রবিবারের নামচা
ক্রাসনাহোরকাই এবং বেলার
উপর নিৎশে ভর করেছিলেন

কায়সার হেলাল ।।
১.
১৮৮৯
সালের ৩ জানুয়ারি, ইতালির তুরিন শহরের কার্লো আলবার্তো স্কয়ারে এক
অসাধারণ ঘটনা ঘটে যা পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসে একটি নির্ণায়ক মুহ‚র্ত হিসেবে
চিহ্নিত হয়ে আছে। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎশে সেদিন দেখেন একটি
ঘোড়াকে তার মালিকের হাতে নির্মমভাবে চাবুক খেতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা
অনুযায়ী, নিৎশে ঘোড়াটির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন এবং তারপর মাটিতে পড়ে
যান। এই ঘটনার পর তিনি আর কখনো সম্প‚র্ণ সচেতন অবস্থায় ফিরে আসেননি। জীবনের
শেষ এগারো বছর তিনি কাটিয়েছেন প্রায় সম্প‚র্ণ নীরবতা ও মনোবৈকল্যে, প্রথমে
তার মায়ের, তারপর বোন এলিজাবেথের তত্ত¡াবধানে। তাঁর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং
ধারণা ‘ইটার্নাল রিকারেন্স’ বা চিরন্তন পুনরাবৃত্তি প্রস্তাব করে, যদি
আমাদের জীবন অসীমকাল ধরে হুবহু একইভাবে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, তবে আমরা কি
এমনভাবে বাঁচছি যে এই পুনরাবৃত্তি মেনে নিতে পারব? এই চিন্তা-পরীক্ষা
মানুষকে তাদের প্রতিটি মুহ‚র্তকে অর্থপ‚র্ণ করতে এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তকে
গুরুত্বের সঙ্গে নিতে আহ্বান জানায়। নিৎশে ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন
এই অর্থে যে আধুনিক যুগে ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব তার সামর্থ্য হারিয়েছে এবং এই
শ‚ন্যতা প‚রণ করতে মানুষকে নিজেই অর্থ ও ম‚ল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। যিনি
‘উবারমেনশ্’ বা অতিমানবের ধারণা প্রচার করেছিলেন, যিনি শক্তি ও ক্ষমতার
দর্শন রচনা করেছিলেন, সেই মানুষই একটি অসহায় প্রাণীর কষ্টের সামনে
সম্প‚র্ণভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। এই ঘটনা কি তাঁর নিজ দর্শনেরই বিরোধিতা, নাকি
মানুষের গভীরতম সত্যের প্রকাশ?
প্রায় একশ বছর পর, হাঙ্গেরিয়ান লেখক
লাজলো ক্রাসনাহোরকাই (খপ্সংুষষ্ট কৎধংুহধযড়ৎশধর) এবং চলচ্চিত্র পরিচালক
বেলা তার (ইল্কষধ ঞধৎৎ) নিৎশের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি করেন ‘দ্য তুরিন
হর্স।’ যদিও তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতা শুরু হয়েছিল আরও আগে, আরেকটি
মহাকাব্যিক কাজের মাধ্যমে, যার নাম ‘স্যাটানটেঙ্গো।’ ক্রাসনাহোরকাই এবং
বেলা, এই দুই হাঙ্গেরিয়ান শিল্পী, বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং একুশ শতকের
শুরুতে সিনেমা ও সাহিত্যে এমন কিছু সৃষ্টি করেছেন যা নির্মাণের ধারা ও
শ্রেণীবিভাগকে অতিক্রম করে যায়। লাজলো ক্রাসনাহোরকাই সাহিত্যে নোবেল
পুরস্কার লাভ করেন এ বছর ২০২৫ সালে। মজার ব্যাপার হলো, তাঁর কোন লেখার
সঙ্গেই প‚র্বে সরাসরি পরিচয় ছিল না। নোবেল প্রাপ্তির পর অনলাইন ঘেঁটে
বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করলাম তাঁর লেখাকে ভিত্তি করে তৈরি হওয়া দুটি সিনেমা
আমার বহু আগেই দেখা! এই সিনেমাগুলো দেখেছিলাম ম‚লত পরিচালক বেলার খ্যাতির
জন্য। আর নিৎশে তো আমাদের ভেতর শ‚ন্যতাবোধের বীজ বপন করে রেখেছিলেন সেই
