এক.
মৃত্যুপথযাত্রীর গোপন অভিলাষ
১৯৬৭
সালের ডিসেম্বর। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট কমবাইন্ড হাসপাতালে অর্ধচেতন-অচেতন
অবস্থায় আমি। মৃত্যুর প্রহর গুনছে সবাই ডাক্তারগণ শেষ কথা বলে দিয়েছেন।
কান্নাকাতর মুখ সবার। মনের শেষ দুটি অভিপ্রায়।
একটু অস্ফুটস্বরে বললাম
জনাব খবিরউদ্দিন সাহেবকে। আমার কবরের স্থান। ছুটে গিয়ে তখনই কিনে নেন
মিউনিসিপ্যালটির কাছ থেকে। শুনে মনে শান্তি এলো।
দ্বিতীয়টি জানত মাত্র একজন।
সে কি?
আমার জানাজা যেন দেয়া হয় মডার্ন স্কুল মাঠে। আর শরিক করা হয় স্কুলের নিষ্পাপ কচিকাঁচা ছেলে-মেয়েদের, আমার প্রাণপ্রিয় যারা।
আর-
দাফনের পথে শবাধারে রক্ষিত প্রাণহীন দেহটি পাঁচ মিনিট কাল রাখা হয় স্কুলের প্রবেশ পথে।
কেন?
আমার
স্বপ্নসাধ, ভালোবাসার ধন, ইটপাটকেলের স্কুল ঘরটি, সযত্নে রোপিত তরুলতা,
হাজারো বার পদাঘাতে বিরক্ত মাটি, ধূলিকণা দেখুক আমার শেষ যাত্রা। ওরাই
থাকবে আমার ক্ষুদ্র দানের অকৃত্রিম সাক্ষী। মানুষ ভুলবে; মানুষ অকৃতজ্ঞ।
ভুলবে না প্রকৃতি। তারাই সাক্ষ্য বহন করবে চিরদিন। শেষ বিচার দিনেও।
আল্লাহ
বাঁচালেন সেবার। দুর্বল শরীর। ঘরে শোয়া। এক অভিভাবক এসে বললেন, ‘কোন
জাদুমন্ত্রে জয় করেছেন আপনি শিশুদের মন? কেজিতে পড়া শিশু বাড়ি ফিরে নামাজরত
তার মাকে বলছে-মা, মা, তুমি আমাদের সেক্রেটারি স্যারের জন্য দোয়া করো।
হাসপাতালে খুব অসুখ। স্কুলে আমরা দোয়া করেছি।’
দু’চোখ প্লাবিত হয়ে এসেছিল এ কথা শুনে। শিশুদের দোয়া-ঐ তো আমার সব পাওয়া।
নাম
চাইনি, স্মৃতি চাইনি, নিঃশেষে প্রাণ দেয়াই চেয়েছি। ঐ তো আমার পরম পাওয়া।
তৃপ্তি, সুখ। মনের গোপন আশাটি ত্যাগ করেছি ১৯৭০ সালের ২৫ মে যেদিন মিথ্যার
প্রতিষ্ঠা হলো সত্যের উপর। প্রতিবাদে হত্যার হুমকি!! তাই স্কুল থেকে নিতে
হলো বিদায়।
প্রাইমারি স্কুল-শিশুর প্রথম জ্ঞান রাজ্য, নব জন্মস্থান।
শিশুদের আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার জন্য
স্থাপন-চিল্ডরেনস হোম, মডার্ন স্কুল।
দুই.
একটা জীবন স্বপ্ন
কথার
পরিণতি কাজে। কথা আসে কল্পনা থেকে; কল্পনার জন্ম হয় অনুভূতিতে, অনুভূতির
উপলব্ধি আসে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ থেকে, সমাজ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অবস্থার
পরিপ্রেক্ষিতে।
দেশের প্রাইমারি শিক্ষা ও প্রাইমারি স্কুলের অবস্থা
দেখে শিক্ষক জীবনের প্রভাতেই একটা আদর্শ প্রাইমারি স্কুলের অভাব অনুভব করতে
শুরু করি। নিজ গ্রামে নাশির কোট প্রাইমারি ১৯১৪-১৯১৮ সালের দৃশ্যটি চোখে
ভাসছে অনুক্ষণ। কী করুণ দৃশ্য!
