনে গেছি- মামা সত্যকথা বলছেন না, কিন্তু মিথ্যা গল্পটিও এতটা রসালো, তা উপেক্ষাও করতে পারি না। আমিসহ পরিবারের সবাই মামার গল্পে মোহিত। সকলেই মিথ্যা ভাষণ উপলব্ধি করতে পারেন। একবার মামা বললেন- তিনি সুন্দরবন গিয়েছিলেন এবং ৫০টি বাঘ দেখতে পেরেছিলেন। আমরা বললাম- ‘মামা, সুন্দরবনে এতগুলো বাঘ তো নে ই। তুমি মিত্যা বলছ।’ তিনি বললেন, ‘তা কথার কথা, তবে পঁচিশটি থাকে না, ঠিক বলেনি।’ তিনি বললেন, ‘আমি তো গণনা করিনি, তবে অবশ্যই দশটা বাঘ ছিল।’ আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম, মামা কোনা বাঘই দেখেননি। বললাম, ‘তুমি একটিও বাঘ দেখোনি।’ তিনি হতাশ হলেন না। গল্পটি বিশ^াসযোগ্য করার জন্য কৌশল অবলম্বন করলেন। বললেন- ‘বন প্রহরীদের তাড়া খেয়ে দ্রুত পালাতে গিয়ে কোনোটা জলে কোনোটা গাছে, কোনোটা গোলপাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। তবে দুটি বাঘ যে ছিল তা নিশ্চিত।’ আমরা বললাম, ‘মামা, তুমি কোনো বাঘই দেখোনি।’ তিনি তখন হতাশ হয়ে বললেন, ‘তাহলে গোলপাতা নড়ল কেন ?’ এরূপ বাঘ নিয়ে কত কাহিনি। বনের বাঘ সত্যি, কিন্তু ইচ্ছে করলেই দেখা পাওয়া যায় না। জমিদার বাঘ মেরে পায়ের নীচে মৃত বাঘকে নিয়ে ছবি, তা অনেকটাই কৃত্রিম। কিন্তু মনের বাঘ মিথ্যা নয়।
মনের বাঘের চেহারা বিচিত্র এবং ভয়ঙ্কর। শেকসপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ পড়ছিলাম। কাহিনিটি (সংক্ষেপে) নিম্নরূপ-
স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান। খুবই শান্তিপ্রিয় ও প্রজাবৎসল। রাজার অধীনস্থ সামন্তরা সে সময় রাজার কাছ থেকে যেন খেতাব পেতেন। তারাই মধ্যে ফন্ডর এর সেন রাজা ডানকানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সে সময় অনেকেই স্কটল্যান্ডকে আক্রমণ করেছিল। তখন ম্যাবেথ বীরবিক্রমে ডানকানের জ্যেষ্ঠপুত্রসহ রাজা ও রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার র ঘোড়ায় চড়ে ম্যাকবেথ আর ব্যাংকা রওনা দিলেন ফরেসের শিবিরের দিকে। তখন রাস্তায় তিনজন ডাইনির সাক্ষাৎ লাভ করেন।
আপন মনে ঘুরে ঘুরে নাচছিল ওই তিন ডাইনি- ছড়ার ধরনের হেঁয়ালির মতো অদ্ভুত কথাবার্তা বলছিল তাদের নিজেদের মধ্যে। কথাগুলো এরকম-
একজন বলল, মন-জলের ওই বিজন রাতে,
আবার কবে মিলব মোরা একসাথে ?
দ্বিতীয় জন উত্তর দিল-
তাণ্ডবের পালা শেষ হলে
হারা-জেতা মিটে গেলে।
এমনসময় ম্যাকবেথ বাহিনীর ভেরী আর দামামার আওয়াজ। তা শুনে তৃতীয় ডাইনি-
বাজে এই জেনাদের দামামা
তূর্য- উঠেছে আজ ম্যাকবেথ ও ব্যাংকো।
ডাইনিদের ম্যাকবেথ পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রথম ডাইনি বলল- গ্রামিশ এর যেন ম্যাকবেথ, তুমি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ কর।
দ্বিতীয় ডাইনি বলল- হে কন্ডর এর যেন ম্যাকবেথ- তুমি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ কর।
এবার তৃতীয় ডাইনি বলল- হে স্কটল্যান্ডের ভাবী রাজা ম্যাকবেথ আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ কর তুমি।
অনেক ঘটনা বা যুদ্ধ জয়ের পর রাজা ডানকানের প্রসাদে মাথা থেকে শিরস্ত্রাণ খুলে েিয় ঘাড় হোঁট করে ম্যাকবেথ ও ব্যাংকো অভিবাদন জানালেন রাজাকে। রাজা তাঁদের প্রতি তুষ্ট। সিংহাসন থেকে নেমে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন রাজা। রাজা আনন্দে গদগদ স্বরে বললেন- হে আমার প্রিয় জ্ঞাতভাই ম্যাকবেথ। দেশের জন্য তুমি যা করেছ, তার উপযুক্ত প্রতিদান আমি তোমায় দিতে পারিনি। যৎসামান্য যা দিয়েছি- তার চেয়ে অনেক বেশি পাবার যোগ্য তুমি।
রাজা বললেন, এই শুভ দিনে আমার বড়ো ছেলে ম্যালকমকে কম্বার ল্যান্ডের যুবরাজ ঘোষণা করছি। সেখান থেকে ফিরে এসে আমি ইনভার্নেসে তোমার প্রাসাদে যাব- আজকের রাতটা তোমার অতিথি হয়ে কাটাব।
