আমাদের
এ বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত
পুরস্কার হলো ‘নোবেল পুরস্কার’। এটি একদিকে যেমন একাডেমিক সাফল্যের
পরিচায়ক, অন্যদিকে তেমনি মানবতার অগ্রগতির প্রতীক। আজ থেকে ১২৪ বছর আগে
১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কারের যাত্রা শুরু হয়। সুইডিশ বিজ্ঞানী ও
ডিনামাইট আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেল ১৮৯৫ সালে মৃত্যুর আগে নিজের উইলে তাঁর
সম্পদের একটি বড় অংশ প্রতি বছর মানবকল্যাণে বিশেষ অবদান রাখা ব্যক্তিদের
পুরস্কৃত করার জন্য ব্যয় করা হবে মর্মে নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই
ধারাবাহিকতায় নোবেল পুরস্কারের প্রচলন করা হয়।
শুরুর দিকে পাঁচটি বিভাগে
নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হলেও বর্তমানে ছয়টি বিভাগে নোবেল পুরস্কার
দেওয়া হয়, সেগুলো হলো: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান বা
শারীরবিদ্যা, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতি। ১৯০১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে
মোট ১,০২৬ জনকে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯০ জন ব্যক্তি
(কিছু ব্যক্তি একাধিকবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন) এবং ২৮টি সংস্থা রয়েছে।
প্রত্যেক নোবেল বিজয়ী পান-একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদপত্র এবং একটি নগদ অর্থ
পুরস্কার। পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ প্রতি বছর পরিবর্তিত হয়, যা আসে ‘নোবেল
ফাউন্ডেশন’-এর আয় থেকে। নোবেল আইন অনুসারে, একটি পুরস্কারের পরিমাণ দুই বা
তিনজনের মধ্যে ভাগ করা যেতে পারে, তবে একটি পুরস্কার কখনও তিনজনের বেশি
ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করা যায় না। ২০২৫ সালে, প্রতি পুরস্কারের পরিমাণ ছিল ১১
মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা ($১.২ মিলিয়ন), যা একাধিক বিজয়ী থাকলে ভাগ করে নেওয়া
হয়।নোবেল পুরস্কার পদক ১৮ ক্যারেট পুনর্ব্যবহৃত সোনা দিয়ে তৈরি।
সবচেয়ে
কম বয়সী নোবেল বিজয়ী হলেন মালালা ইউসুফজাই, যিনি ২০১৪ সালে ১৭ বছর বয়সে
শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। জন গুডেনাফ হলেন সবচেয়ে বেশি বয়সী, যিনি ২০১৯
সালে ৯৭ বছর বয়সে রসায়নে পুরস্কার পেয়েছিলেন। সাতজন ব্যক্তি বা সংস্থা
একাধিকবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি তিনবার
নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছে। ১৯১৪-১৯১৬, ১৯৩৯-১৯৪৩ এবং ১৯৪৮ সহ বেশ কয়েক
বছর ধরে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিরা নোবেল পুরস্কার পাননি, যেমন মহাত্মা গান্ধী, বিজ্ঞানী স্টিফেন
হকিং, ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয় সহ আরো অনেকে। শুরু থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত
মাত্র দুজন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। জঁ-পল
সার্ত্র ১৯৬৪ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করেননি। ১৯৭৪ সালে লে ডুক
থো পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে
বেশি নোবেল পুরস্কার (৪২৩টি) বিজয় লাভ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২য়
স্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য (১৪৩) এবং ৩য় স্থানে রয়েছে জার্মানি (১১৫)।
এশিয়া জাপান রয়েছে এ তালিকার ৬ষ্ঠ স্থানে (৩১)। ১৯০১ থেকে ২০২৫ সাল
পর্যন্ত মোট ৬৭ জন এশীয় বংশোদ্ভুত (বাংলাদেশ সহ) নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসা, সাহিত্য, শান্তি এবং
অর্থনীতি এই ছয়টি বিভাগেই এশীয়রা নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। প্রথম এশীয়
হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছিলেন। এক বছরে
এশীয়দের সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে, যখন পাঁচজন
এশীয় বিজয়ী হয়েছিলেন।
২০২৫ সালে বিভিন্ন দেশের মোট ১৪ জন ৬ টি ক্যাটাগরিতে অসামান্য অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
*২০২৫
সালে হাঙ্গেরিয়ান লেখক লাজলো ক্রাজনাহরকাই সমাজ, মানবজীবন ও অস্তিত্বের
গভীর সংকটকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরে ডিস্টোপিয়ান ও গভীর
বিষণœতাময় সাহিত্য রচনার জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। লাজলো
ক্রাজনাহরকাই আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে
বিবেচিত। তাঁর রচনাগুলো। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে
‘সাতানতাঙ্গো’ ও ‘দি মেলানকলি অব রেসিস্টেন্স’ (প্রতিরোধের বিষণ্ণতা) দুটি
উপন্যাসই পরবর্তীতে বিখ্যাত চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়। এর আগে তিনি ২০১৫
সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে ন্যাশনাল বুক
অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার অর্জন করেন।
* শান্তিতে এবারের
নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন ভেনেজুয়েলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার
প্রতিষ্ঠায় অবিরাম প্রচেষ্টা এবং একনায়কতন্ত্র থেকে ন্যায়ভিত্তিক ও
শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণের সংগ্রামের জন্য ভেনেজুয়েলার রাজনীতিবিদ ও