১৯৩২ সালে যেদিন ঢাকা ট্রেনিং কলেজে
ভর্তি হই, শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক গুরুবন্ধু ভট্টাচার্য প্রশ্ন করলেন, ‘কেন তুমি
প্রাইমারি শিক্ষা একটা বিষয় হিসেবে নিতে চাও, এ তো এ ট্রেনিং কলেজের পাঠ্য
বিষয় নয়।’ জবাব ছিল, ‘প্রাইমারি শিক্ষার সেবক হতে চাই।’
১৯৩৮-৩৯ সালে
লালা কমলাপতি সিংহানিয়া লক্ষ টাকা ব্যয়ে ভারতের যুক্ত প্রদেশে দশটি
প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ব্যাপারটা ছিল আদর্শের পথে ধনীদাতার
মনোগতির এক বিরাট ব্যতিক্রম। কেন এ প্রচেষ্টা? উত্তর সহজ। শিক্ষার ভিত্তি
প্রাইমারি শিক্ষা। ভিত মজবুত না হলে তার উপর শিক্ষা সৌধ তৈরি করা সহজ নয়।
কচি মনে ভালো বীজ আর ভালো সার না দিলে মহীরুহ তৈরি করানো শক্ত।
১৯৪৩
সালে জনশিক্ষা ডিরেক্টর মি. বটমলী নোয়াখালী বেগমগঞ্জ শিক্ষক শিক্ষণ
কেন্দ্রে প্রথম শ্রেণিতে ভাষা শিক্ষার পরীক্ষণ কাজ দেখে আমার শুধু প্রশংসাই
করলেন না, এ পরীক্ষণের একটা ভবিষ্যৎ আছে বলে আশা প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত
তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. অনাথনাথ বসুর প্রচেষ্টার কথাও আমাকে
বললেন। পরে তা জানার সুযোগ হয়েছে।
১৯৪৪-৪৭ সালে মেদিনীপুরে মহিষাদলে
কস্তুরী বাই ফান্ডের অর্থে স্থাপিত ৪০০ ছেলের আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়টি
বারবার দেখেছি। অবাক বিস্ময়ে ভেবেছি কচিকাঁচাদের মানুষ হিসেবে তৈরি করার কী
আদর্শ ব্যবস্থা!
দেখেছি সব কিছু, দৈনন্দিন পাঠক্রম থেকে শুরু করে,
প্রার্থনা, শরীরচর্চা, খাবার মেন্যুটা পর্যন্ত। তৎকালীন জাতীয় সরকারের
পরিচালিত স্কুলের কর্মসূচিও অনেকটা অনুরূপ।
জাতিকে আদর্শের পথে এগিয়ে
নিতে হলে আদর্শ স্থাপনের জন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠান ও আদর্শ শিক্ষকের প্রয়োজন
অত্যধিক-তার নজির রয়েছে দেশে দেশে। তাদের আদর্শ অনুযায়ী পরীক্ষামূলক কাজ
করলাম কয়েকটি স্কুলে তমলুকের সুতাহাটা ও মহিষাদল থানায়। স্কুল সাব-
ইন্সপেক্টর তখন। বিভাগীয় অনুমতিক্রমে এক প্রাইমারি স্কুল ভিজিট করি বছরে
চারবার আর প্রতি বারে দু'দিন। লক্ষ্য প্রথম শ্রেণির অপচয়তা রোধ, আদর্শ
বিদ্যালয় গড়া। অভিজ্ঞতার কথা লিখতে শুরু করলাম। বাংলার শিক্ষক পত্রিকায়।
ফলে প্রাইমারি শিক্ষা সম্পর্কে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য সরকার নির্বাচন
করেন। আরো গভীরভাবে জানার, বোঝার ও চিন্তা করার সুযোগ আসে ১৯৪৯-৫০ সালে
প্রাইমারি ট্রেনিং কলেজ ময়মনসিংহে। সঙ্গীয় কেজি ও প্রাইমারি স্কুলে আদর্শের
নমুনা দেখি। কিছুটা পরীক্ষামূলক কাজও করি সেখানে।
১৯৫৪-৫৫ সালে
আমেরিকার হারবার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. রবার্ট ইউলিক ও ড. অ্যান্ডারসনের
সান্নিধ্যে প্রাক ও প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে পাই এক নতুন পথের সন্ধান।
নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষা মিস কলিন্সের স্কুলে শিশু শিক্ষামূলক
গবেষণা ও শিক্ষাদানের কাজও করি। নতুন সে অভিজ্ঞতা।
(ক্রমশ:)