ত্রয়োদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) দল ও প্রার্থীর
জন্য ‘নির্বাচনি আচরণবিধি-২০২৫’ শীর্ষক একগুচ্ছ নতুন বিধি জারি করেছে। এ
বিধিতে নির্বাচনের সময় প্রার্থীর আচরণ কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া
হয়েছে। আচরণ মানেই বিধিনিষেধ আরোপ এবং করণীয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া। এবার এ
রকম অনেক নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসি। ইসি বলছে, এতে নির্বাচনি ব্যয়
যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তেমনি পরিবেশও আগের তুলনায় ভালো হবে।
যেকোনো
নির্বাচনে সব সময় পোস্টার ব্যবহৃত হয়। এটা আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল।
কিন্তু প্রথমবারের মতো পোস্টার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে ইসি।
বিলবোর্ডও ২০টির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থও নির্দিষ্ট
করে দেওয়া হয়েছে। শোডাউন, মিছিল ও মশাল মিছিল করা যাবে না। এসব বিধি
নিঃসন্দেহে নির্বাচনের পরিবেশকে জনবান্ধব রাখতে সাহায্য করবে।
সোশ্যাল
মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণাও নিয়ন্ত্রণ করবে ইসি। নির্বাচনি প্রচার শুরুর আগে
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ সব সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের নাম, আইডি ও
ই-মেইল ঠিকানা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতে হবে। ভাষায় ঘৃণা
প্রকাশ, বিকৃত চিত্র, মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট কিংবা কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে প্রচার চালানোকে নির্বাচনি অপরাধ হিসেবে
ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতিকে ব্যবহার করে ভোট চাওয়া যাবে
না। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত সব কনটেন্ট প্রকাশের আগে যাচাই করে নেওয়াকে
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ বিধানগুলো সমর্থনযোগ্য নিঃসন্দেহে। এসব বিধান
প্রার্থীদের ডিজিটাল প্রচারকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার বিশাল
জগতে তা কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ
যে বিধানটি রাখা হয়েছে তা হলো এআইয়ের অপব্যবহার, গুজব ছড়ানো, ভুয়া ও
বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারকে নির্বাচনি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ
ধরনের অপরাধে জড়িত প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও থাকবে ইসির হাতে।
নির্বাচনি পরিবেশকে ঘৃণা আর সংঘাতমুক্ত রাখার জন্য এ বিধানগুলোর প্রয়োজন
রয়েছে।
শুধু উল্লিখিত বিধিনিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ নয়, নির্বাচন কমিশন
প্রার্থীর জন্য কিছু করণীয়ও ঠিক করে দিয়েছে। একই আসনের সব প্রার্থী এক
মঞ্চে উপস্থিত হয়ে ইশতেহার ঘোষণা করবেন। এটি আয়োজন করবেন রিটার্নিং
কর্মকর্তা। গণমাধ্যমে সংলাপ ও প্রচারে সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিধান রাখা
হয়েছে। এ জন্য সব প্রার্থী একই দিন নির্দিষ্ট কোনো গণমাধ্যমে উপস্থিত থেকে
কথা বলবেন। এ বিধানটিও নির্বাচনের পরিবেশকে গণতান্ত্রিক রাখতে সহায়তা করবে।
আলাদাভাবে কোনো প্রার্থীর পক্ষে গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকবে না।
তবে বিরোধপূর্ণ রাজনীতিতে বাস্তবে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ
আছে।
ভোটার স্লিপ ব্যবহারেও পরিবর্তন এনেছে ইসি। এবার ভোটার স্লিপে কোনো
প্রার্থীর নাম, ছবি, প্রতীক বা পদের নাম থাকবে না। এ বিধানটি প্রচারকে
সীমাবদ্ধ করতে পারে। এতে অনেক ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীর পরিচয় শনাক্ত
করতে অসুবিধায় পড়তে পারেন। নির্বাচনি প্রচারে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী
ব্যবহারকে উৎসাহিত করার জন্য ইসি পলিথিন, রেকসিন, পিভিসি ব্যানার বা
প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে, যা প্রশংসনীয়।
বিধিনিষেধের
পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন শাস্তি ও প্রার্থিতা বাতিলের বিধান কঠোর করেছে।
বিধি লঙ্ঘন করলে প্রার্থীর সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং দেড় লাখ টাকা
জরিমানা হতে পারে। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও একই পরিমাণ অর্থদণ্ড নির্ধারণ
করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো, ইসি এখন তদন্তসাপেক্ষে সরাসরি
প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে, যা আগের আচরণবিধিতে সুস্পষ্ট ছিল না।
নির্বাচন
কমিশন যে বিধিমালা প্রণয়ন করেছে, প্রার্থীদের সমসুযোগ সৃষ্টি ও বৈষম্য
নিরসনে তা সহায়তা করবে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এসবের প্রয়োজনীয়তা
অনস্বীকার্য। তবে শুধু বিধি করলেই হবে না, এসবের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে
হবে। এর ওপরই নির্ভর করছে আসন্ন নির্বাচন কতটা অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও
প্রাণবন্ত হবে।
ডিজিটাল যুগে নির্বাচনি প্রচারকে কতটা সীমিত করা
যুক্তিযুক্ত, তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচনে অর্থের যথেচ্ছ
ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে ঢালাওভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করলে
নির্বাচনের প্রাণবন্ত পরিবেশ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বাংলাদেশে ভোট
মানেই একধরনের উৎসব। এ উৎসবের পরিবেশটাও যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেদিকটির
প্রতি নজর থাকতে হবে নির্বাচন কমিশনের।
