জাতীয়
নিরাপদ সড়ক দিবস ২২ অক্টোবর। সরকারিভাবে নবম বারের মতো দিবসটি জাতীয়ভাবে
উদযাপিত হচ্ছে। তবে বেসরকারিভাবে ১৯৯৪ সাল থেকে, অর্থাৎ গত ৩২ বছর ধরে
নিরাপদ সড়ক দিবস বাংলাদেশে উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালের এই দিনে তখনকার
জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন চট্টগ্রাম থেকে
বান্দরবান যাবার পথে পটিয়ার সড়কে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এ মৃত্যু
সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
তখন দেশে সড়ক নিরাপত্তায় কোনও
সামাজিক-একাডেমিক বা সরকারি কার্যক্রম ছিল না, যা জনাব কাঞ্চনকে তাড়িত করে।
তিনি পহেলা ডিসেম্বর ১৯৯৩ তারিখে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিষ্ঠা করেন।
জনাব কাঞ্চনের জনপ্রিয়তার কারণে খুব অল্প সময়ে নিসচা সারাদেশে বিস্তৃতি লাভ
করে এবং ১৯৯৪ সাল থেকে, প্রতিবছর ২২ অক্টোবর ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসাবে
পালন শুরু হয়।
সড়কে প্রতিনিয়ত, প্রায় প্রতি ঘণ্টায় দেশের কোথাও না কোথাও
সড়কে মানুষ মারা মারা যাচ্ছে। কিন্তু কিছু বিশেষ মৃত্যু মানুষের মনে দাগ
কাটে। সড়কে অব্যবস্থাপনার জন্য মানুষ ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্দ হয়। তেমনই, ২০১১
সালের ১৩ আগস্ট ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক
মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনিরসহ ৫ জন মারা গেলে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন জোরালো
হয়।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটি এলাকার সড়কে রমিজউদ্দিন
স্কুলের দু’জন শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজি ও দিয়া খানম মীম জাবালে নুর
পরিবহনের দুটি বাসের প্রতিযোগিতার কারণে সড়কে মারা গেলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন সরকার বাধ্য হয়ে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস
করলেও বিধিমালা প্রণয়ন করতে সময় নেয় চার বছর।
উপরন্তু, এতে সড়ক নিরাপত্তার অনেক বিষয় নেই। ফলে সড়ক নিরাপদ করার জন্য দেশে পূর্ণাঙ্গ একটি আইন প্রয়োজনের দাবি জোরালো হয়েছে।
এ
প্রেক্ষাপটে আজ উদযাপিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২৫। এ বছর দিবসটির
প্রতিপাদ্য হচ্ছে –‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি: কমবে জীবন ও সম্পদের
ক্ষতি’।
যান্ত্রিক যানের অতিরিক্ত গতি সড়কে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। যে কোনও গতির যান থামাকে নির্দিষ্ট দূরত্ব প্রয়োজন।
যানবাহনের
সামনে যদি মানুষ বা কোনও প্রাণী এসে পড়ে, থামানোর সিদ্ধান্ত নিতেও চালকের
কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয় হয়। এরপর স্বাভাবিকভাবে গাড়ি থামাতে একটি নির্দিষ্ট
দূরত্ব প্রয়োজন হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ কিমি/ঘণ্টা গতির গাড়ি থামাতে ২৭
মিটার দূরত্ব প্রয়োজন। যদি ৫০ কিমি/ঘণ্টায় চলমান একটি যানের ৩৬/৩৭ মিটার
সামনে কোনও মানুষ বা প্রাণী দেখা যায় তবে চালক তার আগেই গাড়ি থামাতে
পারবেন। কিন্তু ৮০ কিমি/ঘণ্টায় চলমান কোনও গাড়ির চালক যদি থামানোর চেষ্টা
করেন, তবু তা ৩৭ মিটার দূরত্বের মানুষকে প্রায় ৬২ কিমি/ঘণ্টা গতিতে ধাক্কা
মারবে। এ ধরনের ধাক্কায় যে কোনও মানুষ মারা যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা
গেছে, ৫ শতাংশ গতি কমালে রোড ক্র্যাশের ঝুঁকি কমে ৩০ শতাংশ। রোড ক্র্যাশের
ঝুঁকি কমার অর্থ মানুষের মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের ঝুঁকি কমে আসা। গতির
কারণে রোড ক্র্যাশের ঝুঁকি যেমন বাড়ে, তেমনি রোড ক্র্যাশের ভয়াবহতাও বাড়ে।
এজন্য গতিসীমা নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কার্যক্রম
গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে সরকার মোটরযান গতিসীমা
নির্দেশিকা ২০২৪ প্রণয়ন করেছে:
এক্সপ্রেসওয়ে ও এ-ক্যাটাগরির জাতীয়
মহাসড়কে কার, মাইক্রো, জিপ ও বাস-মিনিবাস-এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৮০
কি.মি., ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যানেরর গতি ঘণ্টায় ৫০ কি.মি., ও মোটর
সাইকেল-এর গতি ঘণ্টায় ৬০ কি.মি.,
বি-ক্যাটাগরির মহাসড়ক ও আঞ্চলিক
মহাসড়কে কার, মাইক্রো, জিপ ও বাস-মিনিবাস-এর গতি ৭০ কি.মি., ট্রাক,
মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের গতি ৪৫ কি.মি., ও মোটর সাইকেল-এর গতি ঘণ্টায় ৫০
কি.মি.,
জেলা সড়কে সর্বোচ্চ কার, মাইক্রো, জিপ ও বাস-মিনিবাস-এর গতি
ঘন্টায় ৬০ কি.মি., ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের সর্বোচ্চ ৪০ কি.মি. ও মোটর
সাইকেলের গতি ৫০ কি.মি.
