আমরা আচমকা
কিছু ঘটার ক্ষেত্রে কাকতালীয় বাগধারাটা ব্যবহার করে থাকি। এই কাক এবং তাল
দুটোই বাংলার ঐতিহ্য। শহরের ছাদ থেকে যেমন হারিয়ে যাচ্ছে কাক, ঠিক একইভাবে
গ্রামের রাস্তার পাশ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে তালগাছ। মাত্র সামান্য অর্থের
জন্যই মানুষ এই গাছ বিক্রি করছে অহরহ। ফলে এর প্রভাব যে কতটা ভয়ংকর দিকে
যাচ্ছে তা আমরা আঁচ করতে না পারলেও গবেষণা আমাদেরকে এক অশনি সংকেতের বার্তা
দেয়। তালগাছ কেবল ফল বা ছায়া দেয় না, বরং একপ্রকার প্রাকৃতিক নিরাপত্তার
প্রতীক হিসেবেও দেখা হতো। কৃষকরা বিশ্বাস করতেন, তালগাছ বজ্রপাত টেনে নেয়,
তাই এর আশেপাশে মানুষ ও গবাদিপশু নিরাপদ থাকে।
মূলত, এই বিশ্বাস থেকেই
মাঠ, খালপাড়, পুকুরের ধারে ও সড়কের পাশে তালগাছ লাগানোর ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে।
যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে বিষয়টির আংশিক যুক্তি রয়েছে। তালগাছের গঠন উঁচু ও সরল,
আর ভেতরে প্রচুর জলীয় উপাদান থাকে। ফলে এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক বিদ্যুৎ
পরিবাহক হিসেবে কাজ করতে পারে। বজ্রপাতের সময় গাছটি সেই শক্তি শোষণ করে
মাটিতে নামিয়ে দিতে পারে, যা আশেপাশের মানুষ বা প্রাণীর জন্য তুলনামূলক
নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক
ড. মো. শহীদুল ইসলাম মনে করেন, “তালগাছ একধরনের প্রাকৃতিক বজ্রনিরোধক
হিসেবে কাজ করতে পারে, তবে সেটি শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। গাছের গঠন ও
পরিবেশের আর্দ্রতা বজ্রপাতের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে মাত্র।”
আঞ্চলিক
কৃষি সম্প্রাসণ কার্যালয়ে তথ্যমতে, কুমিল্লা অঞ্চলে ২০০০ সালের পূর্বে যত
পরিমাণ তালগাছ ছিল তার প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এখন। ব্যক্তি পর্যায়ে
নতুন করে তালগাছ রোপণের মাত্রা ৫ শতাংশের চেয়েও কম। ফলে তালগাছ রোপণের চেয়ে
নিধনের হার যে অতিমাত্রায় তা এমনিই বুঝা যায়। উদাহরণস্বরুপ, কুমিল্লা
জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলায় সুয়াগঞ্জ বাজার হতে লামপুর-তালপট্টি সড়কের
দুইপাশে পূর্বে প্রায় চারশো এর অধিক তাল গাছ ছিল। যার পরিমাণ এখন পঞ্চাশেরও
নিচে। ফলে এই সড়কে এই বিশাল সংখ্যক তালগাছ নিধনের পরে নতুন তালগাছ রোপণের
কোনো উদ্যোগ নেই।
যদিও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশব্যাপী প্রায় এক
মিলিয়ন তালগাছ লাগানোর প্রকল্প হাতে নেয়। উদ্দেশ্য ছিল বজ্রপাতজনিত
প্রাণহানি কমানো। প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোরসহ
দেশের বিভিন্ন জেলায় রাস্তার ধারে ও খোলা মাঠে তালগাছ রোপণ করা হয়। কিন্তু
এই উদ্যোগ কুমিল্লায় ছোঁয়া পেয়েছে কিনা তার তথ্য প্রমাণ নেই। তবে সম্প্রতি
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়
পর্যায়ের সংগঠনগুলো উদ্যোগ নিয়ে তালগাছ রোপণের মত প্রসংশনীয় কাজ করে
যাচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে প্রায় ৩৫০ জনের মৃত্যু হয় বলে
মনে করেন আবহাওয়া বিষয়ক আন্তঃসরকার সংস্থা রাইমসের (রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড
মাল্টি হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম) আবহাওয়া বিশেষজ্ঞবিদ। বজ্রপাতের
জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হলো সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেট।
বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি থাকে। এই উপাত্তে
কুমিল্লা অঞ্চলের জন্য একটা ইতিবাচক তথ্য রয়েছে। তা হচ্ছে, বিশেষ অঞ্চল
যেমন নদী, হাওর, খাল, বিল ইত্যাদিতে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। সুতরাং ভৌগলিকভাবে
কুমিল্লায় বজ্রপাতের অনুপাত কম।
তবে শুধুমাত্র তালগাছের ওপর নির্ভর করে
বজ্রপাত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের প্রযুক্তিগত সমাধান ও সচেতনতা
বাড়াতে হবে। তারমধ্যে স্কুল, হাসপাতাল, বাজার, উঁচু ভবন ও ধর্মীয় স্থাপনায়
বজ্রনিরোধক (খরমযঃহরহম অৎৎবংঃড়ৎ) বসানো উচিত। এছাড়াও বজ্রপাতের সময় খোলা
মাঠ, নদী, পুকুর বা উঁচু গাছের নিচে না থাকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
লেখক: প্রধান, জনসংযোগ বিভাগ, আশা ইউনিভার্সিটি।