২০১১
সালে প্রকাশিত বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দি টোটাল এনভায়রনমেন্টে
প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন “দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষিত বনের অবস্থা ও
ভবিষ্যত” শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশসহ বিশে^র প্রায় সবদেশ জাতিসংঘের
জীববৈচিত্র বিষয়ক সনদ (সিবিডি) অনুযায়ী সংরক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক
করে। এসব দেশের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার
দেশগুলো। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্থান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপে
রক্ষিত বনের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের মাত্র
৪.৬১ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত বন করতে পেরেছে। তবে ২০২২ সাল নাগাদ কত শতাংশ
বন সংরক্ষিত হয়েছে সে তথ্য এখনও জানা যায়নি। তবে ৫ শতাংশের বেশী অর্জন
সম্ভব হয় নাই বলেই মনে হয়।
সারাদেশে বনের জমি দখল করে রেখেছে ১,৬০,৫৬৬
জন। তাদের দখলে আছে ২,৫৭,১৫৮ একর বনভূমি। দখলে থাকা থেকে রক্ষা পায়নি
সংরক্ষিত বনভূমিও। মোট দখলদারের মধ্যে ৮৮,২১৫ জন সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে
রেখেছে। তাদের দখলে আছে ১,৩৮,৬১৩.০৬ একর সংরক্ষিত বন। জাতিসংঘের খাদ্য ও
কৃষি সংস্থার (এফ.এ.ও) হিসাবে, বিশ^ব্যাপী ২০০০-২০১৫ সময়ে প্রায় ১.৪ শতাংশ
বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশে তা হচ্ছে ২.৬ শতাংশ। দেশে বছরে ২ হাজার ৬০০
হেক্টর ধ্বংস হয়। বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ
৪৬,৪৬,৭০০ একর। বন অধিদপ্তর বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের কাছে ৭,৩৭৬ টি
উচ্ছেদ প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এ উচ্ছেদ প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট বনভূমির পরিমাণ
১,৮৬,২৫৫ একর। উচ্ছেদ প্রস্তাবের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়নি এমন জবর দখলকৃত
এলাকা উদ্ধার করে বনায়ন কার্যক্রম হচ্ছে বলে বন অধিদপ্তরের রিপোর্টে বলা
আছে। এ প্রক্রিয়ায় ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত
১৬,৪০৩ একর জবরদখলকৃত জমি উদ্ধার করে বনায়ন করা হয়েছে বলে বন বিভাগ
জানিয়েছে।
আনাস ইবনে মালেক (রা:) বর্ণিত এক হাদিসে আছে “গাছ লাগাও,
চাষাবাদ কর। এটাও তোমার জন্য সাদাকা বা দান হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ তোমার
উৎপন্ন ফসল তো মানুষ বা কোন প্রাণীই খাবে।” বোখারী শরীফের আকেটি হাদিসে
লেখা রয়েছে “যদি তুমি নিশ্চিত হও যে, আগামীকাল কেয়ামত হবে তারপরও আজকে যদি
তোমার কাছে গাছের একটি বীজ থাকে, তা বপন করো আর চারা থাকলে তা রোপন করো।”
অনুরূপ মুসলিম শরীফে উল্লেখিত আছে “ফলদ বনজ ভেষজ- যে কোন গাছ লাগানো
সাদাকা। এ গাছ থেকে যত পশু, প্রাণী বা মানুষ উপকৃত হবে, তা সদকায়ে জারিয়া
হিসেবে গাছ রোপনকারীর নামে লেখা হতে থাকবে।”
ছায়াঘেরা, ঘুঘুডাকা সবুজ
শ্যামল আমাদের দেশটা আর আগের মত নেই। আমাদের দেশটাকে সবুজ শ্যামল বলা হত যে
সকল কারনে তার অন্যতম উপাদানটি হল চারিপার্শ্বে ঘন ঘন গাছ-বৃক্ষরাজি আর
সবুজের সমারোহ। বর্তমানে বাংলার সেই সবুজ শ্যামলিমা খুব কমই চোখে পড়ে। সবুজ
বৃক্ষরাজি ও ফসলি জমি অকাতরে ধংশের কারণে পাখপাখালিও পূর্বের ন্যায় দৃশ্যত
নয়। গাছপালা কেটে ফেলার কারণে পাখীদের আশ্রয়স্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। হরদম
গাছপালা কাটা হলে পাখীকুলের বংশবৃদ্ধিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে
পরিবেশবাদীরা সবসময় মনে করে। জনসংখ্যার অধিক চাপে ও ব্যাপক নগরায়নে ফসলি
জমি উজাড় করে তৈরি হচ্ছে ঘরবাড়ি ও বহুতল ভবন। হরহামেশা কাটা হচ্ছে গাছপালা
বন বৃক্ষরাজি। কেউ মানছে না নিয়মনীতি। পরিবেশ তাই-আজ হুমকির মুখে।
চতুর্দিকে ব্যাপক হারে গাছপালা ও ফসলী জমি বিলীন হতে থাকলে প্রাকৃতিক
দুর্যোগে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। খাদ্যভাব প্রকট আকার ধারন করবে। পরিবেশের
ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগানোর কোন বিকল্প নাই। আগেকার দিনে চারদিকে যে
পরিমানে গাছপালা দেখা যেত তার তিন ভাগের ১ ভাগও এখন পরিলক্ষিত হয় না।
পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের উপর বিরূপ
প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। এমনিতেই বিজ্ঞানীরা দেশ পানিতে ডুবে যাওয়ার
সতর্কবানী দিয়ে যাচ্ছেন।
আগের দিনে গ্রামাঞ্চলে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল,
পেয়ারা, সফেদা, শরীফা, আতা, লেবু, সুপারি, ডালিম, নারিকেল, কলা, আনারস হরেক
প্রজাতির ফলের উৎপাদন হত। এখন যে পরিমানে উৎপাদন হয় তা দিয়ে মানুষের
চাহিদা পূরণ হয় না। কারণ এসব গাছ এখন আর আগের মত দেখা যায় না। বিশেষ করে
শরীফা, আতা, সফেদা ও ডালিম এখনকার প্রজন্ম চিনেও না, খায়ও না। ফলবান বৃক্ষ
নিধন করে বসতি নির্মান হচ্ছে। শহরে যদিও ছাদে বাগান করার অভ্যাস কিছুটা গড়ে
উঠেছে কিন্তু বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝের আঙ্গিনা
রক্ষা করে সবুজায়নের কথা আইনে লেখা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বেপড়োয়াভাবে
গাছ কাটলে তেমন কোন প্রতিবাদও হয় না। ফলে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মিছিলে
নেমে পড়েছে অনেক অসাধুচক্র।
দিনে দিনে কমে আসছে বনভূমি। মানুষের
আগ্রাসনে ও নানাহ উন্নয়ন প্রকল্পে হারিয়ে যাচ্ছে গভীর বন, অক্সিজেন
ফ্যাক্টরি। এ অবস্থার মধ্যে ২০২০ সালে মোট ভূখন্ডের ১৭ শতাংশ বনাঞ্চল গড়ার
ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে
জাতিসংঘের একটি সনদে স্বাক্ষর করে এই ঘোষণা দেয়া হয়। বিশে^র প্রায় সমস্ত
দেশই তাতে সম্মত হয়। কিন্তু ঐ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ।
উল্টো যেটুকু সংরক্ষিত বন আছে, তাও উজাড় হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। তাই
আন্তর্জাতিক ০৬.৫.২০২৩ খ্রি: বন দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে তাল মিলয়ে
বলতে চাই, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন, যদি থাকে সমৃদ্ধ বন।”
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