
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এটি জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি সামাজিকীকরণ, নৈতিক
বিকাশ এবং দক্ষ নাগরিক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি কুসংস্কার দূর
করে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতির পথ তৈরি করে। এ ছাড়া এটি শিক্ষার্থীদের
মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, নেতৃত্ব এবং সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা করে। শিক্ষার
উদ্দেশ্য হলো সত্যের লালন ও মিথ্যার অপনোদন। এককথায় পরিপূর্ণ শিক্ষা শুধু
জ্ঞানের স্তরেই সীমাবদ্ধ নয়, জ্ঞানার্জনের পর তা কার্যকরীভাবে ব্যবহারিক
জীবনে প্রয়োগই হলো শিক্ষা। একটি দেশ ও জাতির অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হলো
শিক্ষা। এই বিবেচনায় বলা হয়, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। অর্থাৎ একজন মানুষ
যেমনি মেরুদণ্ড সোজা করে স্থির দাঁড়াতে পারেন, ঠিক তেমনি একটি জাতির
ভিত্তিমূল, উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে তার
শিক্ষার ওপর। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত, সভ্য এবং
অগ্রসর। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাঙ্গনে শান্তি-শৃঙ্খলা
নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে কখনোই
সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও
সত্যি, আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে এক ধরনের নৈরাজ্য এবং
ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। দেশে যদি শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ না থাকে,
তাহলে সেই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা মানবিক গুণাবলি নিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত
হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না, কাক্সিক্ষত মানবিক সমাজ গঠন কোনোভাবেই সম্ভব হবে
না। গুণগত শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম পূর্ব শর্ত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে
শান্তিপূর্ণ এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা।
শিক্ষাঙ্গনে যদি এ
বিশৃঙ্খল অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে দেশ ও জাতি মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি
হবে। কারণ শিক্ষা বিস্তারের জন্য সুস্থ, সুন্দর এবং স্বাভাবিক পরিবেশ খুবই
প্রয়োজন। দেশের সাড়ে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ১১তম
গ্রেডের দাবিতে শুক্রবার থেকে ঢাকায় আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছেন। বেতন-ভাতা ও
মান-মর্যাদা বাড়ানোর দাবিতে ক্লাস ছেড়ে এখন পুরোদমে রাজপথে
সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকরা। এতে সব ধরনের
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম।
অথচ আগামী মাসেই শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা। এমন সময়ে ক্লাস না হওয়ায়
সিলেবাসের পাঠ শেষ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া
সুরাহা না করায় বারবার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে তাদের। এতে শিক্ষা কার্যক্রম
ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা সিলেবাস শেষ না করেই পরবর্তী
ক্লাসে উঠে যাচ্ছে, যা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে অশনিসংকেত। সাম্প্রতিক সময়ে
একের পর এক শিক্ষক আন্দোলন দানা বাঁধছে।
আলোচনার মাধ্যমে সরকার
শিক্ষকদের দাবি পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গনে নেমে
এসেছে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়- সব
স্তরেই চলছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, অসন্তোষ ও প্রশাসনিক টানাপোড়েন। শিক্ষক
সমাজ আন্দোলনে, শিক্ষা ক্যাডারে তীব্র অসন্তোষ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে
উত্তেজনা, আর পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানি- সব
মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা এক গভীর সংকটে পড়েছে। বিভিন্ন খাতে সংস্কার করা হলেও
শিক্ষায় কোনো সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়নি। ফলে শিক্ষা খাতে বড় কোনো
পরিবর্তন দেখা যায়নি; বরং সিদ্ধান্তহীনতা, প্রশাসনিক জটিলতা ও গতিহীনতায়
শিক্ষাব্যবস্থা আরও দুর্বল হয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে ব্যক্তির
পরিবর্তন হলেও কাজের ধরনে তেমন পার্থক্য আসেনি। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও
আগের মতোই রয়ে গেছে।
সরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা দীর্ঘদিন
ধরে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। দেশের ৩০
হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন প্রায়
সাড়ে ৩ লাখ। আর কর্মচারী দেড় লাখেরও বেশি। সব মিলিয়ে এমপিওভুক্ত
শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। বিরাট সংখ্যক এ
শিক্ষক-কর্মচারীরা মাসে মাত্র এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া পান। আর চিকিৎসা ভাতা
পান ৫০০ টাকা। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতা (বোনাস) বাড়ানোর দাবিতে
দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। বারবার তাদের ডেকে
প্রতিশ্রুতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে তা পূরণ করা হয় না। সর্বশেষ গত
আগস্টে শিক্ষকরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো শতাংশ হারে বাড়িভাড়ার দাবি তোলেন।
তাদের দাবি- মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা দিতে হবে। এ দাবি
উপেক্ষা করে গত ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবসে মাত্র ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া ভাতা
বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতেই মূলত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন
শিক্ষকরা। গত রোববার থেকে রাজধানীতে টানা অবস্থান করছেন তারা। তারা
রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনে আমরণ অনশনে যাওয়ার ঘোষণা
দিয়েছেন।
শিক্ষকদের বেতন নেই বলেই তো শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া
যাচ্ছে না। তারা ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট-কোচিংয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন।
কারণ, তাদের তো দুটি পয়সা আয় করে টিকে থাকতে হবে। অনেক বছর ধরে শিক্ষকদের এ
দৈন্যদশা নিয়ে সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
সামনে বার্ষিক পরীক্ষা, এমন সময়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতি, রাজপথে আন্দোলন
শিক্ষার্থীদের কতটা ক্ষতি। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে দৃশ্যমান
পরিবর্তন হয়নি বরং সিদ্ধান্তহীনতা, প্রশাসনিক জটিলতা, গতিহীনতা
শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করেছে। শিক্ষার বিভিন্ন পদে ব্যক্তির বদল হলেও
কাজকর্মে তেমন পরিবর্তন হয়নি। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায় আগের
মতোই। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বছরজুড়ে বন্যা,
তাপপ্রবাহ, পেনশন আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, অবরোধসহ সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে
দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা আবারও থমকে গেছে। ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে
অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় চার
কোটি শিক্ষার্থী। সেশনজটে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন
পর্যায়ের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। জাতির মেরুদণ্ড বড় ধরনের একটা ধাক্কা লাগল।
এই ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে
গুরুত্ব দিয়ে, দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থায়
স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা উচিত।
এভাবে দেশের শিক্ষা খাত চলতে পারে না।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথা শিক্ষার পরিবেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। দ্রুত
কীভাবে পুরোদমে সবকিছু শুরু করা যায়, সে ব্যাপারে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের
দায়িত্ব নেওয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরও নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে
পড়তে হবে। বন্ধ থাকা ক্লাস, পরীক্ষাগুলোর ক্ষতি পোষাতে নিতে হবে বিশেষ
পরিকল্পনা। নতুন করে পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করতে হবে। এই সংকট
কাটানোর কোনো পথ নেই। যতক্ষণ না আমরা এর শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে
না সাজাই। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিকল্পনা খুব জরুরি। তাহলে
হয়তো সংকট কাটানো সম্ভব। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা যেমন জরুরি, তেমনি
মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদরাসা কিংবা উচ্চশিক্ষা কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমাদের শিক্ষার সব পর্যায়েই নানামুখী সংকট রয়েছে।
সে জন্যই শিক্ষাকে
গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাত বিপর্যস্ত, কারণ
এতে রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট ও
অবকাঠামো, অব্যবস্থাপনা ও বৈষম্য এবং শিক্ষার মান ও কারিগরি দক্ষতার
ঘাটতি। ফলে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ঝরে
পড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয় ঘটছে। বাংলাদেশে
শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আজ সর্বত্র। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষক সমাজের
আর্থিক অনিশ্চয়তা শিক্ষার গুণগত মানে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। একদিকে তারা
পেশাগতভাবে নিরাপত্তাহীন, অন্যদিকে জীবনের চাপে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
বিশ্বায়নের
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন দক্ষ, উদ্ভাবনী ও মানবিক শিক্ষক। অথচ
আমরা সেই শিক্ষককেই অবমূল্যায়ন করছি, যার হাতে গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হয়, আমাদের দেশে শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত খাতগুলোর একটি।
বছরের পর বছর শিক্ষা খাতকে গুরুত্বহীন করে রাখায় সমাজে শিক্ষা ও শিক্ষকদের
মর্যাদা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এখন তো দেশে পরিবর্তন এসেছে,
শিক্ষাক্ষেত্রেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ার কথা। শিক্ষাকে একটি জাতির
মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ এ খাতকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে
না। শিক্ষা খাতে অবহেলার আরেকটি দিক হচ্ছে, এ খাতে আমরা পর্যাপ্ত অর্থ
ব্যয় করতে আগ্রহী নই। অথচ শিক্ষায় ব্যয় করার মানে হলো ভবিষ্যতের জন্য
বিনিয়োগ করা।
শিক্ষা খাতকে অবহেলা করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারেনি।
তাই এ খাতের সমস্যাগুলো নিরসনে সবার আগে মনোনিবেশ করা উচিত। সুন্দর সমাজ
গড়তে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য, কারণ এটি মানুষকে সঠিক পথ দেখায়,
কুসংস্কার থেকে মুক্তি দেয় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে সহায়তা করে।
শিক্ষাই ব্যক্তিকে বিচার-বিবেচনা করতে শেখায় এবং একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ ও
ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে।
লেখক: কলাম লেখক ও সাবেক রেজিস্ট্রার, জাবিপ্রবি
