রণবীর ঘোষ কিংকর।
কুমিল্লার
চান্দিনা উপজেলা সদরে অবস্থিত ‘চান্দিনা সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ
বিদ্যালয়’। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি চান্দিনা উপজেলা তথা আশপাশের
কয়েকটি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীণ বিদ্যাপিঠ। যে বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য
প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ উপজেলা সদরে ছুটে আসতো, বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ের
প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অভিভাবকরা।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সারা
দেশের প্রতি উপজেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি কলেজ জাতীয়করণ করায় ওই
তালিকায় যুক্ত হয় উপজেলা সদরের গৌরব গাঁথা ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
জাতীয়করণের আট বছর মধ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী ওই বিদ্যালয়।
যে
বিদ্যালয়ে ২৫-৩০ নিয়মিত শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠদানে ব্যস্ত থাকতেন সেই
বিদ্যালয়ে সাধারণ শাখায় বর্তমানে শিক্ষক মাত্র ৫জন! শিক্ষক সংকটের তীব্রতায়
পাঠদান চরম ভাবে ব্যহত হচ্ছে। অপরদিকে, ভর্তি আসন সীমিত হওয়ায় অভিভাবকদের
মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র উদ্বেগ।
জানা যায়- ব্রিটিশ শাসনামলে সমতট
রাজ্যের রাজধানী বরকমতা হিসেবে পরিচিত ছিল চান্দিনার এই অংশটি। বিদ্যালয়টি
প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ে বরকামতা গভঃ এইডএডএই ই বিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫৬ সালে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় চান্দিনা হাই স্কুল। ১৯৮০
সালে বিদ্যালয়টিতে পাইলট প্রকল্প যুক্ত হওয়ায় চান্দিনা পাইলট হাই স্কুল
হিসেবে নামকরণ করা হয়। ওই বিদ্যালয়টির মাত্র ২শ গজের মধ্যে ১৯৭০ সালে একটি
বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়টিতে শুধুমাত্র
বালকদের ভর্তি নেয় হয়। ২০১৫ সালে ওই বিদ্যালয়ে ‘মডেল’ প্রজেক্ট যুক্ত
হওয়ায় নামকরণ করা হয় চান্দিনা মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং সে সময় থেকে
বালকদের পাশাপাশি বালিকা ভর্তি শুরু হয়। এতেই আসন কমতে থাকে বালকদের।
দীর্ঘ
প্রায় চার যুগ ধরে এটি শুধুমাত্র বালকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত
ছিল। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো বালিকাদের ভর্তি চালু করা হয়।
২০১৭ সালে জাতীয়করণের পর প্রতি শ্রেণিতে আসন সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হলে
বিদ্যালয়টি যোগ হয় আরও একটি নতুন সংকট।
বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি
শ্রেণিতে বালক ৫৫ জন ও বালিকা ৫৫ জন করে মোট ১১০ জন ভর্তি করা হয়। পাশের
একটি বালিকা বিদ্যালয় থাকায় মেয়েদের ভর্তি নিয়ে তেমন সমস্যা দেখা না দিলেও
বালকদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা।
অন্যদিকে বিদ্যালয়টির সাধারণ
শাখার ১০জন এমপিও ভূক্ত শিক্ষক নিয়ে জাতীয়করণ হওয়ার পর গত আট বছরের মধ্যে ৫
জন শিক্ষকই অবসরে গেছেন। এতে ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা,
ধর্মীয় শিক্ষক সহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক শূন্য হয়ে পড়ে। এছাড়া ২০১৪
সাল থেকে প্রধান শিক্ষক এবং ২০১২ সাল থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে মাত্র ৫ জন স্থায়ী শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম
চালানো হচ্ছে। শিক্ষক সংকটে বিদ্যালয়টির শিক্ষা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
হারিয়েছে শতবর্ষের গৌরব।
উপজেলা সদরের অভিভাবক অধ্যাপক টিটু কুমার
সরকার জানান- শুধুমাত্র চান্দিনা উপজেলা সদরের ৩টি সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয় থেকে এবার পঞ্চম শ্রেণীতে পাশ করবে ৪ শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের
মধ্যে অর্ধেকও যদি বালক হয় তাহলে ওই ২শ বালক কোথায় ভর্তি হবে? চান্দিনা
সরকারি মডেল পাইল উচ্চ বিদ্যালয়টির এখন যে অবস্থা তাতে কোন সচেতন অভিভাবক
তার সন্তানকে ভর্তি করাবে না। একদিকে বিদ্যালয়টির নানা সমস্যায় পড়ালেখা হয়
না, অপরদিকে উপজেলা সদরে আর কোন উচ্চ বিদ্যালয়ও নেই। এখন সন্তানকে কোথায়
ভর্তি করাবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
অভিভাবক বদন মোহন বণিক বলেন-
জাতীয়করণ করায় লাভবান হয়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরা। কিন্তু
ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শিক্ষার্থীরা। সমাপনী পরীক্ষার অংক প্রশ্ন বোর্ডে লিখে
দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে বিদ্যালয়টিতে।
অভিভাবক তাসলিমা আক্তার ও মিজানুর
রহমান জানান- যাদের সামর্থ আছে তারা সন্তানকে জেলা শহরের কোন ভাল বিদ্যালয়ে
ভর্তি করান। কিন্তু আমাদের মতো যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তারা তো সন্তানকে
নিয়ে বিপাকে পড়েছে। পাশেই একটি বালিকা বিদ্যালয় থাকতে কেন এই বিদ্যালয়টিতে
বালিকা ভর্তি করাতে হবে? যদি বালিকা ভর্তি না করানো হতো তাহলে অন্তত একশ
বালক বিদ্যালয়টিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতো।
বিদ্যালয়টিতে এ বছর থেকে
বালিকা ভর্তি বন্ধ, অন্য কোন সরকারি বিদ্যালয় থেকে কয়েকজন শিক্ষক এ
বিদ্যালয়ে বদলি করে শিক্ষার মান ফিরিয়ে এনে বালকদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ
সৃষ্টিসহ অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা কমানোর দাবি করেন তারা।
বিদ্যালয়টির
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিখিল চন্দ্র ভৌমিক জানান- জাতীয়করণ হওয়ার অন্তত
অনেক আগ থেকে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি।
পরবর্তীতে এনটিআরসি থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পরও কোন শিক্ষক পায়নি
প্রতিষ্ঠানটি। যে কয়েকজন এমপিও ভূক্ত শিক্ষক ছিল তাদের তালিকাই জাতীয়করণ
হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টির সাধারণ শাখায় ৫জন এবং ভোকেশনাল শাখায় ৬জন শিক্ষক
আছে।
এ ব্যাপারে চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ
আশরাফুল হক শিক্ষক সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন- শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে
আমি জেলায় একাধিকবার যোগাযোগ করেছি, জেলা থেকে ডিজি অফিসেও যোগাযোগ করা
হচ্ছে।
