
একজন
রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যু কেবল রাজনীতির পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ থাকে না; তার
প্রতিধ্বনি শোনা যায় সমাজের প্রতিটি স্তরে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে তেমনই এক নীরব অথচ গভীর শোক নেমে
এসেছে বাংলাদেশের ক্রীড়া অঙ্গনে। মাঠে গ্যালারির উচ্ছ্বাস থেমে না গেলেও,
ক্রীড়াঙ্গনের মননে জমেছে এক ধরনের শূন্যতা যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে
রূপ নেবে।
খালেদা জিয়া সরাসরি ক্রীড়া প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
তবুও তার শাসনামল ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়া অগ্রযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ
সময়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে বাংলাদেশের পরিচিতি বিস্তারে, অবকাঠামো
উন্নয়নে এবং ক্রীড়াবিদদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সময়ের ভূমিকা
অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়ার পেছনে যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তার একাংশ গড়ে
উঠেছিল সেই সময়েই।
তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, বাংলাদেশ ফুটবল
ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ফেডারেশনের শোকবার্তা কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং তা
ক্রীড়া অঙ্গনের একটি সম্মিলিত অনুভূতির প্রকাশ। মাঠে এক মিনিট নীরবতা, কালো
ব্যাজ ধারণ কিংবা শোকসভা এসব আয়োজন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ক্রীড়া কখনো
সমাজ ও রাষ্ট্রের বাইরে নয়। রাজনীতির পরিবর্তনের ঢেউ ক্রীড়াঙ্গনকেও স্পর্শ
করে, কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো নীরবে।
ক্রীড়াঙ্গনের প্রবীণ সংগঠক ও
বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়ার সময়কালে ক্রীড়াকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে
দেখার প্রবণতা জোরদার হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন, বিদেশ সফর কিংবা
ক্রীড়াবিদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এসবের মধ্য দিয়ে ক্রীড়া ধীরে ধীরে
বিনোদনের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে পরিণত হয়। এই বাস্তবতা আজকের
ক্রীড়া কাঠামোর অনেক জায়গাতেই দৃশ্যমান।
খেলোয়াড়দের শোক প্রকাশও বিশেষ
তাৎপর্য বহন করে। অনেকেই তাকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্রের এক
সময়ের অভিভাবক হিসেবে স্মরণ করেছেন। এটি প্রমাণ করে, ক্রীড়াঙ্গন রাজনৈতিক
মতাদর্শে বিভক্ত নয়; বরং ইতিহাস ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
ক্রীড়া
সম্পাদকীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু আমাদের
ক্রীড়াঙ্গনকে নতুন করে ভাবতে শেখায় রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ক্রীড়ার পারস্পরিক
সম্পর্ক নিয়ে। ক্রীড়া কেবল ম্যাচ জেতা হারার গল্প নয়; এটি রাষ্ট্রের
ভাবমূর্তি, সামাজিক ঐক্য ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অংশ।
আজ যখন
ক্রীড়াঙ্গনে শোকের আবহ, তখন এটিই উপলব্ধির সময় একজন রাষ্ট্রনায়কের অবদান
মাঠের বাইরেও দীর্ঘ ছায়া ফেলে যায়। খালেদা জিয়ার প্রয়াণ সেই বাস্তবতারই
নীরব স্মারক। ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে তার নাম থাকবে একটি সময়ের প্রতিনিধি
হিসেবে, যেখানে রাজনীতি ও ক্রীড়া একই রাষ্ট্রীয় স্রোতে প্রবাহিত হয়েছিল।
খালেদা
জিয়ার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এক
শোকবার্তায় জানায়, “দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রভাবশালী
রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড গভীর শোক প্রকাশ করছে। তার
আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা
জানাচ্ছি।”
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) পৃথক শোকবার্তায় উল্লেখ করে,
“বেগম
খালেদা জিয়ার মৃত্যু জাতির জন্য এক গভীর ক্ষতি। তার শাসনামলে দেশের
ক্রীড়াঙ্গনে যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজও স্মরণীয়। ফুটবল পরিবার তার
মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত।”
এছাড়া বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন, বাংলাদেশ
ভলিবল ফেডারেশন, হ্যান্ডবল ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থা
আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করে। অনেক ফেডারেশন ও ক্লাব তাদের চলমান ম্যাচ ও
অনুশীলনের আগে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং কালো ব্যাজ ধারণ করে মরহুমার
প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটার ও ফুটবলাররাও
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করেন। তারা বেগম খালেদা জিয়াকে একজন দৃঢ়
নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তার আত্মার শান্তি কামনা করেন।
ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষকেরা বলেন, তার সময়েই ক্রীড়াঙ্গনে আন্তর্জাতিক
যোগাযোগ ও অংশগ্রহণের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়।
এদিকে, বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া
সংস্থা ও ক্রীড়া ক্লাব দোয়া মাহফিল ও শোকসভা আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানে
বক্তারা বলেন, রাজনীতির পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন সংস্কৃতি ও
ক্রীড়াবান্ধব এক রাষ্ট্রনায়ক। তার মৃত্যুতে দেশের ক্রীড়া অঙ্গন একজন
শুভানুধ্যায়ী অভিভাবককে হারালো।
সব মিলিয়ে, বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু
শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, ক্রীড়া অঙ্গনেও এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি
করেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ তার অবদান স্মরণ
করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। এই শোক জাতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের
সমাপ্তির প্রতিফলন হয়ে থাকবে।