২০১৮
সালের মতো দেশে আবারও সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের আন্দোলন ছাড়িয়ে পড়েছে।
শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা দাবি করছে যে, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা
বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে।
স্বাধীনতার
পর নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৭৬ সাল
পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি পদ কোটায় নিয়োগ
হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। পরে মেধায়
নিয়োগের হার আরও কিছু বাড়ানো হয়।
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মোট
৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা (পরে বীর
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি) কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ
জেলা কোটা এবং ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা। এছাড়া ১ শতাংশ পদ
প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয়
শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল
সরকার। কয়েক বছর ধরে সে অনুযায়ী কোটাবিহীন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু একটি
রিটের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হাইকোর্ট কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে
যা প্রতিক্রিয়ায় এখন আন্দোলন আবার শুরু হয়েছে।
অনেকেই জানতে চান কোটা
বা সংরক্ষণ প্রথা বিশ্বের আর কোন কোন দেশে আছে। ভারত এবং পাকিস্তানে কোটা
প্রথা বড় আকারেই আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষাসহ
নানা খাতে সংরক্ষণ প্রথা আছে। বিশেষ করে কালো মানুষের জন্য অনেক রাজ্যেই
চাকরিসহ নানা খাতে বিশেষ সুবিধা আছে।
আমাদের মতো দেশে সরকারি চাকরি
সবার কাছে এক বড় চাহিদা বা স্বপ্ন যা অন্য দেশে, বিশেষ করে উন্নত দেশেগুলোয়
নেই। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকায় ‘পজিটিভ
এফারমেটিভ অ্যাসিসটেন্স’ নামে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ সাহায্য
দেওয়া, খাদ্যে ভর্তুকি প্রদান করা, বাড়ি করে দেওয়া, শিক্ষা ও চিকিৎসায়
সাহায্য করার বিধান আছে।
সাউথ আফ্রিকায় ব্ল্যাকদের জন্য ক্রিকেটেও কোটা
সংরক্ষিত আছে। নরওয়েতে বেসরকারি খাতে পর্যন্ত নারী কোটা রাখার বিধান আছে।
ফ্রান্সে রাজনৈতিক দলগুলোয় নারীদের জন্য কোটা রাখা আছে। ব্রাজিলে
আদিবাসীদের জন্য চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে কোটা প্রথা বজায় আছে।
এটাই
স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের ভাবনাটা পশ্চিমা
সমাজের চেয়ে ভিন্ন হবে। বহু বছর ধরেই পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামাজিক ন্যায় ও
আর্থিক মানোন্নয়নকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯-এর ৩ (ক)
অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী
সম্প্রদায়গুলো অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করে ১৯৮৫ সালে সরকারি চাকরিতে
তাদের জন্য শতকরা পাঁচ ভাগ কোটা সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়।
এছাড়াও
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে উপজাতি কোটা রাখা হয়।
কোটাব্যবস্থা পেয়ে তাদের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক সূচকে কিছুটা হলেও অগ্রগতি
হয়েছে। তেমনিভাবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্যও কোটা আছে এবং এর প্রয়োজনীয়তা
নিয়ে কেউ আপত্তি করছে না। ক্ষেত্র বিশেষে নারীদের জন্যও কোটা ব্যবস্থা বড়
অবদান রেখেছে।
এই সংরক্ষণ প্রথার সুফল হিসেবে স্বাধীন দেশে সমাজে
অন্যদের থেকে তুলনামূলকভাবে আর্থিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষরা স্বাবলম্বী
হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তার পাশাপাশি নিদারুণ দারিদ্রের নাগপাশ কেটে
আত্মবিশ্বাসী নাগরিক হয়ে তারা দেশ ও দশের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার
হতে পেরে গর্ববোধ করছেন। তাই আর্থিক দিক থেকে দুর্বল শ্রেণির আর্থিক,
শিক্ষাগত ও আয় বিষয়ক স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারের এই বিশেষ ব্যবস্থা অবশ্যই
অবদান রাখছে।
প্রশ্ন হলো, সেই কোটা প্রথা কতটুকু এবং কীভাবে থাকবে?