কবেই। সে স‚ত্রে এবং কৌতুহলের বশে কোন এক কালে ‘দ্য তুরিন হর্স’
চলচ্চিত্রটি দেখে ফেলেছিলাম। তুরিন হর্সের পর স্যাটানটেঙ্গোও দেখা হয়েছিল ঐ
একই সময়ে। স্যাটানটেঙ্গো সাড়ে সাত ঘন্টার সিনেমা। সিনেমাটির অভ্যন্তরিন
কাহিনী, জটিলতা, আর অন্তর্গত দর্শনই বলে দেয় লাজলোর লেখা কেমন হবে। তাও
অনুসন্ধিৎসু মনে তাঁর বেশ কয়েকটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ ডাউনলোড করলাম। বিশেষ
করে স্যাটানটেঙ্গো (জর্জ সিয়ের্তেসের অনুবাদ) পড়া শুরু করলাম। ফলে এই
লেখাটি হতে যাচ্ছে ‘স্যাটানটেঙ্গো’ উপন্যাস ও চলচ্চিত্র, এবং ‘দ্য তুরিন
হর্স’ চলচ্চিত্রের পাঠ ও দর্শন পরবর্তী প্রতিক্রিয়া। উপন্যাস পড়তে গিয়ে
যদ্দুর বুঝলাম তাঁর লেখার ভাষা অত্যন্ত স্বতন্ত্র। অবিশ্বাস্য দীর্ঘ বাক্য
যা কখনো কখনো কয়েক পৃষ্ঠা ধরে চলে। ন্য‚নতম বিরামচিহ্ন এবং কমা দিয়ে যুক্ত
হতে থাকা চিন্তাধারা যেন একটি অন্তহীন সর্পিল প্রবাহ যা পাঠককে টেনে নিয়ে
যায় গহীন থেকে গহীনে। তার লেখার বিষয়বস্তু সিনেমাগুলোর মতোই বিষণœতাগামী।
ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ, পরাজিত মানুষ, ব্যর্থ স্বপ্ন, আর মিথ্যা আশার কথা বলে।
মনে হয় যেন স্বয়ং নিৎশে উপন্যাস লিখতে বসেছেন! কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যেও
লাজলোর লেখায় কাব্যিক সৌন্দর্য আছে, আছে সু² গৌরব যা ধ্বংসের মুখেও টিকে
থাকে। তিনি হাঙ্গেরির গ্রামাঞ্চল, ছোট শহর, পতিত কমিউনিস্ট পরবর্তী সমাজের
গল্প লেখেন, কিন্তু এই গল্পগুলো হয়ে ওঠে সার্বজনীন অবস্থা, অস্তিত্বের
নিরর্থকতা, এবং তবুও বেঁচে থাকার অদ্ভুত প্রয়োজনীয়তার গল্প।
২.
স্যাটানটেঙ্গো
১ম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে যখন হাঙ্গেরি তখনও সোভিয়েত বøকের অংশ, যদিও সেই
ব্যবস্থা স্পষ্টভাবে ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। উপন্যাসটি এই ক্ষয়ের, এই
পতনের, এই মৃত্যুর দলিল। গল্পটি ঘটে একটি নাম না জানা গ্রামে, যেখানে একটি
কৃষি সমবায় বা কলেক্টিভ ফার্ম অকৃতকার্য হয়েছে, যা ম‚লত সমাজতান্ত্রিক
কৃষির প্রতীক। সেখানে বাস করে কিছু মানুষ, যেমন, ফুটাকি ও তার স্ত্রী মিসেস
শ্মিত, ক্রেইনার ও তার স্ত্রী, এবং আরও কিছু চরিত্র। এরা সবাই দরিদ্র,
মদ্যপ, হতাশাগ্রস্ত, এবং একে অপরের প্রতি চ‚ড়ান্ত অবিশ্বাসী। তারা একটি
অর্থম‚ল্যের জন্য অপেক্ষা করছে যা তাদের পাওনা, এবং প্রত্যেকে গোপনে
পরিকল্পনা করছে কীভাবে সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে, কীভাবে অন্যদের ঠকাবে।
গ্রামটি শারীরিক ও নৈতিক উভয় অর্থেই ক্ষয়িষ্ণু। ভবনগুলো ভেঙ্গে পড়ছে,
বৃষ্টি লাগাতার পড়ছে, চারদিকে কাদা, এবং মানুষগুলো আত্মিকভাবে মৃত। এই
পরিবেশে সবচেয়ে দুর্বল হলো এস্তিকে নামের একটি ছোট্ট মেয়ে, যাকে তার ভাই
এবং অন্যরা সম্প‚র্ণভাবে অবহেলা করে। মেয়েটি একটি বিড়ালকে অত্যাচার করে এবং
শেষে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। তার মৃত্যু যেন পুরো গ্রামের উপর নৈতিক
দেউলিয়াত্বের সিল মেরে দেয়।
ঠিক এই মুহ‚র্তে খবর আসে যে ইরিমিয়া এবং তার
সঙ্গী পেট্রিনা ফিরে আসছে। এই দুজন আগে গ্রামে ছিল কিন্তু গ্রাম ছেড়ে চলে
গিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল তারা মারা গেছে। ইরিমিয়ার নাম বাইবেলের ভাববাদী
