
ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় চিফ
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পাশের সড়কে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত সোমবার এই ঘটনা ঘটেছে অনেকটা ফিল্মী কায়দায়।
একই দিনে রাজধানীর অন্তত ১০টি স্থানে ১৪ থেকে ১৫টি ককটেল বিস্ফোরণ এবং
কয়েকটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গত সোমবার ভোর থেকে রাজধানীর মিরপুর,
মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, আগারগাঁও, খিলগাঁও, বাংলামোটর, মেরুল-বাড্ডা এবং
শাহজাদপুরে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। ধানমন্ডিতে
ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
একটি বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রাত দেড়টার দিকে যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসে
আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
এখানেই পরিস্থিতি থেমে নেই। শুধু রাজধানীতে নয়,
দেশের নানা স্থান থেকে এই ধরনের ঘটনার খবর এসেছে। সোমবার রাতেই ময়মনসিংহের
ফুলবাড়িয়া উপজেলায় একটি বাসে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। ওই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে এক
পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন আরও দুজন।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে
আসছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তত অবনতি ঘটছে। প্রতিদিনই হত্যা, অপহরণ,
চাঁদাবাজি প্রভৃতি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধ জগতের কুশীলবরা সক্রিয় হচ্ছে।
অভিযানে গিয়ে পুলিশ হামলার শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ দমনে পুলিশি
তৎপরতার অভাব রয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছেন। অস্ত্র উদ্ধারেও সরকারের
তেমন সাফল্য নেই।
এসবের সঙ্গে নতুন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার রায় নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
সরকারও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তৎপর। গত এক সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা
সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অন্তত তিনটি বৈঠক হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে
শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের আশঙ্কার কারণ নেই বলে জানিয়েছেন
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
ট্রাইব্যুনাল, মেট্রোরেল ও রেলওয়েসহ কেপিআই স্থাপনায় (গুরুত্বপূর্ণ
স্থাপনা) নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এমনকি রাস্তার পাশে জ্বালানি তেল বিক্রি
কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
আশা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে আগুনের ঘটনার
মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভার পর
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথা থেকে বোঝা
যায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। এরকম পরিস্থিতি যে হতে পারে,
গণমাধ্যমে অনেক দিন থেকেই এই আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ
আলমও এক আলোচনা সভায় এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সূচনা ঘটে মব সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে। পরে তা
ছড়িয়ে পড়ে মাজার ভাঙা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে
কেন্দ্র করে। এসব ঘটনা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দৃষ্টান্ত তেমন দেখা
যায়নি। নির্বাচনি সহিংসতায় অন্তত ৫০টি আসনে আন্দোলন-সহিংসতা হচ্ছে। রাস্তা
অবরোধ থেকে শুরু করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যকার
দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। চট্টগ্রামে একজন প্রার্থীর মিছিলে
গুলি হওয়ায় মৃত্যু হয়েছে একজনের।
এর সবই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির
সাম্প্রতিক অবনতির লক্ষণ। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাজনৈতিক অঙ্গন ও জনমনে
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্ষমতা
নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১৩ মাস পার হলেও
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন ব্যর্থ হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা সেই প্রশ্ন
তুলছেন। সমস্যা আসলে দ্বিমুখী। প্রথমত রাজনৈতিক, দ্বিতীয়ত, সামাজিক।
রাজনৈতিক মতৈক্যের প্রভাবে হানাহানি বাড়ছে আর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায়
আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীরা উৎসাহী হয়ে নতুন করে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
সবমিলিয়ে অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ
হচ্ছে অনতিবিলম্বে রাজনৈতিক পথপার্থক্য দূর করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া আর
অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামর্থ্য ও তৎপরতা বাড়ানো। শুধু কথায়
পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে বললে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। আসন্ন
নির্বাচনের আগে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কতটা সক্ষম, এখনই তার পরীক্ষা হয়ে
যাচ্ছে। এই পরীক্ষায়, যেভাবেই হোক, সরকারকে উত্তীর্ণ হতে হবে। জনজীবন থেকে
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার জন্য এটা জরুরি।
