দেশের
ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোরলেন মহাসড়কসহ চট্টগ্রাম বিভাগের ৮২১ কি.মি
জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়ন। সড়ক দুর্ঘটনা
রোধ এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশের এ
রিজিয়নের কার্যক্রম শুরু হয়। এ রিজিয়নে আগের তুলনায় প্রযুক্তি, জনবল,
যানবাহনসহ বিভিন্ন সক্ষমতা বাড়লেও তবুও কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা। এ সড়ক
মহাসড়কে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রটিপূর্ণ যানবাহন ও
অদক্ষ চালকের কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ ছাড়াও ছোট-বড় নিষিদ্ধ যানবাহন তো
চলছেই।
কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালের
জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এ রিজিয়নে ২ হাজার ৬৪৫টি সড়ক
দুর্ঘটনায় ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ২ হাজার ৩৬২ জন এবং আহত হয়েছেন ২ হাজার
৯৭৯ জন। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৯৭২টি। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি সংখ্যা ৪
হাজার ৫৪৭। তবে এর মধ্যে সর্বাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে ৬৩০ টি। এ
ঘটনায় মারা যায় ৫২২ জন। অপর দিকে ২০২০ সালে মারা যায় ২১০ জন, ২০২১ সালে
মারা যায় ৪৪২জন, ২০২২ সালে ৩৪৭জন, ২০২৩ সালে মারা যায় ৪৪৯ জন। শুধুমাত্র
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৯৩টি দুর্ঘটনায় মারা যায় ৩২৬জন। আহত
হয় ৬৩৪ জন এবং দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনের সংখ্যা ৬৭৮ টি।
হাইওয়ে
পুলিশের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা
বাড়াতে, অপরাধ দমন ও দুর্ঘটনায় সঠিক কারণ নির্ণয় করতে ঢাকা-চট্টগ্রাম
মহাসড়কে প্রায় দেড় হাজার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল,
যা বর্তমানে অনেকগুলোই বিকল হয়ে পড়ে আছে। গত বছরের জুলাই আন্দোলনে অনেক
ক্যামরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এ রিজিয়নের
অধীনে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ২২টি থানা রয়েছে।
যেখানে কর্মকর্তা, অফিস স্টাফ ও মাঠ পর্যায়ে জনবল আছে প্রায়৭শ’। যা
চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত।
হাটবাজারে দখলে মহাসড়ক
সংশ্লিষ্ট
সূত্র বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খুব কাছাকাছি ১৪টি বাজার রয়েছে।
সেগুলো হচ্ছে, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, মাধাইয়া বাজার, চান্দিনা বাজার, সুয়াগাজী
বাজার, নাজিরাবাজার, নিমসার বাজার, মিয়াবাজার, চৌদ্দগ্রাম বাজার, বাবুর্চি
বাজার, বারৈয়ারহাট বাজার, মিরসরাই বাজার, বাড়বকুÐ বাজার, বাঁশবাড়িয়া বাজার
এবং ছোট কুমিরা বাজার। এছাড়া এ মহাসড়কের কাঁচপুর মোড়, মদনপুর, মোগরাপাড়া,
যাত্রামুড়া, ভাটেরচর নতুন রাস্তা লিংক রোডের মাথা, ক্যান্টনমেন্ট মোড়, বড়
দারোগারহাট ওজন স্কেল, কেডিএস ডিপো ঘোড়ামারা এবং বিএম ডিপো মদনহাটের রয়েছে
সংযোগ সড়ক।এসব হাটবাজারে পন্য আনা-নেয়ার সময় ছোট ছোট যানবাহন মহাসড়কে উঠে
পড়ে। এছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ভটভটি,
নসিমনসহ অনিবন্ধিত যানবাহনের চলাচল করছে এতে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।
সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ
পরিবহন
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ২০১৬ সালের ২ জুলাই ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহাসড়কটির যোগাযোগ
দ্রæত ও নিরাপদ করতে ১৯০ কিলোমিটার এলাকা চার লেনে উন্নীতকরণ করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলা সমূহের
যোগাযোগ মাধ্যম এ মহাসড়কটি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়লেও বাড়তি
চাপ সামলাতে এ ফোরলেনের এখন বেহাল দশা। সক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন
চলাচলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ ফোরলেন। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা। স¤প্রতি
মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে সরেজমিনে গিয়ে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত দেখা গেছে। হাইওয়ে
পুলিশ, সওজ এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টরা দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে এ মহাসড়কে
বিপদজনক ইউটার্ন, উল্টোপথে গাড়ি চালানো, পথচারীদের অসচেতনতা, ফিটনেস বিহীন
গাড়ি, ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রন না করা, অবৈধ পার্কিং,
ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করা, সড়কের পাশে বাজার, সড়কে ক্রটি, নিষিদ্ধ ছোট
যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া গতি ও অদক্ষ চালক দিয়ে বিরামহীনভাবে গাড়ি চালনাকে
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সওজ থেকে পাওয়া তথ্য মতে মহাসড়কের
কুমিল্লা অংশের ১০০ কিলোমিটারে ৮৪টি ইউটার্ন রয়েছে। যেখানে প্রায় ঘটছে
দুর্ঘটনা। চলতি বছরের গত ২২ আগষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদর
দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় একটি লরি উল্টে নিচে চাপা পড়ে
প্রাইভেট কারের চার যাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহতরা সবাই একই পরিবারের সদস্য
ছিলেন।
কুমিল্লা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক কবির আহমেদ বলেন,
ক্রুটিপুর্ণ সড়ক ও মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল দুর্ঘটনার একটি বড়
কারণ। আলাদা লেন না থাকায় মোটরসাইকেলসহ এসব নিষিদ্ধ যানবাহন একই লেনে বড়
গাড়ির সাথে পাল্লা গিয়ে সড়কে চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। চালকেদের
অনেকেই আইন মানছেন না। জরিমানা মামলা করেও
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো.
হাদিউজ্জামান বলেন, পরিবহন সেক্টর রাজনৈতিক পেশীশক্তি দ¦ারা পরিচালিত হয়।
এর পাশাপাশি একটি সিন্ডিকেট আছে এখানে স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক
ব্যক্তি ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত আছে। চালকের লাইসেন্স, রোড
পারমিট, ফিটনেস যারা এসব আইন প্রয়োগ করবে তারা অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী
হয়ে যান। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরলে এই সুবিধা পাওয়ার কোন সুযোগ নাই বরং এই
বিশৃঙ্খলা যদি রাখা যায় সেখান থেকে চাঁদাবাজি চলতে থাকতে। ঢাকা-চট্টগ্রাম
মহাসড়কটি এখন চারলেন আছে অধিকাংশ সময় দেখা গেছে এই সড়কটির দুই পাশে পার্কিং
হয়ে যায়, হাটবাজার দিয়ে মহাসড়কের দুই পাশ দখল করে রাখা হয়, এই বিশৃঙ্খলার
কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়ন কুমিল্লা
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহিনুর আলম খান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনাগুলো নানা কারণে
ঘটছে। কিছু চালকের কারণে, কিছু সড়ক অবকাঠামোর কারণে হচ্ছে। একেক ঘটনার একেক
কারণ । আমরা আইনের প্রতি সচেতন না হলে এই দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না। সড়কের
নিয়মকানুন আমরা যেন মেনে চলি, দেশের অধিকাংশ লোক সড়কের নিয়মকানুন মেনে চলতে
চায় না, চালকরা বেশি গতিতে গাড়ি চালায় লেন ভায়োলেশন করি, সড়কের ওপর
বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দোকান পাট হাট বাজার বিভিন্ন সমস্যা আছে। আবার কিছু
কিছু জায়গায় আন অথোরাইজ গাড়ি থ্রি হুইলার, অবৈধ গাড়ি চলে। আমরা চেষ্টা করে
যাচ্ছি আইন প্রয়োগে আমাদের লেভেলে সর্বচ্চো চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি আরও
আরও বলেন আমার জনবল ও লজিস্টিক সার্পোটের বেশ সংকট রয়েছে। থানা ফাড়িগুলোতে
সমস্যা রয়েছে। ৫ আগষ্টের ঘটনায় আমাদের অনেকগুলো গাড়ি পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে। সে গাড়িগুলো আমরা এখনো পায়নি। তিনি বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও ছিনতাই
ডাকাতিসহ অপরাধ প্রতিরোধে সিসি ক্যামেরা অত্যন্ত সহায়ক। এ প্রকল্প আমাদের
কাছে হস্তান্তর শেষ হলে আশা করি মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও অপরাধ দমনে হাইওয়ে
পুলিশ আরও বেশী ভুমিকা রাখতে পারবে।