ম্যাকবেথ জবা দিলেন, সে তো আমার পরম সৌভাগ্য মহারাজ। রাজসেবার জন্য একটু সময় দিতে হবে। আপনার আগমনবার্তা জানাব স্ত্রীকে।
রাজার অনুমতি নিয়ে শিবিরের বাইরে এলেন ম্যাকবেথ। মনে বড় ক্রোধ জমল। রাজা ডানকার তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ম্যালকমকে কাম্বারল্যান্ডের যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তাহলে রাজার মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে ম্যালকম। তার নিজের আর রাজা হবার কোনও সম্ভাবনাই রইল না। তিনি স্থির করলেন রাজাকে হত্যা করবেন। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে পড়ল। আজ রাতেই তো ইনভার্নেসে তার প্রাসাদে রাত কাটাবেন রাজা। এই তো সুযোগ্য সময় সবার অগোচরে রাজাকে সরিয়ে দেবার।
ম্যাকবেথ প্রাসাদে ফিরার আগেই দূতের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন লেডি ম্যাকবেসের হাতে। চিঠিটা খুঁটিয়ে পড়লেন তিনি। তিনি ভেবে দেখলেন ম্যাকবেথ রাজা হলে তিনি হবেন রাজরানি।
বহু ঘটনা, চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা, সতর্কতা অবলম্বন করে রাজাকে হত্যা করে, সাথে অন্যান্যরাও আছে। ম্যাকবেথ স্কটল্যান্ডের রাজা হলেন, এতে লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকা ছিল প্রধান।
তারপরের ঘটনা। ম্যাকবেথ রাজা হয়ে প্রজাপীড়ন শুরু করল। আস্তে আস্তে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দানা বাঁধতে শুরু করল। ম্যাকবেথ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাইনিদের সঙ্গে দেখা করে তার পতনের ইতিবৃত্ত জেনে গেলো। রাতে ঘুমুতে পারে না, অস্থিরতায় সময় বিপদের দিকে এগিয়ে চলেছে। এদিকে পাগলের দশা হয়েছে লেডি ম্যাকবেথের। যতক্ষণ জেগে থাকেন, মাঝে মাঝেই জল দিয়ে দু’হাত ধুয়ে নেন। হাত ধোয়ার সময় বিড়বিড় করে বলেন, এত রক্ত কেন আমার হাতে ? বার বার জল ঢালছি অথচ রক্তের দাগ মুছে যাচ্ছে না। দিন-রাত সব সময় একটা উত্তেজনার মধ্যে রয়েছেন তিনি। ঘুম তার চোখ থেকে কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, গোটা প্রাসাদ জ ুড়ে তিনি পায়চারি করেন।
মূলকথা হলো- ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের কিসের ভয়, কাকে ভয়, কেন ভয়। এর পরিণতি কি ? এই ভয় হলো মনের বাঘের ভয়।
বনেরবাঘ মানুষ হত্যা করে, মানুষকে খয়ে ফেলে, মানুষের রক্ত-মাংস-হাড় ইত্যাদি চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। আমরা বনের বাঘকে ভয় পাই, আবার পোষ মানাই, খাঁচায় বন্দি করে রাখি। শত্রু তো শত্রুই। কিন্তু মনের বাঘ দৃশ্যত কিছুই কর না। কিন্তু তার শক্তি বনের বাঘের চেয়ে ভয়ংকর, নিষ্ঠুর এবং তিলে তিলে ধ্বংস করে। প্রশ্ন- মনের বাঘ কাদেরকে ধ্বংস করে ? এই বাঘ কোথায় থাকে ? তার প্রকৃত পরিচয় কি ? মনের বাঘ একশ্রেণি লোকেরাই সৃষ্টি কর, এ বাঘ তাকেই ধ্বংস করে। এই বাঘ অন্যায়কারীর মনেই সবল ও সতেজ হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। তার প্রকৃত পরিচয় হলো- একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত পাপ, যা অন্যায় বা অত্যাচারের মাধ্যমে অর্জন করে থাকে। মনের বাঘের থাবা থেকে তার মুক্তি নেই। আজ সমাজে কি দেখছি ? রাজ্য শাসনে কি দেখছি ? আমরা ম্যাকবেথ আর লেডি ম্যাকবেথকেই খুঁজে পাই। আমরা শিহরিত হই। আতংকে সংকুচিত হয়ে পড়ি। আমরা নিত্যদিন ডানকানের মতো ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হচ্ছি।
শেষ কথা- ‘বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ
আমার গর্জনে বলে মেঘের গর্জ,
বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,
মাথায় পড়িলে তবে বলে- ‘বজ্র বটে।’
প্রত্যক্ষ প্রমাণ: রবীন্দ্রনাথ