জেরেমিয়ার হাঙ্গেরিয়ান রূপান্তর। তার আগমন গ্রামবাসীদের মধ্যে মেসায়ানিক
প্রত্যাশা জাগায়। ইরিমিয়া লম্বা, কালো পোশাক পরা, রহস্যময়, এবং তার কথায়
সম্মোহনী শক্তি আছে। সে গ্রামবাসীদের স্বপ্ন দেখায় একটি নতুন জায়গায়
যাওয়ার, নতুন জীবন শুরু করবার। তার কথায় মুগ্ধ হয়ে তারা তাদের সমস্ত টাকা
তাকে দিয়ে দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় যে ইরিমিয়া আসলে একজন সরকারী
গোয়েন্দা, একজন তথ্যদাতা, এবং সে এই সরল মানুষগুলোকে ব্যবহার করছে তার
নিজের উদ্দেশ্যে। যে নতুন গ্রাম, যে নতুন জীবনের স্বপ্ন সে দেখিয়েছিল, সবই
মিথ্যা প্রমাণিত হয়। মানুষগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, গ্রাম খালি হয়ে যায়, এবং
শেষে থেকে যায় শুধু ডাক্তার নামের একজন চরিত্র। এই ডাক্তার চরিত্রটি
উপন্যাস ও পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে অতিশয় গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা পালন করে।
উপন্যাস বা চলচ্চিত্রটি সমাপ্ত হবার পর পাঠক বা দর্শকের মনে হবে যে এই
ডাক্তার চরিত্রটিই বোধহয় ক্রাসনাহোরকাই কিংবা বেলা স্বয়ং।
উপন্যাসের গঠন
লেখকের নিগুঢ় চিন্তার ফসল এবং নামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এটি
বারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত, প্রথম ছয়টি অধ্যায়ে সময় এগিয়ে যায়, তারপর পরবর্তী
ছয়টিতে পিছিয়ে এসে একই ঘটনাগুলো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বলে। এই গঠন টেঙ্গো
নৃত্যের অনুকরণ। ‘স্যাটান’ বা শয়তান যুক্ত হয়ে শব্দটি ‘স্যাটানটেঙ্গো’ হয়ে
ওঠে, যার মানে হতে পারে ‘শয়তানের টেঙ্গো নৃত্য।’ এটি এমন এক লক্ষ্যহীন
নৃত্য যা শুধু ঘুরপাক খায় আর চক্রাকার নরক তৈরি করে। নৃত্যের এই অদ্ভুত
ব্যাকরণ ম‚লত এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় থিম যেখানে দেখানো হয় যে মানুষের
জীবনও শয়তানের টেঙ্গো নাচের মত অর্থহীন ঘ‚র্ণন, যেখানে আমরা মনে করি এগিয়ে
যাচ্ছি কিন্তু আসলে একই জায়গায় থেকে যাচ্ছি। এটি নিৎশের চিরন্তন
পুনরাবৃত্তির ধারণার এক নিরংশু প্রতিফলন- একই কষ্ট, একই পরাজয়, বারবার ফিরে
আসে। উপন্যাসের রাজনৈতিক প্রসঙ্গও অতীব গুরুত্বপ‚র্ণ। ১৯৮০’র দশকের
মাঝামাঝি হাঙ্গেরিতে কমিউনিস্ট শাসন শেষ পর্যায়ে। যে ইউটোপিয়ান স্বপ্ন দিয়ে
এই ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল, অর্থ্যাৎ, সমতা, ভ্রাতৃত্ব, সমবায়, তা পরিণত
হয়েছিল নিপীড়ন, দারিদ্র্য, এবং হতাশায়। একসঙ্গে কাজ করবার কথা ছিল যাদের
তারা একে অপরকে ঠকাচ্ছে। ইরিমিয়া, যে একজন গোয়েন্দা, রাষ্ট্রযন্ত্রের
প্রতিনিধি, কিন্তু সেই রাষ্ট্র নিজেই ফাঁপা এবং ক্ষয়িষ্ণু। তার প্রতিশ্রæত
নতুন গ্রাম একটি ভ্রম, ঠিক যেমন কমিউনিজমের প্রতিশ্রæত স্বর্গ। কিন্তু
ক্রাসনাহোরকাই শুধু রাজনৈতিক ব্যঙ্গ লেখেননি, তিনি লিখেছেন মানবিক অবস্থার
নিবিড় অন্বেষণ। এই গ্রামটি হাঙ্গেরির যেকোনো গ্রাম হতে পারে, বা হতে পারে
পৃথিবীর যেকোনো জায়গা যেখানে মানুষ পরাজিত, প্রতারিত, এবং হতাশ। এই উপন্যাস
যতটা না রাজনৈতিক ভাষ্য তারচে অধিক মানব-অস্তিত্বের ল্যান্ডস্কেপ।
১৯৯৪
সালে বেলা এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেন এবং এই রূপান্তর
চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এমনকি, বলা যায় এটি চলচ্চিত্রের ভাষাকে
পুনর্সংজ্ঞায়িত করেছে। বেলা তারের জন্ম ১৯৫৫ সালে হাঙ্গেরিতে। তিনি
চলচ্চিত্রকে দেখতেন সময়ের শিল্প হিসেবে এবং বেলার কাজ এই দৃষ্টিভঙ্গিরই
সবচেয়ে চরম প্রকাশ। তার সিনেমার সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো অতিমাত্রার
দীর্ঘ শট, যা কখনো কখনো দশ-বারো মিনিট বা তারও বেশি সময় ধরে চলে। এই
বিরতিহীন শটগুলোতে ক্যামেরা সাবলীলভাবে চলাচল করে, কখনো চরিত্রদের অনুসরণ
করে, কখনো ল্যান্ডস্কেপ পর্যবেক্ষণ করে, এবং দর্শক অনুভব করেন সময়ের প্রকৃত
ওজন ও প্রবাহ। তার সিনেমায় কাট খুব কম, সম্পাদনা ন্য‚নতম, এবং এর ফলে
দর্শক এক অবিচ্ছিন্ন বাস্তবতার অভিজ্ঞতা পান যা প্রচলিত সিনেমায় দুর্লভ।
তিনি প্রায় সবসময় সাদা-কালো চিত্রায়ণ পছন্দ করতেন, যা তীক্ষè কনট্রাস্ট এবং
কালোত্তীর্ণ গুণমান তৈরি করে। তার সিনেমায় সংলাপ কম, বেশিরভাগ সময়
প্রাকৃতিক শব্দ- বাতাস, বৃষ্টি, পদচারণা- এবং মাঝে মাঝে সংগীত যা
সাধারণভাবে মিহালি ভিগের (তিনি প্রধান চরিত্র ইরিমিয়ার ভুমিকায়ও অভিনয়
করেছেন) রচিত, সরল কিন্তু অগাধ মর্মস্পর্শী।
স্যাটানটেঙ্গো চলচ্চিত্রে
বেলা ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সিনেমাটিক ভাষায় নিখুঁতভাবে
তর্জমা করেন। উপন্যাসের বিস্তীর্ণ নিরবচ্ছিন্ন বাক্যগুলোও হয়ে ওঠে লম্বা
প্রবহমান শট। উপন্যাসের চক্রাকার গঠন চলচ্চিত্রেও বজায় থাকে। বারোটি
অধ্যায়, যেখানে একই ঘটনা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়। ছবির শুরুর
দৃশ্যটি এখন পর্যন্ত ক্লাসিক হয়ে আছে- একপাল গরু ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে
একটি ভাঙ্গা, পরিত্যক্ত খামারের মধ্য দিয়ে, কুয়াশা ও ধ্বংসস্ত‚পের মধ্যে।
ক্যামেরা প্রায় দশ মিনিট ধরে তাদের অনুসরণ করে, কোনো কাট ছাড়াই। এই দৃশ্যে
কোনো নাটকীয় ঘটনা নেই, কোনো সংলাপ নেই, শুধু চলাচল, শুধু সময়ের প্রবাহ।
কিন্তু এই দৃশ্য দর্শককে প্রবেশ করায় এমন এক জগতে যেখানে সময়ের নিয়ম ভিন্ন,
যেখানে আধুনিক জীবনের দ্রæততা কাজ করে না, যেখানে আমরা বাধ্য হই থামতে,
দেখতে, অনুভব করতে।
পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে বৃষ্টি পড়তে থাকে। নিরন্তর,
একঘেয়ে বৃষ্টি যা সবকিছু কাদায় পরিণত করে। চরিত্ররা হাঁটে কাদার মধ্য দিয়ে।
ধীরে, কষ্ট নিয়ে। তাদের মুখ ক্লান্ত ও অভিব্যক্তিহীন। গাবোর মেদভিগির
সিনেমাটোগ্রাফি অতুলনীয়। তিনি তৈরি করেন এমন ভিজ্যুয়াল যা একইসঙ্গে সুন্দর ও
ভয়াবহ। ভাঙ্গা ভবন, খালি জানালা, ধ্বংসস্ত‚প, কাদামাখা রাস্তা- সবকিছু
তীক্ষè কনট্রাস্টে চিত্রায়িত, যেন রেমব্রান্ট বা কারাভাজিওর পেইন্টিং।
প্রতিটি ফ্রেম যতœ সহকারে কম্পোজ করা। প্রতিটি ছবি যেন একটি স্থির চিত্র যা
চলমান হয়ে উঠেছে। এই কাদা, এই বৃষ্টি, এই ধ্বংসলীলা হয়ে ওঠে সেই সমাজের
প্রতীক যেখানে চরিত্ররা শারীরিক ও আত্মিক উভয় অর্থেই আটকা পড়ে আছে।
এস্তিকের
দৃশ্যগুলো চলচ্চিত্রের একইসঙ্গে অসামান্য ও পীড়াদায়ক অংশ। সেই ছোট্ট
মেয়েটি, যার কেউ যতœ নেয় না। সম্প‚র্ণ একা। সে একটি বিড়ালকে ধরে এবং
অত্যাচার করে যা একটি একটানা, প্রায় অসহনীয় দৃশ্য, যেখানে আমরা দেখি কীভাবে
নিজে নিপীড়িত হয়ে একজন আরও দুর্বলকে নিপীড়ন করে। তারপর সে বিষ খেয়ে মারা
যায়। তার মৃত্যুর দৃশ্য অতি করুণ কিন্তু ভাবপ্রবণ নয়। বেলা শুধু তাই দেখান
যা ঘটে। দর্শকের মেজাজের গতিমুখ বদলে দেবার জন্য এই পর্যায়ে তিনি কোনো
সংগীত প্রয়োগ করেননি। কোনো ক্লোজআপ নেই আবেগ জাগানোর জন্য। শুধু নগ্ন সত্য।
এস্তিকের চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করে সমস্ত নিষ্কলুষতার ও দুর্বলতার যা এই
নিষ্ঠুর জগতের চরম সত্য।
অন্যদিকে, ইরিমিয়ার চরিত্রে মিহালি ভিগের অভিনয়
মন্ত্রমুগ্ধকর। তিনি লম্বা, কালো কোট পরা, ধীর চলাফেরা করেন, এবং যখন কথা
বলেন তার কণ্ঠস্বর ভারী ও সম্মোহনী। যে দৃশ্যে তিনি গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে
বক্তৃতা দেন সেটি প্রায় দশ মিনিটের একটি অবিচ্ছিন্ন শট, সেখানে আমরা দেখি
কীভাবে মানুষ আশার বানী শুনে মরিয়া হয়ে একটি মিথ্যা প্রতিশ্রæতি আঁকড়ে ধরে।
ইরিমিয়া তাদের বলে একটি নতুন জায়গায় যাওয়ার কথা। নতুন শুরুর কথা। তারা
ইরিমিয়াকে বিশ্বাস করে কারণ বিশ্বাস করা ব্যতিত তাদের আর কোন উপায় নেই।
উপন্যাসের মত চলচ্চিত্রেও ইরিমিয়া যেন একজন মসীহ, যদিও তার প্রতিশ্রæতি শেষ
পর্যন্ত গ্রামবাসীকে আরও অতল হতাশায় নিয়ে যায়। একটি বিখ্যাত দৃশ্য আছে
যেখানে গ্রামবাসীরা একটি সরাইখানায় মাতাল হয়ে নাচে। এটি প্রায় দশ মিনিটের
দৃশ্য যেখানে তারা মিহালি ভিগের সেই বিখ্যাত সুরের তালে ট্যাঙ্গো নাচে
লিপ্ত হয। ক্যামেরা তাদের চারপাশে ঘুরতে থাকে এবং আমরা অনুভব করি সেই নাচের
চক্রাকার ও অন্তহীন প্রকৃতি যা ছয় ধাপ এগিয়ে ও ছয় ধাপ পিছিয়ে। শয়তানের এই
টেঙ্গো নাচনের দৃশ্যে গ্রামবাসীরা হয়তো সেই মুহ‚র্তে আনন্দিত, কিন্তু এই
আনন্দও এক গ‚ঢ় নৈরাশ্যের প্রকাশ বা অর্থহীনতা থেকে পালানোর এক মরিয়া
চেষ্টা।
পিটার বের্লিংয়ের অভিনয়ে ডাক্তার চরিত্রটি চলচ্চিত্রের নৈতিক
কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উপন্যাসেও চরিত্রটির ভুমিকা একই। যেন সে এক সত্যদ্রষ্টা।
সে তার ভাঙ্গা বাড়িতে একাকী বসে থাকে। জানালায় দ‚রবীন রেখে অবিরাম দেখে
যায়, মদ খায়, এবং সবকিছু লিখে রাখে। শারীরিকভাবে ভাঙ্গা এই চরিত্রটির
চলাফেরা ধীর, প্রায় যান্ত্রিক, যেন সে একটি রেকর্ডিং মেশিন মাত্র। একটি
দৃশ্যে সে মদ কিনতে বের হয় কিন্তু পথে কাদায় পড়ে যায় এবং প্রচুর সময় নিয়ে
কষ্ট করে উঠতে হয় যা এক অসহায়তা ও মানবিক দুর্বলতার মর্মস্পর্শী দৃশ্য।
উপন্যাসের শেষে বা চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে, যখন সবাই চলে গেছে, ডাক্তার তার
সমস্ত জানালা কাঠ দিয়ে আটকে দেয়, নিজেকে সম্প‚র্ণভাবে বাইরের জগত থেকে
বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, এবং অন্ধকারে বসে লিখতে থাকে। আমরা নিরালোকে শুনি তার
কলমের শব্দ। কী লিখছে সে যখন সে আর দেখতে পাচ্ছে না? এই চ‚ড়ান্ত ছবি; একজন
মানুষ যে দেখা বন্ধ করেছে কিন্তু লেখা চালিয়ে যাচ্ছে তা অসম্ভব প্রভাবশালী ও
প্রতীকী। কেন লিখছে? কার জন্য? এই প্রশ্নগুলোর কোনো সরাসরি উত্তর নেই,
কিন্তু এই লেখার ক্রিয়া যেন অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ, অর্থহীনতার মুখে
একমাত্র প্রতিরোধ।
স্যাটানটেঙ্গোর পর ক্রাসনাহোরকাই এবং বেলা আরও কয়েকটি
চলচ্চিত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু তাঁদের শেষ এবং সম্ভবত সবচেয়ে
চরম কাজ হলো ২০১১ সালের ‘দ্য তুরিন হর্স।’ এই চলচ্চিত্র শুরু হয় নিৎশের
সেই তুরিন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে। তারপর সেই ঘোড়ার কী হয়েছিল? এই প্রশ্ন ছুঁড়ে
দিয়ে চলচ্চিত্রটি এক দার্শনিক ধ্যান ও অস্তিত্ববাদী অন্বেষণের স‚চনা করে।
এটি কোনো ঐতিহাসিক পুনর্গঠন নয়। আমরা দেখি ছয় দিনের জীবন। একজন বৃদ্ধ মানুষ
ওহলসডর্ফার, তার মেয়ে, এবং একটি ঘোড়া, যারা একটি নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন
খামারবাড়িতে বাস করে। বাইরে একটি প্রচÐ বাতাস ক্রমাগত বইছে। নিরন্তর,
প্রবল, যেন জগতের নিজস্ব শ্বাস। প্রতিদিন একই রুটিন পুনরাবৃত্ত হয়। বৃদ্ধ
লোকটি ঘোড়াকে জোতা লাগানোর চেষ্টা করে, মেয়ে কুয়ো থেকে পানি আনে, তারা
সেদ্ধ আলু খায়, জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কিন্তু ধীরে ধীরে জীবনের শর্তগুলো
অদৃশ্য হতে থাকে। ঘোড়া খাওয়া বন্ধ করে দেয়, কুয়োর পানি শুকিয়ে যায়, বাতি
জ্বালানোর তেল শেষ হয়ে যায়। ছয় দিন ধরে আমরা দেখি এই ক্রমাগত ক্ষয়। প্রকৃত
প্রস্তাবে এই অবরোহণ আলোহীনতার দিকে।
‘দ্য তুরিন হর্স’ চলচ্চিত্রটি
মাত্র দুই ঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিটের, স্যাটানটেঙ্গোর তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু
এর তীব্রতা কোনো অংশে কম নয়। এটি তারের সবচেয়ে ন্য‚নতম কাজ। খুব কম চরিত্র,
খুব কম সংলাপ, খুব কম ঘটনা। কিন্তু এই ন্য‚নতমতার মধ্যেই তৈরি হয় প্রকৃত
মাহাত্ম্য। এই চলচ্চিত্রটিও সাদা-কালো এবং ভিজ্যুয়ালগুলো দারুণ
চিত্তাকর্ষক। বৃদ্ধ লোকের ভাঁজ পড়া মুখ, মেয়ের অভিব্যক্তিহীন চোখ, ঘোড়ার
স্থির দৃষ্টি, বাইরের ধ‚সর ল্যান্ডস্কেপ, যেখানে কিছু নেই শুধু পাথর আর
বাতাস। মাত্র ত্রিশটি শটে তৈরি এই সিনেমায় প্রতিটি শট গড়ে প্রায় পাঁচ
মিনিটের। এই প্রাংশু শটগুলোতে সময় যেন প্রসারিত হয়, প্রায় স্থির হয়ে যায়,
কিন্তু তবুও অগ্রসর হতে থাকে। দর্শক বাধ্য হন প্রতিটি মুহ‚র্ত এবং প্রতিটি
পুনরাবৃত্তি সহ্য করতে।
আলু খাওয়ার দৃশ্যগুলো মর্মস্পর্শী। তারা নীরবে
বসে, হাতে গরম আলু, ধীরে ধীরে খোসা ছাড়ে, খায়। এই সাধারণ ক্রিয়া, এই
দৈনন্দিন আচার, একধরনের মহত্ত¡ লাভ করে। খাদ্যগ্রহণ ও বেঁচে থাকার ভেতর
দিয়ে এই পুনরাবৃত্তিপ‚র্ণ ঘটনা দর্শককে জীবনের সবচেয়ে মৌলিক রূপগুলিকে
স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু যখন ঘোড়া খাওয়া বন্ধ করে, যখন পানি শুকিয়ে যায়, এই
মৌলিক শর্তগুলোও তখন অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সিনেমাটি ছয় দিনে বিভক্ত। এটি
স্পষ্টতই বাইবেলের সৃষ্টির ছয় দিনের একটি বিপরীত প্রতিফলন। বাইবেলে ঈশ্বর
ছয় দিনে জগত সৃষ্টি করেন। আমাদের মনে পড়ে ছয় দিনে সৃষ্টি, ধ্বংস, ও নিভে
যাওয়া। সপ্তম দিনে ঈশ্বর বিশ্রাম নিয়েছিলেন, কিন্তু চলচ্চিত্রে সপ্তম দিন
আসে না। সিনেমা শেষ হয় ছায়াচ্ছন্নতায়। শেষ দৃশ্যে বাবা এবং মেয়ে গুমোট ঘরে
বসে আছে। তাদের সামনে কাঁচা আলু যা তারা খেতে পারে না। তারা শুধু বসে থাকে,
নীরবে, অন্তহীন তমসায়।
এই সিনেমায় বাতাসও একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। নিরন্তর
অবিরাম গর্জন যা কখনো থামে না। এটি যেন অস্তিত্বের নিজস্ব পরাক্রম, এক
প্রাচীন, উদাসীন তীব্রতা যা সবকিছু ভাঙতে চায়। গাছ নেই যা দুলবে, শুধু পাথর
আর ধুলো, আর বিরামহীন বাতাসের শব্দ। এই শব্দ তৈরি করে শ্রবণগত একঘেয়েমি যা
প্রায় অসহনীয় কিন্তু একইসঙ্গে সম্মোহনী। একটি দৃশ্যে একজন প্রতিবেশী আসে।
এক বিস্তৃত দার্শনিক বক্তৃতার ফাঁকে সে বলে যে ঈশ্বরই কেবল সবকিছু ধ্বংস
করছেন না, মানুষও ধ্বংস করেছে ঈশ্বরকে। এটি নিৎশের ‘ঈশ্বর মৃত’ ঘোষণার
স্পষ্ট প্রতিধ্বনি। কিন্তু এখানে এই ঘোষণা কোনো মুক্তির মতো শোনায় না, বরং
এক শ‚ন্যতার স্বীকৃতি, এক নৈরাশ্যের প্রকাশ। ঈশ্বরের মৃত্যুর পর যা রয়ে
গেছে তা হলো এই নগ্ন নিরর্থক অস্তিত্ব।
ঘোড়াটি এই চলচ্চিত্রের একটি
উল্লেখযোগ্য প্রতীক। এটি কী সেই ঘোড়া যা নিৎশেকে পাগল করেছিল? সম্ভবত না।
কিন্তু এটি সেই সব নীরব কষ্টের প্রতিনিধি যা নিৎশে স্পর্শ করেছিলেন। ঘোড়াটি
শুরুতে কাজ করে, জোতা টানে, কিন্তু ধীরে ধীরে সে খাওয়া বন্ধ করে দেয়, কাজ
করতে অস্বীকার করে। এটি কী প্রতিরোধ? নাকি এটি শুধু ক্লান্তি বা
আত্মসমর্পণ? বৃদ্ধ লোকটি চেষ্টা করে তাকে খাওয়াতে, জোতা লাগাতে, কিন্তু
ঘোড়া নড়ে না। এই দৃশ্যগুলো মাত্রাতিরিক্ত শক্তিশালী। মানুষ এবং প্রাণী
উভয়েই আটকা পড়ে এক পরিস্থিতিতে যার কোনো সমাধান নেই। ঘোড়ার স্থির গভীর চোখ
যেন কিছু বলছে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না কী তা। জোহান্স আরাকাসের চিত্রিত
এই ঘোড়া এবং জানোস ডের্জসির অভিনীত বৃদ্ধ লোক, এবং এরিকা বক অভিনীত মেয়ে
চরিত্রের তিনজনই প্রায় নিঃশব্দে অভিনয় করে গেলেও তাদের শরীরী উপস্থিতি
দর্শকের মনে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে। এই নীরবতা তৈরি করে ভিন্নমাত্রার
বিচ্ছিন্নতা ও অনন্ত একাকীত্ব যা ভীষণ সংবেদনশীল। তারা একসঙ্গে বসবাস করেও
একা। এই থিম স্যাটানটেঙ্গোতেও আছে। গ্রামবাসীরা একসঙ্গে থাকলেও এরা পরস্পর
থেকে বিচ্ছিন্ন। এরা পরস্পরকে বিশ্বাস করে না। পরস্পরকে বোঝে না। কিন্তু
তুরিন হর্সে এই বিচ্ছিন্নতা আরও চরম, আরও অস্তিত্বগত। যদিও এখানে কোনো
পতনোম্মুখ সমাজ নেই, আছে শুধু দুটি মানুষ এবং একটি প্রাণী যারা অস্তিত্বের
চরম প্রান্তে অবস্থান করছে।
উভয় চলচ্চিত্রেই ক্রাসনাহোরকাই এবং বেলা
দেখান এমন এক জগত যেখানে কোনো মুক্তি নেই, কোনো আশা নেই, কোনো অতিক্রমণ
নেই। এটি নিৎশের চিরন্তন পুনরাবৃত্তির ধারণার এক নৈরাশ্যবাদী ব্যাখ্যা।
ক্রাসনাহোরকাই ও বেলা সেই ব্যাখ্যার প্রায়োগিক রুপ দেখান এভাবে যে, যদি
জীবন অন্তহীনভাবে পুনরাবৃত্ত হয় তবে সেই জীবন হবে কষ্টের, একঘেয়েমির,
অভিশাপের, এবং ক্ষয়ের, যা একধরনের নরক ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এই
নৈরাশ্যের মধ্যেও তাদের কাজে যথার্থ মহিমা আছে। তাদের চরিত্ররা সহজে
আত্মসমর্পণ করে না। স্যাটানটেঙ্গোতে গ্রামবাসীরা তাদের রুটিন বজায় রাখে।
ডাক্তার লিখতে থাকে। তুরিন হর্সে বৃদ্ধ লোক এবং তার মেয়ে তাদের দৈনন্দিন
কাজ চালিয়ে যায়, যদিও সবকিছু অর্থহীন। এই অবিচলতা, এই নীরব সহনশীলতা, হয়তো
মানুষের তলস্পর্শী মর্যাদার কথা বলে। আমরা জানি যে কিছুই টিকবেনা, তবুও এই
অর্থহীনতা আমরা জারী রাখি। কেন? হয়তো এই পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু করার
নেই। হয়তো এই চালিয়ে যাওয়াই অস্তিত্বের প্রমাণ।
৩.
বেলা ঘোষণা
করেছিলেন যে ‘দ্য তুরিন হর্স’ তাঁর শেষ চলচ্চিত্র। সত্যিই তিনি এরপর আর
কোনো ফিচার ফিল্ম বানাননি। এই ঘোষণা অবশ্যই প্রতীকী। তিনি বলেছিলেন যে
সিনেমা মৃত এবং তাঁর আর নতুন কিছু বলার নেই। এই বক্তব্য কী নিৎশের পাগলামির
মতোই এক আত্মসমর্পণ? নাকি এটি এক শিল্পীর তাঁর শিল্পমাধ্যমের সীমা স্বীকার
করা? বেলা তাঁর পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে সিনেমাকে তার চরম সীমায় নিয়ে
গিয়েছিলেন। সিনেমায় তাঁর দেখানো অর্থহীনতা, ন্য‚নতমতা, এবং নীরবতাই কী
অবশেষে তিনি নিজের শিল্পি জীবনেও প্রয়োগ করেছেন?
ক্রাসনাহোরকাই এবং
বেলার কাজের তুলনা করা যায় অন্যান্য মহান নৈরাশ্যবাদী শিল্পীদের সঙ্গে।
যেমন, সাহিত্যে কাফকা কিংবা বেকেট; চলচ্চিত্রে ব্রেসঁ, ড্রেয়ার, বা
আন্তোনিওনি। কিন্তু ক্রাসনাহোরকাই এবং বেলার কাজ স্বতন্ত্র তাঁদের চরম
একাগ্রতা ও অনমনীয়তায়। তাঁরা কোনো সান্ত¡না দেন না। কোনো সহজ উত্তর দেন না।
তাঁরা দর্শক বা পাঠককে বাধ্য করেন মুখোমুখি হতে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যের
যে আমরা মরণশীল, আমাদের অস্তিত্ব প্রায়ই অর্থহীন, এবং কষ্ট অনিবার্য।
তাঁরা যুগপৎ ঘোষণা করেন সমস্ত ব্যবস্থা ও প্রতিশ্রুতিই ভঙ্গুর। দর্শক বা
পাঠকের তরফে অন্তর্লীনতায় দাঁড়িয়ে এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া কী প্রকৃত
মুক্তি? নাকি অবশ্যম্ভাবি পতন? তাঁরা দুজনই নিৎশে প্রভাবিত এই ভ্রান্তির
সফল চাষী।
নিৎশে যে ঘোড়ার জন্য কেঁদেছিলেন তা শুধু একটি প্রাণী ছিল না,
ছিল সমস্ত নীরব কষ্টের প্রতীক, সমস্ত অবিচারের প্রতীক যাদের কোনো কণ্ঠস্বর
নেই। নিৎশে তাঁর সমস্ত জীবন দিয়ে লিখেছিলেন শক্তি, ক্ষমতা, অতিক্রমণের কথা।
কিন্তু সেই মুহ‚র্তে তিনি স্পর্শ করলেন অন্য কিছু যা তাঁর মনোদৈহিক
সুস্থতাকে আজীবনের জন্য ধসিয়ে দিয়েছিল। সবলতা ও দুর্বলতা, কঠোরতা ও করুণার
এই বিরোধাভাস মানব অস্তিত্বের কেন্দ্রে আছে। ক্রাসনাহোরকাই এবং বেলা নিৎশের
এই সত্যকে তাঁদের শিল্পে ধরেছেন। তাদের চরিত্ররা কঠোর, স্বার্থপর, কখনো
কখনো নিষ্ঠুর। শেষ বিচারে তারাও মানুষ, তারাও কষ্ট পায়, তারাও একাকী। যে
মানুষগুলো একে অপরকে ঠকায় তারা নিজেরাও প্রতারিত। ক্রাসনাহোরকাই এবং বেলা
এই চক্র, এই পুনরাবর্তন, এই অদৃশ্য ও অবিরাম ‘শয়তানের টেঙ্গো নৃত্য’কে
নিৎশের দ‚রদৃষ্টি বা দ‚র্দশার মধ্য দিয়ে সফল অনুবাদ করতে পেরেছিলেন। দর্শক
কিংবা পাঠকের ছদ্মবেশে আমরাও স্যাটানটেঙ্গো ও দ্য তুরিন হর্সের চরিত্রদের
উপর ভর করে উপলব্ধি করতে পারি সমস্ত দর্শনের চেয়েও গভীর এক বাস্তবতাকে।
লেখক: চিকিৎসক। অনকোলজি গবেষক। চিন্তক।