প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত এক শতাংশ কোটা কখনো যথাযথভাবে পূরণ করা হয়নি।
এই বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধীদের চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের
শারীরিক সক্ষমতা, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ এবং অনুকূল অবকাঠামো বিবেচনায় নিয়ে
সরকারি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেই হবে। তাদের শিক্ষার সুযোগ ও নাগরিক
সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু সরকারি খাতে নয়, বেসরকারি খাতেও বিষয়টি যেন
মানা হয় সেই নজরদারি প্রয়োজন।
যারা কোটা বাতিল চান তারা বুঝতে পারছেন না
যে, শ্রেণি, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গীয় অসমতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশে কোটা
বাতিল সমাজের অসমতা এবং বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
কোটা প্রথায় মেধা
কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বাস্তবতা হলো অতি দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া
পরিবারের সন্তানরাও কোনো কাঠামোতেই সেইভাবে লেখাপড়া করতে পারে না যে মেধা
প্রদর্শন করবে। মেধা ও যোগ্যতা কোনো বায়বীয় পদার্থ নয় যে, তা এমনি এমনিই
সকলের মধ্যে গড়ে উঠবে। পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ওপর তা প্রায়
সরলরৈখিক ভাবে নির্ভরশীল।
যে তথাকথিত যোগ্যতার অহমিকায় অনেকে ডগমগ হয়ে
আছেন তা আদৌ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মেধা বা দক্ষতা নয়। তারা কে কতটা
সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তার ওপরও নির্ভর করে। যে পড়ুয়া শহুরে বড় প্রতিষ্ঠান,
ভালো ভালো শিক্ষকের কাছে পড়ছেন আর যে প্রান্তিক পর্যায়ে অতি ভগ্ন কাঠামোতে
ভালো শিক্ষক ছাড়া পড়ছেন, যে পড়ুয়া প্রতিটি বিষয়ে দুইজন করে গৃহশিক্ষকের
কাছে পড়ে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ার চেয়ে ‘যোগ্যতর’ হয়ে উঠেছেন, তাদের যোগ্যতা
কি সত্যিই তুলনীয়!
কোটা আন্দোলনকারীরা সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা কোটার
বিরোধিতা করে থাকলে তা সুবিবেচ্য দাবি নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের
জন্য কোটা ৩০ শতাংশ হবে নাকি একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে তা নিয়ে
সুচিন্তিত মতামত ও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
সরকারি চাকরিতে প্রাপ্ত সুবিধা
গড়পড়তা বেসরকারি চাকরির থেকে বেশি। তাই স্বাভাবিকভাবেই কোটার কারণে চাকরি
পাওয়া ব্যক্তির সামাজিক ও আর্থিক মানোন্নয়ন হয়। তিনি স্বচ্ছন্দে তার
পরিবারের জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান নিশ্চিত করতে পারেন। সেই সঙ্গে,
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দ্বিধাহীনভাবে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে পারেন।
সন্তানদের দিতে পারেন সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চিত আশ্বাস। তবে সমাজের বাকি
অংশের কাছে সংরক্ষণের সুবিধা সমান ভাবে পৌঁছে দিতে একটা বিকল্প ভাবনা ভাবা
যেতেই পারে।
রাজনীতির কান্ডারিরা বরাবরই কোটা সংরক্ষণকে ভোটের কৌশল
হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সেইখানে অনেকাংশে
গৌণ থাকছে। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল বঞ্চনা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
থেকে। সমতার মতাদর্শ চিন্তা করলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, দলিত, প্রতিবন্ধী,
ক্ষুদ্র পেশাজীবী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বহাল রাখতে হবে।
মনে
রাখা দরকার পিছিয়ে পড়া এই মানুষগুলো মোট জনসংখ্যার যত অংশ জুড়ে আছেন, তারা
যদি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে পেতেন, তা হলে সর্বস্তরে প্রতিযোগিতা
বেড়েই যেত, কমতো না। তাই কোটার বিতরণ কীভাবে হবে সেটা নিয়ে জেদাজেদির
পরিবর্তে যৌক্তিক ভাবনাই বেশি প্রয়োজন।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল