শনিবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বৈষম্য দূর করতে সামাজিক স্থিতিশীলতা জরুরি
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
প্রকাশ: শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:২৪ এএম আপডেট: ০৬.১২.২০২৫ ১২:৫৬ এএম |

 বৈষম্য দূর করতে সামাজিক স্থিতিশীলতা জরুরি
চব্বিশের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ এক নতুন যুগে পদার্পণ করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। ভবিষ্যতে যারা সরকার গঠন করবেন, তাদের মনে রাখতে হবে জনগণ যদি বিরূপ হয়, তাহলে সরকার ব্যর্থ হতে পারে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উৎপাদনশীল খাতে গতি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। দেশে ব্যাপক হারে কলকারখানা স্থাপিত হলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উৎপাদন খাত মন্থর হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্যের নানা রূপ রয়েছে। অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়ে পরিবার চালানোর জন্য ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সার্বিকভাবে উৎপাদনশীল সেক্টরকে গতিশীল করার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নানা সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধান্বিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.২৯ শতাংশ। এটি বিগত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রেও মন্দা লক্ষ করা যাচ্ছে।
একটি পরিবারের আর্থিক দুর্দশা রোধ করতে হলে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আগেকার দিনে একটি পরিবারের একজন মাত্র সদস্যের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে পুরো পরিবার তার উপার্জনের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। এখন আর্থিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পরিবারের একজন সদস্যের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে অন্যদের টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পরিবারের একাধিক সদস্যের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে, সেখানেও উপযুক্ত মজুরি বা বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চমূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। 
দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থান করছে, যারা সামান্য অভিঘাতেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ উচ্চমূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থানের অভাব। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ২০ লাখ কম কর্মসংস্থান হয়েছে। আগের সরকারের আমলে যেসব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে দরিদ্র পরিবারের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই বিত্তবান পরিবারগুলো সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা ভোগ করছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ৩৫ শতাংশ সুবিধাভোগী হচ্ছে বিত্তবান পরিবার। মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, তারা কর্মমুখী জনপদ বা অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টন করা সম্ভব হয়নি। ফলে উন্নয়নের সুফল সামান্য কিছু বিত্তবান পরিবারের হাতে চলে গেছে। এতে ধনী-দরিদ্রের মাঝে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান আরও বেড়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা দেওয়া। পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। এখন ২২ হাজার পরিবারের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান আয়বৈষম্য ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় শহর থেকে গ্রামে। ফলে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালের পর থেকে প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে ধনীরা। ফলে দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশে সম্পদের অভাব নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের সুবর্ণ সময়ে অবস্থান করছে। প্রায় ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্যদিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স যখন ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ কর্মক্ষম সীমার মধ্যে থাকে, সে অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে অনুকূল বলে বিবেচনা করা হয়। একটি দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই সৃষ্টি হয়। আবার কারও কারও মতে, হাজার বছরে একবার এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে না, তারা উন্নয়নের শিখরে উঠতে পারে না। চীনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্যদিয়ে সময় অতিবাহিত করেছে। তারা এর সুযোগ পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে জাপান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা থেকে দূরে সরে আসার কারণে তার উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে পড়েছে। জাপান ৪৪ বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। চীন সম্প্রতি জাপানের সেই অবস্থানকে অতিক্রম করে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্যদিয়ে সময় অতিবাহিত করছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এরই মধ্যে বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ হারাতে চলেছি। 
অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন এবং বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে উৎপাদিত সম্পদের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবার মাঝে বণ্টনের ব্যবস্থায় ব্যর্থতা। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তারাই মনে করেন দেশটি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। অর্জিত সুফল ভোগ করার জন্য তারাই একমাত্র দাবিদার। 
বর্তমানে শিক্ষার মান সাংঘাতিকভাবে নিম্নমুখী হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে একজন শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে গিয়ে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন, তারা কার্যত অহমিকাপূর্ণ বেকারে পরিণত হচ্ছেন। কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে কর্মসংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন প্রতিবেদন-২০২৫’-এ বাংলাদেশের দারিদ্র্যপ্রবণতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি কীভাবে বিস্তার লাভ করছে এবং সমাজকে প্রভাবিত করছে, তার উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। চার বছর ধরেই বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, যা এ বছর শেষের দিকে ২১.২ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য দূরীকরণের তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই ভবিষ্যতে যারা সরকার গঠন করবেন, তাদের দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য নিরসনের ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হবে দ্রুত একটি গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে দারিদ্র্য হ্রাস পেতে পারে।  
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
ধানের শীষ নিয়েই নির্বাচনের ঘোষণা হাজী ইয়াছিনের
খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে আসছে জার্মানির এয়ার অ্যাম্বুলেন্স
কুমিল্লায় মক্কা হসপিটালের শুভ উদ্বোধন
মনিরুল হক চৌধুরীর উদ্যোগে খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিল
চাঁদাবাজি লুটপাট বন্ধ করতে দাড়িপাল্লায় ভোট দিন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
মনোনয়নের খবর শুনে উচ্ছ্বাস, স্ট্রোক করে বিএনপি সমর্থকের মৃত্যু
পোস্টারের দখলে দাউদকান্দির মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ
উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া
কুমিল্লায় ট্রাক্টর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে, গোসল করতে থাকা ৩ নারী নিহত
আরো ৩৬ আসনে বিএনপির মনোনয়ন যারা পেলেন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২