বুধবার ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
১৭ পৌষ ১৪৩২
নিভে যাওয়া নক্ষত্র কিংবা রাজনীতির ‘ফিনিক্স পাখি’
কবীর আলমগীর
প্রকাশ: বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১:১৪ এএম আপডেট: ৩১.১২.২০২৫ ১:৩৭ এএম |


৩০ ডিসেম্বর ২০২৫। এ দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি নিভে গেল। কনকনে শীতের সকালে যখন খবরটি ছড়িয়ে পড়ল, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন এবং কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার ভরসাস্থল খালেদা জিয়া আর নেই, তখন সমগ্র বাংলাদেশ যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। 
৮০ বছর বয়সে তাঁর এই মহাপ্রয়াণ একটি যুগের সমাপ্তি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির সেই ‘ফিনিক্স পাখি’, যিনি ধ্বংসস্তূপ থেকে বারবার উঠে দাঁড়িয়েছেন, স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেছেন এবং গণতন্ত্রের জন্য ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন।
ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যখন বেগম খালেদা জিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তাঁর শিয়রে ছিলেন বড় সন্তান তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা। লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা, এবং হৃদরোগের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে তিনি হার মানলেন নিয়তির কাছে। কিন্তু এই পরাজয় কেবল শরীরের; রাজনীতিতে তার যে ছায়া-কায়া তা মৃত্যুঞ্জয়ী। আজ যখন জাতি শোকে মুহ্যমান, তখন আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সেই ১৯৪৫ সালের দিনাজপুরের শান্ত মেয়েটির দিকে, যিনি একদিন হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী সরকারপ্রধান।
বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালে। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফেনীর ফুলগাজীতে, তবে বাবার কর্মস্থলের সুবাদে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে উত্তরবঙ্গের শান্ত পরিবেশে। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার এবং মা তৈয়বা মজুমদারের আদরের এই মেয়েটি ছোটবেলায় ছিলেন অত্যন্ত লাজুক ও অন্তর্মুখী। রাজনীতির উত্তাল হাওয়া তখনো তাঁর জীবনে লাগেনি। ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
বিয়ের পর তিনি সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে জীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। স্বামী জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রামে ‘উই রিভোল্ট’ বলে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তখন খালেদা জিয়া দুই শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে ঢাকায় আটকা পড়েন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে আটক করে এবং দীর্ঘ নয় মাস তিনি ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি থাকেন।
এই বন্দিজীবন ছিল তাঁর জীবনের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা। সেই অল্প বয়সে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে, শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় দুই সন্তানকে আগলে রাখার যে মানসিক দৃঢ়তা তিনি দেখিয়েছিলেন, সেটি পরবর্তীকালে তাঁকে ‘আপসহীন’ নেত্রী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। 
১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমান যখন সেনাপ্রধান এবং পরে রাষ্ট্রপতি হলেন, তখনও খালেদা জিয়া ছিলেন পর্দার আড়ালে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা যেত স্বামীর পাশে এক ধ্রুপদী বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে পরিমিত সাজ, স্বল্পভাষী এবং বিনয়ী। জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখনও খালেদা জিয়া দলের নীতিনির্ধারণী কোনো ভূমিকায় ছিলেন না। তিনি ছিলেন শুধুই ‘ফার্স্ট লেডি’, যিনি স্বামীর ছায়াসঙ্গী।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ষড়যন্ত্রমূলক সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে বেগম খালেদা জিয়ার জগত ওলটপালট হয়ে যায়। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। তাঁর কাঁধে তখন দুই এতিম সন্তান এবং একটি ছন্নছাড়া রাজনৈতিক দল, এলোমেলো সংসার। বিএনপির অনেক বাঘা বাঘা নেতা তখন দিগভ্রান্ত; কেউ কেউ ক্ষমতার লোভে দলত্যাগের পাঁয়তারা করছেন। দলের প্রবীণ নেতা বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ ও বৃদ্ধ। এমন ক্রান্তিলগ্নে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ছুটে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার কাছে। তাঁরা জানতেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাঁর পরিবারের কাউকেই হাল ধরতে হবে।  
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। এটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত। গৃহকোণের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে তিনি নামলেন রাজপথের ধুলোবালিতে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করলেন, তখন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের আসল পরীক্ষা শুরু হলো।
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ এই নয়টি বছর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় এবং একইসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের স্বর্ণযুগ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা তাঁকে সাধারণ রাজনীতিক থেকে দেশনেত্রীতে পরিণত করে। এরশাদ সরকার বিভিন্ন সময় নির্বাচনের টোপ দিয়ে বিরোধী দলগুলোকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অনেক দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু খালেদা জিয়া ছিলেন অনড়। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। 
১৯৮৬ সালের নির্বাচন ছিল প্রহসনমূলক, এবং যারা তাতে অংশ নিয়েছিল, তারা এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনকে দীর্ঘায়িত করার সুযোগ করে দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার এই একক ও সাহসী সিদ্ধান্ত তাঁকে জনগণের কাছে ‘আপসহীন নেত্রী’ (টহপড়সঢ়ৎড়সরংরহম খবধফবৎ) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে । তিনি আপস করেননি ক্ষমতার লোভে, তিনি আপস করেননি নীতির প্রশ্নে। এরশাদ সরকার খালেদা জিয়াকে কতটা ভয় পেত, তার প্রমাণ মেলে ১৯৮৭ সালে। নভেম্বরে হোটেল পূর্বাণীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায় এবং সেখান থেকে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাঁকে বারবার তাঁর সেনানিবাসের বাসভবনে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু গৃহবন্দি থেকেও তিনি আন্দোলনের নির্দেশ দিয়ে গেছেন। বাসভবনের সামনে কড়া পুলিশি পাহারা, কাঁটাতারের বেড়া কোনোকিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি।  
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্ররা যখন রাজপথে নেমে আসে, তখন তাদের প্রধান স্লোগান ছিল এরশাদের পদত্যাগ। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আন্দোলনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিএনপির ৭ দলীয় জোট একাত্মতা ঘোষণা করে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এই বিজয় ছিল মূলত খালেদা জিয়ার আপসহীন অবস্থানের বিজয়।  
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাইলফলক। অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং গোয়েন্দা সংস্থা ধারণা করেছিল যে, সুসংগঠিত এবং পুরোনো দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সহজেই জয়লাভ করবে। কিন্তু ফলাফল সবাইকে চমকে দেয়। বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।  
বেগম খালেদা জিয়া নিজে পাঁচটি আসনে (বগুড়া-৭, ঢাকা-৫, ঢাকা-৯, ফেনী-১, চট্টগ্রাম-৮) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সবকটিতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। এটি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার এক অনন্য নজির। ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ক্ষমতায় আসার পর তাঁর প্রথম বড় কাজ ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া। বিএনপি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার পক্ষে থাকলেও, খালেদা জিয়া জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে দ্বাদশ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা পাস করান। ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালে পাস হওয়া এই সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কমিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ফিরে আসেন। এটি ছিল তাঁর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলের (১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬) সবচেয়ে বৈপ্লবিক এবং সুদূরপ্রসারী সাফল্য হলো নারী শিক্ষার প্রসার। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি জাতিকে উন্নত করতে হলে তার অর্ধেক জনসংখ্যা অর্থাৎ নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। ১৯৯৪ সালে তাঁর সরকার দেশব্যাপী মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পটি ছিল গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের হাতিয়ার। এই প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ এলাকার মাধ্যমিক পর্যায়ের (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি) ছাত্রীদের মাসিক উপবৃত্তি প্রদান করা হতো। এর সাথে তিনটি কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল পরীক্ষায় কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ নম্বর পেতে হবে, স্কুলে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে, এসএসসি পরীক্ষার আগে বিয়ে করা যাবে না। 
এই ‘বিয়ে না করার’ শর্তটি ছিল বাল্যবিবাহ রোধে এক জাদুকরী পদক্ষেপ। এর ফলে দরিদ্র পিতা-মাতারা মেয়েদের বোঝা না ভেবে সম্পদ ভাবতে শুরু করেন। যে মেয়েটিকে আগে ১২-১৩ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হতো, উপবৃত্তির টাকার আশায় তাকে অন্তত ১৬-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত স্কুলে রাখা নিশ্চিত হয়।বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, এই প্রকল্পের ফলে মাধ্যমিক স্কুলে মেয়েদের ভর্তির হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
১৯৯৩ সালে যেখানে মাধ্যমিকে মেয়েদের পাসের হার ছিল মাত্র ৩০.১১ শতাংশ, ১৯৯৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১.৫৮ শতাংশে।  এই উদ্যোগের ফলে কেবল শিক্ষার হার বাড়েনি, বরং তৈরি হয়েছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত নারী, যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, এনজিও এবং সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। আজ যে নারী ক্ষমতায়নের গল্প আমরা বিশ্বমঞ্চে বলি, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার সরকারই বাংলাদেশে আধুনিক অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা করে। তাঁর অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে ‘মূল্য সংযোজন কর’ (ঠঅঞ) প্রবর্তন করা হয়। শুরুতে ব্যবসায়ীদের তীব্র বিরোধিতা থাকলেও, পরবর্তীতে এটিই বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎসে পরিণত হয়। তাঁর সময়েই বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব আয়ের ওপর দাঁড়াতে শুরু করে। ২০০২-২০০৬ মেয়াদে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে ছিল।  
বেগম খালেদা জিয়ার আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল টেলিযোগাযোগ খাতের একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটানো। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ছিল বিত্তবানদের বিলাসদ্রব্য। তৎকালীন বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের মালিকানাধীন ‘সিটিসেল’ ছিল একমাত্র অপারেটর এবং কল রেট ছিল আকাশচুম্বী। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকার এই মনোপলি ভাঙার উদ্যোগ নেয় এবং গ্রামীণফোনসহ অন্যান্য অপারেটরকে লাইসেন্স প্রদান করে। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হয় এবং মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। আজ যে রিকশাচালক বা কৃষকের হাতে মোবাইল ফোন দেখি, তার সূচনা হয়েছিল খালেদা জিয়ার এই সাহসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। তিনি চেয়েছিলেন প্রযুক্তির সুবিধা যেন কেবল ধনীদের কুক্ষিগত না থাকে।
২০০১ সালের নির্বাচনে ৪ দলীয় জোট নিয়ে তিনি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। কিন্তু ২০০৬ সালে তাঁর মেয়াদের শেষে আবার রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়, যা ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথ প্রশস্ত করে। এই সময় তাঁকে এবং তাঁর দুই পুত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংসদ ভবন এলাকায় সাব-জেলে বন্দি থাকার সময়ও তিনি ছিলেন অবিচল। তাকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এই দেশই আমার সব।’
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পাতানো নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের আরেকটি বড় সিদ্ধান্ত। তিনি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় ছিলেন। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বা গণতন্ত্রের অভিযাত্রার ডাক দেন। কিন্তু সরকার তাঁর গুলশানের বাসভবনের সামনে বালুর ট্রাক এবং ইটের স্তূপ রেখে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে। বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে তিনি সেদিন ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি শুধু বন্দি নই, সারাদেশই আজ কারাগারে পরিণত হয়েছে।’
২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি। খালেদা জিয়া তখনো গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। মালয়েশিয়া থেকে খবর এলো তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন। যে ছেলেটিকে তিনি ১৯৭১ সালে জেলে কোলে নিয়ে ঘুরতেন, সেই ছেলের মৃত্যুসংবাদ তাঁকে শোকে কাতর করে তোলে। ২৭ জানুয়ারি কোকোর কফিন যখন গুলশানের কার্যালয়ে আনা হলো, তখন আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলের নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই অশ্রুসিক্ত ছবি সারা দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছিল। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার। তাঁকে রাখা হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে তিনি ছিলেন একমাত্র বন্দি। স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল, ইঁদুর আর ছারপোকার উপদ্রব এমন অমানবিক পরিবেশে ৭৩ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দিন কাটত। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছে যে, কারাগারে তাঁকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি এবং ‘স্লো পয়জনিং’ বা ধীরলয়ে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তাঁর লিভার সিরোসিস, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং আর্থ্রাইটিসের সমস্যা কারাগারে থাকাকালেই ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
২০২০ সালে করোনার সময় শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও খালেদা জিয়া ছিলেন কার্যত গৃহবন্দি। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পতন হয়। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি মুক্তি পান, কিন্তু ততদিনে তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছে। বিদেশে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবশেষে ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫-এ তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রেখে গেলেন কোটি কোটি ভক্ত, অনুসারী এবং এক বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতা।
মোট কথা বেগম খালেদা জিয়া কেবল একটি নাম নয়, তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু দেশপ্রেম ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে তাঁর ত্যাগকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংকট উত্তরণে খালেদা জিয়ার অবদান ও তার রাজনৈতিক বৈচিত্র্য দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। 
সামরিক শাসনের পরবর্তী অনিশ্চিত সময়ে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, তা শুধু ক্ষমতায় আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, বহুদলীয় রাজনীতির বিকাশে তাঁর ভূমিকা অনন্য। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ একটি গভীর গণতান্ত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। স্বৈরশাসন পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় আস্থার ঘাটতি, প্রশাসনিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক বিভক্তি ছিল প্রকট। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন ছিল তাঁর নেতৃত্বের একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যা নির্বাহী ক্ষমতাকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ করে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে। গণতান্ত্রিক সংকট উত্তরণে তাঁর আরেকটি বড় অবদান, নিরপেক্ষ নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রশ্নটি রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে আনা। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিকে ঘিরে যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেখানে খালেদা জিয়া ও বিএনপি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যদিও এই প্রক্রিয়া ছিল সংঘাতপূর্ণ ও বিতর্কিত, তবুও শেষ পর্যন্ত একটি প্রাতিষ্ঠানিক সমাধানের দিকে রাজনীতিকে ঠেলে দেয়, যা পরবর্তী সময়ে কয়েকটি নির্বাচনকে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে সহায়ক হয়।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বোঝা যায় তার আদর্শিক অবস্থান ও কৌশলগত বাস্তবতার সমন্বয়ে। তিনি একদিকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক, যেখানে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নগুলো গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংকট উত্তরণে একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার অনন্য প্রতীক। কেননা সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক মুক্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক লক্ষ্য।












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
‘আপসহীন নেত্রী’ খালেদা জিয়ার জীবনাবসান
নিভে যাওয়া নক্ষত্র কিংবা রাজনীতির ‘ফিনিক্স পাখি’
অধিকার সুরক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি
‘নট আউট’ খালেদা জিয়া
তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও একদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লার ১১টি আসনে১১৪টি মনোনয়নপত্র দাখিল
কুমিল্লার সবক’টি আসনেই বিএনপি জিতবে: সুমন
মনোনয়নপত্র দাখিল ইয়াছিনের প্রতীক চেয়েছেন হাঁস
হাসনাত আব্দুল্লাহর জন্য আসন ছেড়ে দিয়ে কাঁদলেন জামায়াতের প্রার্থী
বিএনপি থেকে পিতা-পুত্রের মনোনয়ন দাখিল
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২