মানবাধিকারকর্মী মারিয়া কোরিনা মাচাদো। মারিয়া কোরিনা মাচাদো লাতিন
আমেরিকার সা¤প্রতিক সময়ের অন্যতম সাহসী ও নিবেদিত শান্তিকর্মীরূপে বিবেচিত।
তিনি ভেনেজুয়েলায় এককালীন বিভক্ত রাজনৈতিক বিরোধকে একত্রিত করতে সক্ষম
হয়েছেন এবং জনগণের ভোট ও প্রতিনিধিত্বকে প্রাধান্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ,
গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
* অর্থনীতিতে নোবেল
পুরস্কারটি ১৯৬৯ সাল থেকে প্রদান করা হচ্ছে। ২০২৫ সালে অর্থনীতিতে নোবেল
পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন। তারা হলেন-ইওয়েল মোকিয়র (নেদারল্যান্ডস), ফিলিপ
আগিয়োঁ (ফ্রান্স) ও পিটার হাউইট (কানাডা)। উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করার জন্য ২০২৫সালে তাদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্তগুলো চিহ্নিত করার
জন্য পুরস্কারের অর্ধেক পেলেন ইওয়েল মোকিয়র। সৃজনশীল বিনাশের মাধ্যমে
টেকসই প্রবৃদ্ধির তত্ত¡ প্রণয়নের জন্য বাকি অর্ধেক যৌথভাবে পেলেন ফিলিপ
আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট।
* চলতি বছরের (২০২৫ সালে) চিকিৎসাবিজ্ঞান ও
শারীরতত্তে¡ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেরি ব্রাঙ্কো,
ফ্রেড রামসডেল এবং শিমন সাগাগুচি। তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে
‘পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স’ বিষয়ক অসাধারণ গবেষণার জন্য। ‘পেরিফেরাল ইমিউন
টলারেন্স’ হলো শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া -
যার মাধ্যমে শরীরের নিজস্ব উপাদান এবং ক্ষতিকারক নয় এমন বহিরাগত উপাদান
(যেমন: কিছু খাদ্য উপাদান, উপকারী অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া) এর বিরুদ্ধে
অনাকাক্সিক্ষত বা অতিরিক্ত প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা থেকে বিরত
রাখে। এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে অটোইমিউন রোগ অ্যালার্জি ও অঙ্গ
প্রতিস্থাপনজনিত জটিলতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে
করছেন বিশেষজ্ঞরা।
* পদার্থবিজ্ঞানে ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ
করেছেন তিনজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী-ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন ক্লার্ক, ফরাসি
বিজ্ঞানী মিশেল এইচ. ডেভোরেট এবং মার্কিন বিজ্ঞানী জন এম. মার্টিনিস।
ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং ইলেকট্রিক সার্কিটে
এনার্জি কোয়ান্টাইজেশন গবেষণার জন্য, বৈদ্যুতিক সার্কিটে বা বৃহদাকার
কোয়ান্টাম যান্ত্রিক টানেলিং ও শক্তির কোয়ান্টাইজেশন বিষয়ক যুগান্তকারী
আবিষ্কারের জন্য এ পুরস্কারে ভূষিত হন।
* ২০২৫ সালের রসায়নে নোবেল
পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছেন তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী-জাপানের কিয়োটো
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুসুমু কিতাগাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড রবসন, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলের অধ্যাপক ওমর এম. ইয়াগি। ‘মেটাল-অর্গানিক
ফ্রেমওয়ার্ক’ উন্নয়নের জন্য তাদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাঁদের এই
অগ্রণী কাজের ফলে রসায়নবিদেরা এখন পর্যন্ত দশ হাজারেরও বেশি ভিন্ন ধরনের
মেটাল–অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছেন। এই উপকরণগুলোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে
পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পানির বিশুদ্ধকরণ, কার্বন ডাই অক্সাইড সংরক্ষণ এবং
মরুভূমির বাতাস থেকে পানি আহরণের মতো বৈপ্লবিক সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
এ
বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কার প্রদানের নিয়ম
চলমান থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় ‘নোবেল পুরস্কার' হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম
মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তাই এ পুরস্কার নিয়ে
মাতামাতিও হয় বেশি। আসছে বছর কারা এ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পাচ্ছেন এবং কোন
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পাচ্ছেন তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে নীতিনির্ধারক,
শিক্ষাবিদ, মিডিয়াকর্মী, সমাজ কর্মীদের মাঝে জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে
পুরস্কার ঘোষনার অনেক আগ থেকে। সম্ভাব্য নোবেলজয়ীরা কে কোন ক্ষেত্রে
বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কি ভূমিকা পালন করছেন তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে
থাকে। আদতেই তাই, নোবেল পুরস্কারে ভূষিতদের কর্মের অবদান বিশ্বের তাবৎ
মানুষের স্বাস্থ্য, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রেখে চলেছে। আসুন এ গ্রহের এবং এ গ্রহে বসবাসরত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে
ভূমিকা রাখা সব নোবেল বিজয়ীদের অভিনন্দন জানাই।
লেখকঃ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।