শনিবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জনজীবনে নিরাপত্তা জরুরি
সুলতানা কামাল
প্রকাশ: শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:২৪ এএম আপডেট: ০৬.১২.২০২৫ ১২:৫৬ এএম |

 মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জনজীবনে নিরাপত্তা জরুরি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়কে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ কর্তৃক অনলাইনে দেশব্যাপী শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জনমনে উদ্বেগ বিরাজ করছিল। এ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ও আগুনে পুড়ে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ও নাশকতাকারীদের ধরতে বিশেষ অভিযানের পরও নাশকতা থামানো যায়নি, ফলে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (ডিবি) হেফাজতে থাকা অবস্থায় দুজন আসামির মৃত্যু হয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাক্সিক্ষত। সেই সঙ্গে গ্রেপ্তারের ভয়ে পুলিশ দেখে আতঙ্কিত হয়ে অপর একজন মারা যান। এ মাসে কিছু জনসমাবেশ ছাড়া রাজনেতিক কর্মকাণ্ড না থাকলেও মনোনয়ন পাওয়া ও মনোয়ন না পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত ও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বকালীন সহিংসতায় হতাহত ও দুষ্কৃতকারীদের হাতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিহত হওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেই চলেছে। নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা, যেমন- ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ ও হত্যা এবং হত্যা কিছুটা কমলেও, ধর্ষণচেষ্টা, যৌন হয়রানি, আত্মহত্যা এবং শিশু ও নারীদের প্রতি শারীরিক নির্যাতন বেড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ মাসে কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা সামান্য কমেছে। সনাতন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সীমান্তে হতাহতের ঘটনা বন্ধ হয়নি, অপরদিকে ভারতীয় কোস্টগার্ড ও আরাকান আর্মি কর্তৃক বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নেওয়ার ঘটনায় সে অঞ্চলের বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনা কিছুটা কমলেও গণপিটুনি ও মব সহিংসতার মতো আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে এ ইস্যুতে নিহত ও আহতের সংখ্যা বেড়ে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি প্রকট করে তুলছে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এ বিষয়ে নাগরিকদের জীবনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তহীনতা বাড়িয়ে তুলেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক চর্চা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমমর্যাদা ও নাগরিক জীবনে নিরাপত্তার বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা বিধানের দাবি জানাচ্ছে।
নভেম্বর, ২০২৫ মাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন একট না থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করে ঘোষণা দেওয়ায় দেশে একটি নির্বাচন প্রস্তুতির প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভব্য মনোনয়ন প্রার্থীদের তালিকা তৈরি ও প্রকাশ করায় বিশেষ করে বিএনপিতে মনোনয়ন না পাওয়া প্রার্থীদের অসন্তোষ প্রকাশ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন চলছে। ফলে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকায় নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। তবে মামলার সংখ্যা কমে হলেও দুষ্কৃতকারী কর্তৃক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা অব্যাহত ছিল, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দুষ্কৃতকারীদের অপতৎপরতায় হতাহতের ঘটনা জনমনে নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির সৃষ্টি করেছে। নিবর্তনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এ আইনের অপব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। অধিকারকর্মীরা বর্তমান অধ্যাদেশকে আগের তুলনায় উন্নত বললেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কিছু বাধা রয়েই গেছে বলে আখ্যা দিয়েছেন। ফলে এ আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রেপ্তারের সংখ্যাও বাড়ছে। যা উদ্বেগজনক।
নভেম্বর, ২০২৫ মাসে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে শারীরিক মানসিক এবং আইনি হয়রানি, আক্রমণ, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয় বরং সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা দেওয়ারই নামান্তর। পেশাগত দায়িত্ব পালন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার তাদের বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন। এখনো মতপ্রকাশ ও তথ্যের স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। এ মাসেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না বরং ধারাবহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে। উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্তে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, হত্যা, আহত বা মারধরের ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে উভয়পক্ষ সম্মত হলেও সীমান্তে হত্যা, নির্যাতন ও আটক করে ধরে নিয়ে যাওয়া বন্ধে অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যাসহ অন্যান্য ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্তে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, হত্যা, আহত বা মারধরের ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছেন। অপরদিকে কয়েক মাস ধরে শুরু হওয়া ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক পুশ ইন কার্যক্রম এ মাসে তেমন একটা পত্রিকায় প্রকাশ না পেলেও বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী নাগরিকদের জনজীবনে আতঙ্ক ও ভীতি বিরাজ করছে।
সীমান্তে পরিস্থিতির বিষয়ে প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আশাব্যাঞ্জক প্রতিকার হচ্ছে না। সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা কখনোই কাম্য হতে পারে না। অপরদিকে প্রতিবাদ সত্ত্বেও মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। সীমান্তে এমন ঘটনা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।
নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার মূল কারণ বিবেচনায় আসে বিচারহীনতা। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন রয়েছে কিন্তু অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। ফলে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার জায়গাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। নারীরা শিক্ষাঙ্গনে, বাসে, ট্রেনে, অটোবাইকে এমনকি নিজ ঘরে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। যা কখনই কাম্য হতে পারে না। যা নাগরিক জীবনে প্রশ্নাতীতভাবে সমালোচনা ও উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নারী ও শিশু সহিংসতার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ।
ধারাবাহিকতায় অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর ২০২৫ সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৩ জন নারী ও ৪৫ জন পুরুষ, মোট ৫৮টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হয়েছে; যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ। অল্প সংখ্যক ঘটনা ছাড়া সব কয়টি লাশের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে।
শুধু অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা যত ক্ষমতাবানই হোক, এসব অপরাধীকে চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। গণপিটুনি বা মব সন্ত্রাসে হতাহতের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে ঘটেই চলেছে। চলতি সময়ে গণপিটুনির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় জনমনে নিরাপত্তা বোধের বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। এ ছাড়া ধর্ষণ এবং ধর্ষণচেষ্টার হার বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষণে অভিযুক্তদের ধরে গণপিটুনি দেওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মীদের পাওয়া মাত্র গণপিটুনি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করার লক্ষণীয় প্রভাব থাকায় জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে; যা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে গণপিটুনির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন













http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
ধানের শীষ নিয়েই নির্বাচনের ঘোষণা হাজী ইয়াছিনের
খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে আসছে জার্মানির এয়ার অ্যাম্বুলেন্স
কুমিল্লায় মক্কা হসপিটালের শুভ উদ্বোধন
মনিরুল হক চৌধুরীর উদ্যোগে খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিল
চাঁদাবাজি লুটপাট বন্ধ করতে দাড়িপাল্লায় ভোট দিন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
মনোনয়নের খবর শুনে উচ্ছ্বাস, স্ট্রোক করে বিএনপি সমর্থকের মৃত্যু
পোস্টারের দখলে দাউদকান্দির মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ
উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া
কুমিল্লায় ট্রাক্টর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে, গোসল করতে থাকা ৩ নারী নিহত
আরো ৩৬ আসনে বিএনপির মনোনয়ন যারা পেলেন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২