
ধর্ষণ, হত্যা ও নিপীড়নের মতো সহিংস ঘটনার কারণে শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০২৫’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৯ মাসে রাজধানীতে নানা অপরাধ ও দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুর সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৬। গত রবিবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গত ৯ মাসে ১ হাজার ৮৬৭টি নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১৭০টি) সংবাদ শিশু ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা যৌন ও জীবন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম ঝুঁকি নির্দেশ করে এবং শিশুদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধের ভয়াবহতা তুলে ধরে। এ সময়ে ২৯৮টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর ওপর। এ হার তদারকির অভাবে অনিরাপদ পরিবেশের শিশুর বেড়ে ওঠার ঘটনাকে নির্দেশ করে। ৫৬টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে শিশুর স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত নানা বৈষম্য নিয়ে। শিশু নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে ২৪টি প্রতিবেদনে, যা পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতার ভয়াল চিত্র উপস্থাপন করছে। ২০টি প্রতিবেদনে শিশুদের ওপর রাজনৈতিক সহিংসতার প্রভাব নিয়ে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় রাজনৈতিক সংঘাতে শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বিভাগওয়ারি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে অপরাধ ও দুর্ঘটনার হার অন্যান্য বিভাগের তুলনায় অনেক বেশি। গত ৯ মাসে ঢাকা বিভাগে আহত শিশুর সংখ্যা ২৮৪ এবং নিহত শিশুর সংখ্যা ২৯৮। নানা অপরাধ ও দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৬। শিশু ধর্ষণের বিপরীতে আইনি পদক্ষেপ সংক্রান্ত উদ্যোগের হার ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ হার নির্দেশ করে যে, আইনি পদক্ষেপগুলো এখনো প্রতিক্রিয়াশীল পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, প্রতিরোধ ও ভুক্তভোগীদের সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবারই যেখানে শিশুর প্রথম আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা, সেখানে বহু শিশু পরিবারেই নির্যাতিত হচ্ছে। শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় সমাজের নীরবতা ভাঙতে হবে। শিশু অধিকার সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ দৃশ্যমান হলেও কার্যকর সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। রাষ্ট্রকে হতে হবে সমন্বিত ও নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। আগামী সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন। শিশুরা কেবল অপরাধের শিকার নয়, তারা সহিংসতা, বৈষম্য, মনোসামাজিক চাপ ও কাঠামোগত সুরক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার সম্মিলিত আঘাতে বিপর্যস্ত। এ অবস্থার উত্তরণে রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে। শিশু অধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের শিশুরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকে শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশুবান্ধব বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরাই আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ, সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে বৈষম্য ও ঝুঁকি আরও বাড়বে। শিশুদের সহিংসতা, শোষণ, নির্যাতন, অবহেলা থেকে নিরাপদ রাখাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
