গত
প্রায় দুই সপ্তাহজুড়ে মধ্যপ্রাচ্য এক সীমিত কিন্তু ভয়ংকর যুদ্ধের সাক্ষী
হয়েছে। এ এলাকায় দশকের পর দশক সংঘর্ষ, গণহত্যা চলছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও
তার পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েলই এ সংঘাতময় এবং মানবতাবিরোধী
পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এ বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতিতে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাল ১২
জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ অন্যান্য অসংখ্য লক্ষ্যে সরাসরি ইসরায়েলের
বহুমুখী হামলা। ইরানও ধারণাতীত শক্তিতে প্রতি-আক্রমণ করেছে। পুনঃপুনঃ
ইসরায়েলি আক্রমণে ইরানকে নতি স্বীকার করাতে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র নিজেও
সরাসরি আক্রমণ করে ইসরায়েলকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে।
সঙ্গে সঙ্গে ইরানের ওপর চাপ বাড়ানোর প্রয়াস পায়। এ ব্যাপারে কয়েকটি
প্রাসঙ্গিক কথা আলোচনা করা যাক।
প্রথম কথা হচ্ছে, যুদ্ধ কেন?
যুক্তরাষ্ট্র কেন সরাসরি যুদ্ধে জড়াল? ইসরায়েল সবসময় ইরানের সঙ্গে একটা
নেতিবাচক ও সংঘাতময় সম্পর্কে ছিল। সরাসরি ইরানে হামলা করার জন্য মুখিয়ে
ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন তাদের থামিয়ে রেখেছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক শক্তির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল। এর আগে তাদের
মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছিল। যদিও ইরান বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেই চুক্তি মেনে
চলছিল, যুক্তরাষ্ট্রই কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই সেই চুক্তি বাতিল করে দেয়।
এবারের যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং যতভাবে ইরানকে
পিছিয়ে দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে ইরানের ওপর বল প্রয়োগ করা। যুক্তরাষ্ট্রের
উদ্দেশ্য হাসিলে ইরানকে রাজি করাতে না পেরে ইসরায়েলকে দিয়ে হামলার মাধ্যমে
তার ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করা হয়।
পাল্টা জবাবে ইরান যে তীব্র প্রত্যুত্তর
দিয়েছে তা ইসরায়েলের ধারণার বাইরে ছিল। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দিয়ে
ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ইরানকে নতি স্বীকার করাতে ব্যর্থ হয়। মূলত
যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিতেই ইসরায়েল সরাসরি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ
বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়। তবে ইরান ইসরায়েলকে যেভাবে পাল্টা জবাব
দিচ্ছে এটা তারা কেউ ধারণাও করতে পারেনি। ফলে ইসরায়েলকে অনেক ক্ষতির
মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেকেই তেল আবিবের ধ্বংসের চিত্রকে গাজার সঙ্গে তুলনা
করছেন। অন্যদিকে ইরানে অনেক ক্ষতি সত্ত্বেও তাদের প্রতি-আক্রমণের ক্ষমতা
বহাল রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বুঝল এভাবে তেমন একটা কাজ হচ্ছে না। তাই তারা
সরাসরি যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৩৭ ঘণ্টা উড়ে এসে ইরানের বিভিন্ন
পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা
বর্ষণ করে। তাতে যে ইরানের ক্ষতি হয়নি তা নয়। ইরানের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি
হয়েছে। তবে যে পরিমাণ ক্ষতি করবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল; মনে হয় না, সে
পরিমাণ ক্ষতি তারা করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা সূত্রের প্রাথমিক
মূল্যায়নে ক্ষতির পরিমাণ আশানুরূপ নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
ইরান আগে
থেকেই আন্দাজ করতে পেরে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক উপকরণগুলো কেন্দ্র থেকে
সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং তারা সফলও হয়েছে। প্রথমে আক্রমণের নির্দেশ
দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সবাইকে বিভ্রান্ত করতে বললেন যে, দুই সপ্তাহ
কোনোরকম আক্রমণ করবেন না। তার কথায় কেউ বিভ্রান্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। এখন
পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে ইরান যথেষ্ট প্রস্তুতি
গ্রহণ করেছিল, ফলে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি হয়েছে। আরও অনেক ক্ষতি হতে পারত বলে
ধারণা করা হয়েছিল। ইরান কীভাবে তার জবাব দেয়, সেটাও একটা দেখার বিষয় ছিল।
ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে অবস্থিত চারটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে
আক্রমণ চালিয়েছে ইরান।
যুদ্ধের কারণে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আরও
অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের ব্যাপারে যারা এ অঞ্চলের
ওপর নির্ভরশীল, তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হব।
কারণ বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ জ্বালানি হরমুজ প্রণালি দিয়ে আসে। ইরান ইতোমধ্যে
প্রণালিটি বন্ধের হুমকি দিয়েছে। সংঘাত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি তেলের
দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে আরও বাড়বে। পরিবহন খরচ আগেই বেড়েছে।
ফলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং আরও হব। অনেকেই ভাবছিলেন যে, এ
যুদ্ধটা যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা বেশি ছড়াতে দেবে না। তাদের সীমিত লক্ষ্য
অর্জন হলে বা তার কাছাকাছি কিছু অর্জন করতে পারলে তারাও থেমে যাবে।
তাছাড়া
কোনো রাষ্ট্রই চায় না যে, এ অঞ্চল বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ুক।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক কেউ যদি যুদ্ধে জড়িয়ে
পড়ে তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রও চায় না।
তারা সবকিছুই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। মূলত সীমিত তবে তীব্র আক্রমণের
মাধ্যমে চাপের মুখে ইরানকে যথাসম্ভব নতি স্বীকার করাতে চেয়েছে তারা। সবদিক
বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে যে, এ যুদ্ধ খুব বেশি দূর গড়াবে না। সে
ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগী হয়ে নিজেদের শুরু করা
যুদ্ধ থামানোর ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করেছে। বর্তমানে সব পক্ষই যুদ্ধবিরতি
পালন করছে। হেগে অনুষ্ঠিত ন্যাটো শীর্ষ বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার
যুদ্ধ শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন।
প্রতিবেশী দেশগুলো এ ব্যাপারে
খুব বেশি কথা বলছে না। জর্ডান ইসরায়েলের কাছে অনেক আগেই বিক্রি হয়েছে।
যদিও এসব দেশের সরকার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না, এদের জনমানুষ
অনেকেই ইরানের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য, এমনকি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছে। এ
যুদ্ধ বেশিদিন চললে পুরো এলাকায় স্থলযুদ্ধ শুরু হতে পারে। সেটা সহ্য করার
মতো ক্ষমতা মার্কিন-ইসরায়েল জোটের আছে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ
আছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে ঘাঁটিগুলো কাছাকাছি ছিল সেখান থেকে ইরানের
প্রতি-আক্রমণের আগেই লোকজনকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।
যুদ্ধবিরতিতে সবাই
স্বস্তি বোধ করছে। তবে ইরানি সরকার ও জনগণ বলছে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের
অনুরোধে তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। প্রয়োজনে তারা আরও যুদ্ধের জন্য
প্রস্তুত। এখন যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে সব পক্ষই পুনর্গঠন ও পুনঃপ্রস্তুতিতে
ব্যস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যেই জ্বালানি তেলের মূল্যে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা
যাচ্ছে। তাই আমাদের মতো দেশগুলো অন্তত সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত