তানভীর দিপু:
সাইকেল
নিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়ে আরোহন! শুনলেই, অসম্ভব মনে হয়!
পাথুরে বরফে ঢাকা দুর্গম পথে যেখানে পায়ে হাঁটা অসম্ভব- সেখানে সাথে করে
দুই চাকার সাইকেল নিয়ে চলা; আসলেই অনেকটা অসম্ভব! সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে
দেখিয়েছেন কুমিল্লার সাইক্লিস্ট আরিফুর রহমান উজ্জল। বাই সাইকেল সাথে
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা নেপালের হিমালয়ের তিনটি বিপজ্জনক সার্কিট
ট্র্যাকে সফল অভিযাত্রা সম্পন্ন করেছেন তিনি, উড়িয়েছেন বাংলাদেশের লাল সবুজ
পতাকা। ভুপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৩৯০ ফুট উচ্চতায় মানাসলু সার্কিট ট্র্যাক
একই সাথে লারকে পাস, ১৭ হাজার ৭৬৯ ফুট উচ্চতায় অন্নপূর্ণা সার্কিট
ট্র্যাকে একই সাথে থরংলা পাস ও তিলিচো লেক এবং সর্বশেষ সারা বিশে^র
পরিচিত মাউন্ট এভারেস্ট বেজক্যাম্পের থ্রি পাস প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার ফুট
উচ্চতায় কংমা লা পাস, চো লা পাস, রেঞ্জন লা পাস এবং এভারেস্ট বেজক্যাম্প
অতিক্রম করেছেন বাই সাইকেলে।
জানা মতে, এখনো পর্যন্ত হিমালয়ের বুকে এত
দীর্ঘ ও বিপজ্জনকপথ বাই সাইকেলে অতিক্রম করা পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি
আরিফুর রহমান উজ্জল। দুই মাসেরও কম সময়ের এই অভিযাত্রা শেষে গত ১ নভেম্বর
আরিফুর রহমান উজ্জল বাড়ির পথ ধরেছেন। হিমালয় থেকে নামতে শুরু করেছেন সমতলে।
তার এই অভিযাত্রার অফিশিয়াল নাম: দুরন্ত হিমালয়ান এক্সপিডিশন।
এর
মাঝে নেপাল থেকে মুঠোফোনে আরিফুর রহমান উজ্জল জানান, আলহামদুলিল্লাহ অনেক
কষ্ট ও পরিশ্রমের পর তিন বছরের স্বপ্ন সার্থক হলো। পদে পদে মৃত্যুও ঝুঁকি
নিয়েই শেষ হলো সাইকেলে আমার হিমালয় যাত্রা। এখনও সবকিছু স্বপ্নের মতো
লাগছে। আমি পেরেছি এটাই ভাবতে আশ্চর্য লাগবে,কিভাবে পেরেছি সেটা ভেবেও। এই
স্বপ্ন পূরন করতে আমাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। জীবনে এর চেয়ে বড়
স্বপ্ন দেখা হয়তো আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না।
আরিফুর
রহমান উজ্জ্বল একজন বাংলাদেশী সাইক্লিষ্ট ও মাইন্টেন ট্রেকার; তার বাড়ি
কুমিল্লা সদর উপজেলার দক্ষিণ দূর্গাপুর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডে। তার বাবা
কুমিল্লা মডার্ন স্কুলের সাবেক শিক্ষক ছাদেকুর রহমান, বর্তমানে তিনি
আমেরিকা প্রবাসী। আরিফুর রহমান উজ্জ্বল কুমিল্লা জিলা স্কুল ও কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিবাহিত এবং দুই
সন্তানের জনক।
আরিফুর রহমান উজ্জ্বলের বন্ধু ফাহামিদা রহমান তৃষা
ফেসবুকে জানান, উজ্জ্বল একজন বাংলাদেশী সাইক্লিষ্ট ও মাইন্টেন ট্রেকার।
ইতিহাস এবং পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে
সাইকেল নিয়ে পাড়ি দিলেন একই ট্রিপে নেপালিয়ান হিমালয়ের তিন তিনটি দূর্ধষ
ট্্র্যাক। সেগুলো হচ্ছে মানাসলু সার্কিট ট্রেক সাথে লারকে পাস,অন্নপূর্ণা
সার্কিট ট্রেক সাথে থরংলা পাস ও তিলিচো লেক এবং সর্বশেষ সকলের পরিচিত
এভারেস্ট বেজক্যাম্পের সাথে এভারেস্ট থ্রিপাস। সুতরাং এটিকে হিমালয়ে সাইকেল
নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা ট্রিপ বলা যেতেই পারে। চ্যালেঞ্জিং এই
এক্সপিডিশনে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে হিমালয়ের পাঁচটি বড় হাইপাস থেকে শুধু করে
ছোট ছোট আরো কিছু হাইপাস। ছিলো কাদামাখা পাথুরে পথ,অতি উচ্চতা,অক্সিজেন
স্বল্পতা,ল্যান্ডস্লাইড, বরফে ঢাকা পথ, একদম খাড়া টানা একেকবার ৩/৪
কিলোমিটার রাস্তা। অক্সিজেন স্বল্পতার কারনে রাতে না ঘুমিয়ে পরদিন ট্্র্যাক
করতে হয়েছে। বরফ ও রৌদ্রের তাপ,জ্বর,হাতে ফ্রষ্টবাইট, পায়ে মাসাল
ক্র্যাম্প ও মাথার উপর প্রচন্ড বৃষ্টি,বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে তাকে একেকটা
হাইপাস পার হতে হয়েছে।অনেক মাইন্টেইনাররা একে বড় পাগলামি হিসেবে আখ্যা
দিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, এটা শুধুমাত্র সাইক্লিং ট্রিপ ছিলো এই কথাটা
ভুল, মূলত এই এক্সপিডিশন ছিলো সাইক্লিং এবং ট্র্যাকিংয়ের কম্বিনেশন। নিজের
সক্ষমতা যাচাইয়ের অভিযান। কখনো তাকে সাইকেল চালাতে হয়েছে,কখনো কাঁধে বইতে
হয়েছে আর কখনো বা ঠেলে উপরে তুলতে হয়েছে।মূলকথা ট্রেকে ওনার ভূমিকা ছিলো
একেধারে সাইক্লিং, ট্রেকার ও পোর্টার। এই তিনটি সার্কিট সম্পন্ন করতে তিনি
সময় নিয়েছেন দুই মাসের অনেক কম।
অভিযাত্রা শেষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
আরিফুর রহমান উজ্জ্বল জানান, দুইমাসের এই অভিযাত্রায় আমি সম্পন্ন করেছি
হিমালয়ের তিনটি ট্রেক।সেগুলো হচ্ছে মানাসলু সার্কিট ট্রেক সাথে লারকে
পাস,অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেক সাথে থরংলা পাস ও তিলিচো লেক এবং সর্বশেষ
সকলের পরিচিত এভারেস্ট এভারেস্ট বেজক্যাম্পের সাথে থ্রি পাস।
গধহধংষঁ
ঈরৎপঁরঃ ঃৎবশ : মানাসলু সার্কিট ট্রেকের সর্বোচ্চ পয়েন্টে "খধৎশব খধ চধংং"
যার উচ্চতা ১৭৩৯০ ফিট।এই ট্রেকের দৈর্ঘ্য ১৭৪ কিলোমিটার। রাস্তায় ১১ দিনে
আমাকেসময় ব্যয় করতে হয়েছে ৮১ ঘন্টা।
অহহধঢ়ঁৎহধ পরৎপঁরঃ ঃৎবশ:
অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকের সর্বোচ্চ পয়েন্টে "ঞযড়ৎড়হম খধ চধংং" যার
উচ্চতা ১৭৭৬৯ ফিট (পৃথিবীর সর্বোচ্চ ট্রেকিং পাস)।এই ট্রেকে আরো ছিলো
তিলিচো লেক (পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম লেক)। এই ট্রেকের দৈর্ঘ্য ৩০৫
কিলোমিটার।সাইক্লিংয়ের জন্য নেপালের বেষ্ট ট্রেইল বলা যেতে পারে এটাকে। এই
ট্রেক শেষ করতে সময় লেগেছে ৯ দিন।
ঊাবৎবংঃ ঞযৎবব চধংংবং ঞৎবশ রিঃয
ইধংবপধসঢ়: এই ট্রেকে ছিলো তিনটি উচ্চ পাস ও এভারেস্ট বেজক্যাম্প। জবহলড় খধ
ঢ়ধংং যার উচ্চতা ১৮০৬৩ ফিট। ঈযড় খধ ঢ়ধংং যার উচ্চতা ১৮২৬৫ ফিট। কড়হমসধ খধ
ঢ়ধংং যার উচ্চতা ১৮৬৮৬ ফিট। ঊাবৎবংঃ নধংব পধসঢ় যার উচ্চতা ১৮০৭৬ ফিট। এই
ট্র্যাকের দূরত্ব ৩৪০ কিলোমিটার এবং সময় লেগেছে ২২ দিন।
আরিফুর রহমান উজ্জ্বল বলেন, আমি আমার এই অর্জন আমার বাবা এবং আমার প্রিয় বড়ভাই মরহুম সাইফুল ভাইকে উৎসর্গ করছি।
আরিফুর
রহমান উজ্জ্বলের বন্ধু বিশিষ্ট চিকিৎসক নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী বলেন, আমার
জানা মতে উজ্জ্বলের এই পথ চলা বিশ^ রেকর্ড। তবে সে দেশে আসলে নিশ্চিত ভাবে
জানা যাবে। আমরা সাধারণত কোন অর্জন বলতেই রাজধানী ঢাকা কিংবা বন্দর নগরী
চট্টগ্রামের বাসিন্দা বলে চিন্তা করি, কিন্তু কোন প্রন্তিক জেলা থেকেও যে
উজ্জ্বলের মত ট্র্যাকার বা সাইক্লিস্ট উঠে আসতে পারে- এটার একটা প্রমান
তৈরী হলো। আমরা চেষ্টা করবো উজ্জ্বলকে জাতীয় ভাবে উপস্থাপন করতে। যেন তাকে
দেখে অন্যান্য তরুনরা এমন এ্যাডভেঞ্চারে অংশ নিয়ে সফল হবে।