
*৮৪২ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২১০ জন
* খানাখন্দ বেড়েছে সড়ক-মহাসড়কে
* কাজে লাগছে না সিসি ক্যামেরা
* দ্বিগুণ বেশি অবৈধ যানবাহন ও চালকহাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নে প্রতিদিন গড়ে তিনটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুইজন মানুষ প্রাণ হারান। আর এসব দুর্ঘটনায় প্রতিদিন পাঁচজন মানুষ আহত হন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, কুমিল্লা-নোয়াখালী, কুমিল্লা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৭৯২ কিলোমিটার সড়কে চলতি বছরের নয় মাসে দুর্ঘটনার এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়ন সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কুমিল্লা রিজিয়নের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৮৪২ টি দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৫২৫ জন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ২১০ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত মহাসড়কে ৪৬৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছেন ২৮৪ জন। আহতের সংখ্যা ৫০৯ জন।
তবে হাইওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যানে ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে কুমিল্লা রিজিয়নে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৪ সালে এই অঞ্চলটিতে সড়ক দুর্ঘটনা সংখ্যা ছিল ৬৩০টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি সংখ্যা ৫২২এবং মোট আহত ৭৮৪ জন। চলতি বছর দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার বিগত বছরকে ছাড়িয়ে অন্তত দুই গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিওনের পুলিশ সুপার মোঃ শাহীনূর আলম খান বলেন, যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটছে- তা দুঃখজনক। আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি সড়ক নিরাপত্তা দিতে। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই অতিরিক্ত গতি, অসচেতন পারপার এবং ভাঙ্গাচুরা সড়কের কারণে ঘটছে। যে কারণে শুধু হাইওয়ে পুলিশ নয়, সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে সমন্বিত প্রচেষ্টায় সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি - বিআরটিএ কুমিল্লা কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিবহন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে- ৪০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনা অতিরিক্ত গতির জন্য হয়ে থাকে। গতি নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করলেও অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে বিআরটিএ কিংবা পুলিশ কেউই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সক্রিয়তা রাখতে পারছে না।
সংবাদকর্মী আব্দুল্লাহ আল মারুফ জানান, '৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে মহাসড়কে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বিগত বছরের তুলনায় দুর্ঘটনায় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। হাইওয়ে পুলিশ সক্রিয় থাকলে যানবাহন অতিরিক্ত গতিতে চলতে পারবেনা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ধরপাকড়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হবে, লাইসেন্সবিহীন চালকদেরকেও সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা যাবে। সে ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না, তারাও সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করলে মহাসড়ক সুশৃংখল হবে। এছাড়া গত এক বছর ধরে মহাসড়ক ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক খানাখন্দ এবং ভাঙাচুরায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। যে কারণে অনেক যানবাহন নষ্ট হবার পাশাপাশি, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি এবং হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে।'
দ্বিগুণ বেশি অবৈধ যানবাহন ও চালক:
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ- সভাপতি অধ্যক্ষ কবির আহমেদ বলেন, 'বৈধ গাড়ির চেয়ে অন্তত ২০ গুণ রয়েছে অবৈধ গাড়ি। দুর্ঘটনার পরিসংখ্যা নিয়েই পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ৯০ ভাগ দুর্ঘটনায় ঘটছে বৈধ গাড়ি এবং অবৈধ গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষে। এছাড়া অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, মহাসড়কে থ্রি হুইলার, অবৈধ স্থাপনা ও বাজার এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতা দুর্ঘটনার জন্য ম‚ল দায়ী।'
লাইসেন্সবিহীন চালক প্রসঙ্গে কবির আহমেদ বলেন, 'আমাদের দেশে মোট ৬২ লাখ যান্ত্রিক যানবাহন বিআরটিএ তে রেজিস্ট্রেশন করা আছে। ৬২ লাখের মধ্যে ৪৬ লাখই মোটরসাইকেল। বাকিগুলো হলো বাস ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহন। বিআরটিএ এযাবত সব লাইসেন্স মিলিয়ে ডেলিভারি দিয়েছে ২৯ লাখ চালকের লাইসেন্স। কি ভয়াবহ চিত্র যে, বাকি ৩২ লাখ গাড়ি চলাচল করে লাইসেন্সবিহীন চালক দ্বারা। এছাড়াও তিনি বলেন, বিআরটিএ এর কাছে পরিবহনের সংখ্যা নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য আছে কিনা তাও জানা নেই। কারণ একই রুটে কি পরিমান যানবাহন চলবে সেটি কখনোই নির্ধারিত হয়নি।'
কাজে লাগছে না সিসি ক্যামেরা :
নিরাপত্তা ও গতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আড়াইশ কিলোমিটার দ‚রে প্রায় দেড় হাজার সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। তবে সব ক্যামেরা থেকেই এখনো কোন ডাটা নিতে পারছ না হাইওয়ে পুলিশ। কিছু কিছু এলাকা থেকে অতিরিক্ত গতির যানবাহন সনাক্ত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে। তবে পুরো সড়কে যেসব ক্যামেরা লাগানো হয়েছে সেগুলো থেকে প‚র্ণাঙ্গ তথ্য পেলে আরো বেশি নিরাপদ হবে মহাসড়ক।
হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিওনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মোঃ শাহীনূর আলম খান বলেন, মহাসড়ক নিরাপত্তায় স্থাপন করা সিসি ক্যামেরাগুলোর দায়িত্ব এখনো হাইওয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। আমরা আশা করছি খুব শীঘ্রই তা পুলিশের কাছে আসবে। যেসব ক্যামেরা গুলো সচল রয়েছে সেগুলো মেঘনা ঘাটে একটি কন্ট্রোল রুম থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। ৫ আগস্ট কিছু ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো আশা করি খুব দ্রæত মেরামত করা হবে।
মহাসড়কে চলাচলকারী অবৈধ থ্রি হুইলার প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার শাহীন‚র আলম বলেন, মহাসড়কে গণপরিবহন না বাড়ানো হলে থ্রি হুইলার একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এখানে অনেক মানুষের জীবিকাও জড়িত। তবে আমরা চেষ্টা করছি তারা যেন গুরুত্বপ‚র্ণ এলাকাগুলোতে মহাসড়কে প্রবেশ করতে না পারে।
খানাখন্দ বেড়েছে সড়ক-মহাসড়কে:
হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ৬২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। খানাখন্দ ভাঙ্গাচোরায় বেহাল অবস্থা এই সড়কের। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকাছাড়াও সড়ক ও জনপদ বিভাগের আওতাধীন আঞ্চলিক সড়কগুলো ভেঙে আছে বিপর্যস্ত ভাবে।
কুমিল্লা সিলেট মহাসড়কের সুগন্ধা পরিবহনের চালক আবুল হাসান বলেন, 'কুমিল্লা সিলেট মহাসড়কে এমন কোন দিন নেই যে দুর্ঘটনা ঘটে না। শুধুমাত্র সড়কের বেহাল অবস্থার কারণেই এই সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে প্রতিদিন। সরু এবং ভাঙাচোরা সড়ক হওয়ায় ভারি যাত্রীবাহী ও মালবাহী যানবাহনের সাথে ছোট ছোট যানবাহনের সংঘর্ষে প্রায়ই প্রাণহানি এবং অঙ্গ হানির ঘটনা ঘটছে। এসব বলে বলেও আমরা এখন ক্লান্ত।'
কুমিল্লা সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আদনান ইবনে আলম বলেন, 'বিগত বছরের বন্যা এবং এবছরের প্রবল বর্ষণে সড়ক ও জনপদ বিভাগের আওতায় কুমিল্লাতে দেড় শ কিলোমিটার সড়ক বিধ্বস্ত হয়ে আছে। আমরা আসন্ন ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির মধ্যে সকল ভাঙ্গা সড়কের মেরামত কাজ শেষ করতে পারব বলে আশা করছি।'