শহরের মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং
অভ্যন্তরীণ সড়কে কার, মাইক্রো, জিপ, বাস-মিনিবাসের সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৪০
কি.মি. এবং ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও মোটর সাইকেলের গতি ঘণ্টায়
৩০ কি.মি.;
শহরে দুই লেন বিশিষ্ট ও অবিভক্ত সড়কে কার, মাইক্রো, জিপের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৪০ কি.মি. মোটর সাইকেলের গতি ৩০ কি.মি./ঘণ্টা;
শহরের অন্যান্য সড়কে মোটর গাড়ির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কি.মি. এবং মোটর সাইকেলের গতি ঘণ্টায় ২০ কি.মি. নির্ধারণ করা হয়েছে;
সব
ধরনের মহাসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েতে থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জেলা/উপজেলা ও গ্রামীণ বা শহরে সড়কে অনুমতি সাপেক্ষে চলাচল করতে পারবে,
সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি ৩০ কি.মি./ঘণ্টা রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে
অতিরিক্ত গতি বা গতিসীমা লঙ্ঘণের কারণে দেশে কত মানুষ মারা যায় তার কোনও
পরিসংখ্যান নাই। সড়কে মোট মৃত্যুর তথ্যেও ঘাটতি প্রকট। যেমন: বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে
২০২১ সালে ৩১ হাজার ৫৭৮ জন সড়কে মারা গেছেন এবং একই বছরে সরকারি
তথ্যানুযায়ী ৫ হাজার ৮৪ জন মারা গেছেন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিউরিটি
(বিআরটিএ) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সড়কে ৫ হাজার ২৪ জন মারা গেছে। যদিও
বিভিন্ন বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, আরও অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ
সড়কে মারা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী রোড
ক্র্যাশজনিত (ৎড়ধফ পৎধংয) কারণে বছরে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
দুঃখজনক হচ্ছে, ৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ রোড ক্র্যাশ, যারা
আগামী দিনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে বেশি ভূমিকা রাখতে পারত।
এছাড়া,
৫০ লক্ষাধিক মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়, যারা দীর্ঘস্থায়ী ও চিরস্থায়ী
পঙ্গুত্বের শিকার হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব
ফেলে।
এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী সড়কে মৃত্যুর ২১%
পথচারী, ৫% বাইসাইকেল ব্যবহারকারী, ৩০% মোটর সাইকেলসহ দু’চাকা ও তিন চাকার
যান ব্যবহারীকারী, ২৫% কার, মাইক্রো ও জিপ ব্যবহারকারী এবং ১৯% বাস, ট্রাক,
লরি, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদি ব্যবহারকারী। বিশ্বব্যাপী সড়কে মৃত্যুর ৯২%
ঘটছে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে। উন্নত দেশের
চাইতে উন্নয়নশীল দেশের সড়কে মৃত্যু ৩ গুণ বেশি, অথচ যান্ত্রিক যান
ব্যবহারের হার অনেক কম।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে অধিকাংশ মৃত্যু
প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা,
ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিসসহ বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোড ক্র্যাশ
প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন
অভীষ্ট (এসডিজি)’র ৩.৬ নং লক্ষ্য ‘বিশ্বব্যাপী সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত ও আহতের
সংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে আনা’ নির্ধারণ করে। এছাড়া এসডিজি’র ১১.২ নং লক্ষ্যে
বলা হয়েছে, ‘নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রবীণ মানুষের চাহিদার
প্রতি দৃষ্টি রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সুলভ ও টেকসই পরিবহণ
ব্যবস্থায় সকলের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা’।
বৈশ্বিক বিভিন্ন উদ্যোগের
আলোকে উন্নত দেশ ও শহরগুলো রোড ক্র্যাশ প্রতিরোধে সফলতা পাচ্ছে। এতে দেখা
যায়, ২০১০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়কে মৃত্যু ৫% কমেছে। এ সময়কালে চার
চাকার মোটর যানে মৃত্যুহার ১৯% কমলেও মোটর সাইকেলসহ দু’চাকা ও তিন চাকার
যানবাহনে মৃত্যুহার ৩০% বেড়েছে। বিশেষ করে, বাইসাইকেল ও মোটর সাইকেল
ব্যবহারে মৃত্যু বেড়েছে। এজন্য এ বছরের জাতীয় নিরাপদ সড়কের প্রতিপাদ্য
বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশ সরকার যে মোটরযান
গতিসীমা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এজন্য সড়কের
ধরন ও যানবাহনের ধরন অনুযায়ী গতিসীমা উল্লেখ করে সকল সড়কে সাইনেজ স্থাপনসহ
ব্যাপকভিত্তিক প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। বিআরটিএ’র সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ,
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, ঢাকা পরিবহন সমন্বয়
কর্তৃপক্ষসহ সকল সরকারি সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। শহরের ক্ষেত্রে সিটি
করপোরেশন ও মেট্রোপলিটন পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি
প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ এবং চালক, পরিবহন মালিক ও সড়ক
ব্যবহারকারীদের দায়িত্ববোধ সড়কে নিরাপদ করতে পারে।
নিরাপদ সড়ক দিবসে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও নীতি বিশ্লেষক
aisujon@hotmail.com