‘লালসালু’ ও একজন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
মোঃ আব্দুর রশিদ ।।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে ক’জন কালজয়ী লেখক আছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র নাম নিশ্চিতভাবেই তাদের প্রথম সারির কয়েকজনের মাঝে স্থান পাবে। তার লেখালেখির তালিকা দীর্ঘ নয় । তিনি মোট তিনটি উপন্যাস, দুটি গল্পগ্রন্থ, তিনটি নাটক ও কতিপয় ইংরেজী- বাংলা প্রবন্ধ লিখেছেন। সাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের ষোলশহরে ১৯২২ সালের ১৫ই আগস্টে এবং মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে, ১৯৭১ সালের ১০ই অক্টোবরে প্যারিসের মিউডনেনিজ ফ্ল্যাটে গভীর রাত্রে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চদপস্থ সরকারী কর্মচারী এবং মাতা নাসিম আরা খাতুন ছিলেন বনেদি বংশের উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। তাঁর বয়স যখন ১২ বছর (১৯৩৪ সালে) তখন তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে এবং পরবর্তীতে তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের সুবাদে তার বাল্যকাল কাটে বিমাতা ও বৈমাত্রেয় ভাই বোনদের সাথে মিলেমিশে।
বাবার সরকারি চাকরীর সুবাদে বারবার কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায়, ওয়ালীউল্লাহ’র শিক্ষা জীবন কাটে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন স্কুল কলেজে। তাঁর একাডেমিক ডিগ্রী ছিল ডিস্টিংশনসহ, বি.এ. এবং অর্থনীতি নিয়ে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি। তিনি এম. এ. পড়া শেষ না করেই পড়াশোনায় ইতি টানেন সম্ভবত চাকুরি ও হঠাৎ পিতৃবিয়োগের কারণে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কর্মজীন শুরু হয় দৈনিক “দ্যা স্টেট্স্ম্যান” পত্রিকায় চাকুরী নেয়ার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি রেডিও পাকিস্তানের বার্তা-সম্পাদক পদে, পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রনালয়ে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তথ্য পরিচালকের পদে, পাকিস্থানী দূতাবাসের দ্বিতীয় ও প্রথম সেক্রেটারীর পদমর্যাদার পদে ও সবশেষে দূতাবাসের চাকুরী থেকে চুক্তিভিত্তিক পদ “প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট” হিসেবে ইউনেস্কোতে চাকুরি করেন।
বাংলা সাহিত্যের এই গুণী লেখক ১৯৫৫ সালে তার ‘বহিপীর’ নাটকের জন্য করাচী থেকে পি. ই. এন পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ সালে উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষ আবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও ১৯৬৫ সালে তার লিখা ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের জন্য আদমজী পুরস্কার পান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার একাডেমিক ডিগ্রী, কর্মজীন এ সবকিছুরই উর্ধ্বে উঠেছেন তার লেখালেখির মাধ্যমে। তিনি বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে তার স্থায়ী আসন রচনা করেছেন তার ‘লালসালু’ উপন্যাসের মাধ্যমে। ‘লালসালু’ তার লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত ও সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। এই উপন্যাসের রচনা, প্রকাশ সবই ঢাকায়। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর তিনি চাকরি নিয়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাসের সময়ে উক্ত উপন্যাসটি লেখা। বইটি প্রথম প্রকাশ করে কমরেড পাবলিশার্স, ১৯৪৭ সালে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের পরিচয় ও স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে লেখক বলেন- অদূরে সালুকাপড়ে আবৃত মাছের পিঠেরমত মাজারটি মহাসত্যের প্রতীক স্বরূপ অটুট জমাট পাথরের মতো নীরব, নিশ্চল। আরেকস্থানে বলেন- লাল সালুর রক্তরঙিন আবরণে ঢাকা থাকে বহু বেদনা বহু বঞ্চনার কাহিনী- লেখা থাকে বহু ব্যর্থ কামনার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের নগ্ন বিধৃতি সমগ্র লাল সালুতে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের উদ্দেশ্য সম্ভবত: ধর্মের নামে ভন্ড পীরবাদের ও মাঝার পূজার স্বরূপ উন্মোচিত করা। ধর্মেরমত একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে নিয়ে উপন্যাস লেখা সহজ কাজ নয়। এতে আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে অনেক সময় মূল বৃক্ষের গাছে আচর লাগার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কৃতিত্বের দাবিদার, তিনি একজন দক্ষকারিগরের মত পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কোনো ভাবেই ধর্মের মূল বৃক্ষে আঘাত করেন নি, বরং সচেতন ভাবে শুধু ধর্মের আগাছা পরিষ্কার করতে চেয়েছেন। উল্লেখিত মন্তব্যের ভিত্তি হলো উক্ত উপন্যাসের একটি লাইন- শস্যের চেয়ে টুপি বেশী ধর্মের আগাছা বেশী।
বাঙালি মুসলিম সমাজ আজো ধর্মের আগাছা, গোড়ামী ও বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত নয়। মানুষের ধর্মবিশ্বাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেইসবের অবস্থান। একজন উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক মানুষ হয়েও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাঙালি মুসলিম সমাজের সেই দৈন্যতা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা সুনিপূনভাবে মজিদ, মাঝার, পীরসাহেব ইত্যাদি রূপকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগ বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ
বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, (বাইউস্ট) কুমিল্লা।
-------------------------------------------------------------
কবিতা----------------------------------------------------
নিবন্ধন
আফিফা জান্নাত
একটি ফুলের জন্ম, কোনো এক মূহুর্ত, চারদিক হাসি হাসি মুখ।
দিন গড়ায়, রাত গড়ায়
প্রথম ধ্বনি দিয়ে শুরু হয় মুখের বুলি।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে মধুরতা ছড়ায়, আকাক্সক্ষা বাড়ায়।
ক্রমান্বয়ে পাটখড়ি, কিছু দুষ্টু মিষ্টি স্মৃতি জমে।
প্রথম পাঠশালা... প্রথম বইয়ের ছোঁয়া।
অচেনা কিছু সহপাঠী, অচেনা পরিবেশ নিজের হয়ে ওঠা।
সেই শৈশব দুরন্ত সময়
মাঠ ঘাট ফেলে দৌড়ে বেড়ায় আহা এইতো জীবন।
বছর পেরোয়, নতুনত্বের সাথে পরিচয়।
শৈশব ছেড়ে কিশোর বয়স,
কিশোর ছেড়ে যৌবন ।
সময়ের পালাবদলে শ্রদ্ধা, দায়িত্ব, ভালোবাসার সঙ্গে পরিচয়।
কত চেনা মুখ অচেনা হয়ে যায়,
কত রঙিন স্বপ্ন ফ্যাকাশে হয়,
কত বার মন পাখি হতে চায়,
কত বার ইচ্ছে হয়, ফিরে যাই সেই শৈশবে।
এইতো এভাবেই গেছে ২০টা বছর।
দূর ভবিষ্যৎ অজানা,
তবে আশার ঘরে বাঁধ ভাঙতে নেই।
জীবন চলুক না, জীবনেরই নিয়মে।
কেমন যেন আছি
কাজী আলমগীর
মঙ্গল আর আনন্দ একই গৃহের সন্তান,
বদলাতে হবে বলে খাবি খাচ্ছি
দিশা নাই বিগতকালের হাল চাষ
বদলালে বদল হয় না পুঁজের কারণ
নিচে যারা পরে আছে তাদের আগে
বাদ দেয়া হয়েছে এখনও তারা একই বরণ
ফলহীণ বৃক্ষের ফুল ডালে আর বীজে
শুধু পোশাক বদলালে বন্ধু শুধুই পোষাক
বিগতকালের কাউয়া আজকের কাক
শ্রেফ শব্দ পাল্টালে ইতর ঠকবাজ
কথার আগে চিন্তা কিংবা অদৃশ্য দৃশ
লাভ নেই বন্ধু লাভ নেই নগজ সুমিথিয়ন
একই কথা আকন্দের কষ অথবা ধুতরার বিষ
চলে যাবার আগে পারলে সবকিছু ফিরিয়ে নিস
বুভুক্ষু মানুষের কথা বলতে এসেছি
জলিল সরকার
দলা পাকানো ভাত আর একটুকরো রুটি বুকের জমিন জুড়ে লাঙল চষে বেড়ায় রক্তাক্ত চাষ:
ক্লান্ত মন ছায়াচ্ছন্ন বিকেল বিষণ্ণ আকাশ রূপালী চাঁদ পদ্মা, মেঘনায় বয়ে যাওয়া বুভুক্ষু লাশ-রক্তাক্ত দলা পাকানো হৃদপিণ্ড খাবলে খাওয়া নগ্ন শকুন বুকের পাঁজর জুড়ে পুঁজ আর রক্তের উপাঙ্গ উন্মুখ শিকারী বাসাবোনে পরমোৎসবে-আমাদের বিবেক ছুঁয়ে নগ্নতার করাল উত্তাল ঢেউ লোহার শিকলে ম্রিয়মান দিবাকর, নষ্টগদ্য! লিখি না আমি লিখছি হা-ভাতে ক্লেশ মিশ্রিত মানুষের অপাঙেক্তয় অধ্যায় আকাশ হতে খসে পড়া নক্ষত্রের সাথে কথা বলে বৃষ্টিস্নাত রাতের সঙে কথা বলে উত্তর মেলেনা আমার আমি কেবলই উষ্ণ অধীর চিত্তে চাঁদ ছুঁয়েছি গোমতির জলে, তবুও খুঁজি না ঈশ্বর! খুঁজি মানুষ, মানুষের মাঝে দেখেছি নিরঞ্জন ক্ষুধাক্লেশিত মুখ আমায় খোঁজে;
খোঁজে দু'মুঠো অন্ন আর রক্ত আর ঘামে খুঁজে না পৃথিবীর রূপ, আমি বুভুক্ষু মানুষের কথা বলছি লোহার শিকলে চষে যাওয়া নগর সভ্যতায় তৃষ্ণার্ত বক চষে বেড়ায় অরণ্য আকাশ হিমাদ্রির বুক, নাইজেরিয়ার পথে চলেছি আমরা জীর্ণশীর্ণ ক্লান্তদেহে ক্ষুধাক্লেশিত অবয়বগুলি পাংশুর মতো রজনী ছুঁয়ে যায় ক্ষুধাতাড়িত নৈঃশব্দ্যিক ক্ষণকাল মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মতো।
আকাশ মাটি বিদীর্ণ রক্তের স্রোতে, তবুও থামবে না ভূখা মানুষের অভিশপ্ত নগরীর মিছিল।
নৈঃশব্দের সংকেত
মশিউর রহমান রিপন
মহাকালে
তুমি, আমি, শব্দ, জন্ম, নাম
কেউ না।
যেমন নেই কোনো উচ্চারণ সূর্যডোবার আগে,
যেমন গর্ভাশয়ে শিশু শুধু সম্ভাবনা,
তেমনি আমরা
ব্যাখ্যাতীত
অথচ অনুপস্থিতিরও আগে।
এই যে ছায়া,
এই যে স্পন্দনের অভাবে কেঁপে ওঠা তন্ত্র,
এই যে অনস্তিত্বের গায়ে
সময়ের জমে থাকা নুড়িপাথর
সবই অজর, অথচ বিলীন।
আমরা একে অপরের দিকে তাকাইনি কখনো।
তাকিয়েছিল
স্মৃতির অবচেতন সীমানায় ছুঁয়ে থাকা
কিছু পর্দাহীন রূপরেখা।
সেখানে স্পর্শ নেই, শব্দ নেই,
আছে শুধু
‘থাকার আগে’ এক গভীর প্রস্তুতি।
ভাষা আমাদের ছুঁতে পারেনি।
ভাষা থেমে গেছে
তুমি আর আমি-র মাঝখানে যে অন্ধকার রেখা,
সেখানে।
শব্দেরও বয়স ফুরোয়
তবু শূন্যতা চিরকালীন।
তুমি যদি বলো
“আমরা কিছু ছিলাম,”
আমি বলব
আমরা শুধু সম্ভাবনার ছায়া ছিলাম,
যা কোনো দিন নিজের মুখ দেখেনি।
তুমি যদি চুপ থাকো
আমি বলব,
এই চুপটাই সবচেয়ে সত্য,
যা সময় ও মহাশূন্যের ভাষায় লেখা
প্রথম কবিতা।
অত্যাচারিত শহর-
আলমগীর কবির
আমি তাকে ভোগান্তির শহর বলবো না,
আমি তাকে অত্যাচারিত শহর বলবো...
ধুলোয় ঢাকা, ক্লান্ত মুখ,
স্বপ্ন জাগায় তবু রক্তচোখ।
নেই বাতাস, নেই আলো,
আকাশটাও কেমন কালোৃ
দশ মিনিটের পথ পেরোই না ঘন্টায়,
এই কি তবে স্বাধীনতা শহরবাসায়?
জ্যাম তো শুধু লোহার না—
মানুষের ধৈর্য, ঘামের রেখা,
জ্বলে উঠে ক্ল্যাক্সনেৃ
নীরব চিৎকারে মুখ ঢাকা!
ওহ শহর, তুমি ক্লান্ত, তুমি রুদ্ধ,
তবু তোমার বুকেই স্বপ্ন গাঁথা থাকে চিরচূড়ান্ত।
আমরা চাই আলো, চাই বাঁচার পথ,
এই শহর হোক জ্যামমুক্ত, দমবন্ধ নয় শান্ত।
রাস্তা আমার অধিকার—
কেন সে হয়ে উঠে বন্দুকের চেয়ে ভয়ঙ্কর?
কেন স্কুলে যেতে শিশু কাঁদে,
কেন অ্যাম্বুলেন্স থেমে পড়ে রাস্তায়?
প্ল্যানবিহীন নির্মাণ, দখলদার রাজনীতি,
ফুটপাত কেড়ে নেয় স্বপ্ন আর গতি।
এই শহর কি শুধু গডফাদারদের হাতে?
না! শহরটা আমার, তোমার, নাগরিকের হাতে!
এই শহরকে আবার চাই হাসতে,
সব পথ যেন মানুষ হেঁটে যেতে পারে ভাসতে।
এই শহর শুধুই ভোগান্তি নয়,
সাহসী কণ্ঠে আমরা বলি-
এটা আমাদের শহর, আমরাই গড়ি!