রোববার ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
নির্বাচনে ইসি, প্রশাসন ও নিরাপত্তাবাহিনীর প্রস্তুতি
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
প্রকাশ: রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:১৮ এএম |


  নির্বাচনে ইসি, প্রশাসন ও নিরাপত্তাবাহিনীর প্রস্তুতি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি না, নির্বাচন উৎসবমুখর হবে কি না। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য হবে- এটা নিশ্চিত করতে প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সততা, পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষতায় থাকা উচিত। তফসিল ঘোষণা-পরবর্তী মনোনয়ন যাচাই, ভোটকেন্দ্র বরাদ্দ, ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা- প্রতিটি ধাপে প্রশাসনিক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা রয়েছে। যদি এ ভূমিকা পক্ষপাত, অনিয়ম বা দমন-পীড়নের মধ্যদিয়ে হয় তাহলে জনগণের আস্থা নষ্ট হবে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের জন্য একটি বিস্তারিত কৌশল চূড়ান্ত করেছে। নির্বাচন এলাকার নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন- সবই এখন পরিকল্পনাধীন। গত ২৭ নভেম্বর ইসি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংযুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠকে নির্বাচনি এলাকা ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার চূড়ান্ত পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। ভোটকেন্দ্র, সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা এবং মোতায়েন কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে রেড, ইয়েলো, গ্রিন জোনের ভাগে ভাগ করে করা হবে।
ইসি বলেছে, ভোটের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আতিথ্য গ্রহণ, প্রভাব বা গোপন যোগাযোগ থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে এ পরিকল্পনাগুলোর মধ্যেই একগুচ্ছ ঝুঁকি ও প্রশ্ন থেকে যায়। একদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ, পেশাদার এবং দায়িত্বশীল না হয়, তাহলে নির্বাচন শুধু ফর্মালিটি হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভোটকেন্দ্র দখল, ভয়ভীতি, দলীয় প্রভাব, ভোটারের চাপ- এরকম অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি প্রশাসন বা পুলিশ রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে তারা নিজেদের কাজকে ভোটার সুরক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে তৈরি করতে পারে। তাছাড়া, শুধু নিরাপত্তা বা বাহিনী মোতায়েনই কাজ শেষ নয়। ভোটার তালিকা, মনোনয়ন প্রক্রিয়া, ভোটকেন্দ্র বরাদ্দ- এসব প্রশাসনিক কাজ যদি স্বচ্ছ, সুশৃঙ্খল ও নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে ভোট গ্রহণে অংশগ্রহণ কমে যাবে। মানুষ ভয় পাবে, বিশ্বাস হারাবে। 
উন্নত রাষ্ট্রে নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনভাবে কাজ করে যেন পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়াটি শুধু আইনসম্মত নয়, বরং জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ মনে হয়। এ সময় প্রশাসনকে সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সতর্ক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক ভূমিকায় দেখা যায়। নির্বাচনের আগে থেকেই তারা রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত রাখার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক দলগুলোর অযথা সংঘর্ষ, উসকানি, সহিংসতা বা প্রচারের নামে বিশৃঙ্খলা যেন না ছড়ায় সে জন্য গোয়েন্দা নজরদারি, মাঠপর্যায়ের সমন্বয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আগেভাগেই ব্যবস্থা নেয়। 
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচনের পুরো সময়ে একটি দৃশ্যমান ‘নিউট্রাল ফোর্স’ হিসেবে মাঠে থাকে। তাদের দায়িত্ব শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং নাগরিকদের মনে এমন আশ্বাস তৈরি করা যে তারা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে। উন্নত রাষ্ট্রে পুলিশ, র‌্যাপিড রেসপন্স ইউনিট, নির্বাচন নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো ভোটকেন্দ্রের চারপাশে শান্ত পরিবেশ বজায় রাখে এবং কোনো পক্ষের প্রভাব বা চাপের প্রতি তারা ন্যূনতমও নতি স্বীকার করে না। কোথাও উত্তেজনা তৈরি হলে তা ছড়িয়ে পড়ার আগেই পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু সেই হস্তক্ষেপ হয় বৈধ নিয়মের মধ্যে। অযথা বলপ্রয়োগ বা পক্ষপাতের অভিযোগ যেন না ওঠে, সেদিকে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকে তারা।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি প্রশাসনের আনুগত্যও উন্নত দেশগুলোতে অত্যন্ত দৃশ্যমান থাকে। কমিশন যা নির্দেশ দেয়, ভোটার তালিকা, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা, পোলিং অফিসার নিয়োগ, সেনসিটিভ উপকরণ পরিবহন, গণনার নিরাপত্তা- সবকিছু প্রশাসন নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করে। কোনো পক্ষই প্রশাসনকে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পারে না, কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে শক্ত জবাবদিহির সংস্কৃতি থাকে। এমনকি কর্মকর্তারা জানেন, নির্বাচনে পক্ষপাত হলে ক্যারিয়ার নষ্ট, প্রশাসনিক তদন্ত, আদালতের জবাবদিহি- এসব অবধারিত। ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেবল নিরাপত্তা দেয় না, বরং পর্যবেক্ষকদের চলাচল ও সাংবাদিকদের কাজ করাও সহজ করে। উন্নত রাষ্ট্রে মিডিয়ার স্বাধীন গতিবিধি নির্বাচন প্রক্রিয়ার একটি অংশ হিসেবে গণ্য হয়, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিডিয়াকে সহযোগিতা করে, তাদের ভয় দেখায় না বা সীমাবদ্ধ করে না।
ভোট-পরবর্তী সময়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত রাষ্ট্রের প্রশাসন ফল ঘোষণা নিয়ে কোনোরকম গড়িমসি করে না। সব পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার মতো স্বচ্ছ গণনা, দ্রুত তথ্যপ্রবাহ এবং আপত্তি থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় তা সমাধানের সুযোগ প্রভৃতি তারা নিশ্চিত করে। বিক্ষোভ বা বিজয় উৎসব যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে চায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখনো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। উৎসব বা প্রতিবাদ কোনো রাজনৈতিক দলের একচেটিয়া অধিকার নয়; উভয়ের ক্ষেত্রেই একই মানদণ্ডে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
আর আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও জনমতের বিভাজন রয়েছে সেখানে প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব বা দমন-চক্রান্ত একেবারেই ধ্বংসাত্মক হতে পারে। আমার মতে, একটি গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে নিশ্চিত করতে নিচের বিষয়গুলো অপরিহার্য: প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের পূর্ণ নিরপেক্ষতা। তাদের রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদ বজায় রেখে কাজ করতে হবে; ভোটার, প্রার্থী, রাজনৈতিক দল, কারও প্রতি পক্ষপাত বা প্রতিহিংসা চলবে না। দ্বিতীয়ত, ভোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসনিক কাজ- ভোটার তালিকা প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র বরাদ্দ, মনোনয়ন যাচাই ইত্যাদি স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খলভাবে হতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ রদবদল, দায়িত্ব বণ্টন বা পর্যবেক্ষণ সেল গঠন করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, ভোটকেন্দ্র, নির্বাচনি এলাকা, সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা- এমন সব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেবল মোতায়েন নয়, বরং নিরপেক্ষ, পেশাদার ও জনমর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেন ভোটাররা ভয় না পেয়ে নিজের মতামত অনুযায়ী অংশগ্রহণ করতে পারে। চতুর্থত, নির্বাচনকালীন প্রক্রিয়া ও কাজকর্মের ওপরে পর্যাপ্ত নজরদারি ও জবাবদিহি থাকতে হবে। যদি কোনো অনিয়ম বা পক্ষপাত দেখা যায় তবে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে শুধুই বাহিনীর ওপর ভরসা নয়; সাধারণ মানুষও সচেতন হবে, অভিযোগ জানাবে, মনিটর করবে। ভোটাররা যেভাবে অংশগ্রহণ করে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে দায়িত্ব পালন করে, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা যেভাবে স্বচ্ছ ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা করে। ইসি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা যেসব পরিকল্পনা করেছে সেগুলো যথার্থ সুচারু বাস্তবায়ন হবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যদি তারা সৎ, নিরপেক্ষ, পেশাদার ও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করে, তাহলে নির্বাচন একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়














http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
হৃদয়বান মানুষ হতে বই পড়ার বিকল্প নেই : ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া
জীবনের বাকি সময়টা নেতাকর্মীদের সঙ্গেই থাকতে চাই-হাজী ইয়াছিন
হাফেজ কল্যাণ সমিতির ১৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় হাফেজ সম্মেলন
অর্থের চাইতে মানুষের আস্থা আমার কাছে অনেক বড় : হাসনাত আব্দুল্লাহ
খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় মুরাদনগরে কায়কোবাদের ৫০০ বার কুরআন খতম
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ধানের শীষ নিয়েই নির্বাচনের ঘোষণা হাজী ইয়াছিনের
কুমিল্লায় মক্কা হসপিটালের শুভ উদ্বোধন
নোয়াখালী পদুয়া দায়রা শরীফের ওরছ আমাগী ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর
খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে আসছে জার্মানির এয়ার অ্যাম্বুলেন্স
চৌদ্দগ্রামে গণঅধিকারের এমপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে পিতাকে মারধরের অভিযোগ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২