
লালন দর্শন হচ্ছে
বস্তুবাদ ও ভাববাদের সমন্বয়। এখানে সন্ন্যাসব্রতের স্থান নেই। সন্ন্যাসব্রত
হচ্ছে বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় ভোগ- বিলাস, কামনা-বাসনা ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক
সাধনায় জীবন অতিবাহিত করা। যিনি সন্ন্যাসব্রত পালন করেন তিনিই সন্ন্যাসী।
এরা জগৎ জীবনের প্রতি, সংসারের প্রতি, সম্পত্তির প্রতি, জাগতিক আকাক্সক্ষার
প্রতি উদাসীন। এরা সংসার, পিতামাতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ত্যাগ করে
সর্বক্ষণ ঈশ্বরের চিন্তায় বিভোর থাকেন। বাউল, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং
ইসলাম ধর্মেও সন্ন্যাসব্রতের প্রচলন রয়েছে। যেমন-বৈষ্ণব ধর্মে বৈরাগী,
বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষু, খ্রিষ্টধর্মে মংক- নান, ইসলাম ধর্মে পির, ফকির, দরবেশ।
এরা নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে কৃচ্ছসাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।
ভিক্ষাবৃত্তি বা পরের দানকৃত বৃত্তি অবলম্বন করেই তারা নিজেদের আহার জোগাড়
করেন, জীবন ধারণ করেন। এরা সমাজের ম‚ল স্রোতের বাইরে জীবনযাপন করেন।
ভিক্ষু,
বৈরাগী, মংক ও নানরা বিয়ে করত না এবং করতে পারত না। তারা মঠ, মন্দির,
গির্জায় সেবাদাস ও সেবাদাসী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করত। খ্রিষ্টান
প্রোটেস্টান্ট ধর্মের প্রবর্তক মার্টিন লুথার যাজকদের বিয়ে করার অনুমতি দেন
এবং নিজেও বিয়ে করেন। অনেক বাউলও আছেন তারা বিয়ে করেন না, করলেও সন্তান
উৎপাদন করেন না। তারা ইহজগৎকে তুচ্ছ মনে করেন। এমনকি গৌতম বুদ্ধ,
শ্রীচৈতন্য স্ত্রী-পুত্র, পিতামাতা, সংসার ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক সাধনায়
ব্রতী হয়েছেন। লালন এ ধরনের সন্ন্যাসব্রতের বিরোধী। লালন শ্রীচৈতন্যকে
উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘কী ভাব নিমাই তোর অন্তরে/ মা বলিয়ে চক্ষের দেখা তাতে
কি তোর ধর্ম যায় রে/ কল্পতরু হও রে যদি তবু মা-বাপ গুরুনিধি/ এ গুরু ছাড়িতে
বিধি কে তোরে দিয়েছে হারে।’
নিমাই হচ্ছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাল্য
নাম। তিনি পিতামাতা, পরিবার ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রতে বের হয়েছেন। মাকে
চোখের দেখাও দিচ্ছেন না। লালন প্রশ্ন করেছেন, সংসারে থেকে, পিতামাতার
সেবাযতœ করে কি ধর্ম করা যায় না? এজন্য ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়? কল্পতরু হলো
হিন্দু পুরাণ, জৈনধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মের একটি ইচ্ছা প‚রণকারী ঐশ্বরিক বৃক্ষ।
যে বৃক্ষের নিকট থেকে আকাক্সিক্ষত ফল লাভ করা যায়। সমুদ্র মন্থনকালে
কামধেনুর সঙ্গে কল্পতরুর উৎপত্তি হয়েছিল। কামধেনু হলো ঐশ্বরিক গাভি, যেসব
প্রয়োজন মেটায়। দেবতাদের রাজা, ইন্দ্র এই গাছটি নিয়ে তার স্বর্গে ফিরে
এসেছিলেন। লালন নিমাইকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন এই বলে যে, তুমি যদি কল্পতরু
হও, তবু বাপ-মা তোমার গুরু, পুজনীয় ব্যক্তি। এই গুরু ছেড়েদেশান্তর হওয়ার
বিধান কে তোমাকে দিয়েছে? আবার তিনি বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম বিষ্ণুপ্রিয়া।
নববধ‚কে সংসারে রেখে তিনি সংসার বিরাগী হয়েছেন। লালন বলেন, 'তুমি যদি
সংসার বিরাগী হবা, তাহলে বিয়ে করেছ কেন? বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো নববধ‚কে ঘরে
রাখে কেমনে? নববধ‚কে ঘরে রেখে দেশান্তর হওয়া অমানবিক।' লালন বলেন, 'আগে যদি
জানো ইহা তবে কেন করলে বিয়া/ এখন সে বিষ্ণুপ্রিয়া কেমনে রাখিব ঘরে।'
এজন্য
লালন ও বাউল দর্শনে ঘরে-বাইরে এক না হলে অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী একমত না হলে
মুরিদ হওয়া যায় না, সাধক হওয়া যায় না।’ সাধু হতে হলে, সাধনা করতে হলে সাধন
সঙ্গিনী লাগে। নারী হচ্ছে পুরুষের অর্ধাঙ্গ। অর্ধাঙ্গ বাদ দিলে থাকে
অর্ধাঙ্গ। প‚র্ণাঙ্গ না হলে সাধন হয় না, সাধুও হওয়া যায় না। সঙ্গিনী ব্যতীত
জীবন যেখানে অপ‚র্ণাঙ্গ, সেখানে সাধন-ভজন হয় কেমনে? বিশাখা নামে লালনের
একজন স্ত্রী বা সাধনসঙ্গিনী ছিল। পিয়ারী নামে এক কন্যাকে লালন দত্তক
নিয়েছিলেন। তাকে তার প্রিয় শিষ্য ভোলাই শাহের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। সবকিছু
ত্যাগ করে সাধনা করতে হবে, তাতে মুক্তি মিলবে-এ ধরনের সাধনা ও মুক্তির কথা
লালন দর্শনে নেই। লালন বলেন, “কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলেতে যায় / স্বপ্নদোষ কি
হয় না সেথায় / আপন মনের বাঘে যাহারে খায়/ কে ঠেকায় তারে।'
অনেকে মনে
করেন, নারী সমস্ত দোষের আকর। সে কামিনী, বাঘিনি, রাক্ষসী, ছলনাময়ী। নারী
হচ্ছে কামের দেবী। তার কারণে ধ্যানে বসা যায় না, সাধনায় মন বসে না। তাই কেউ
নারী থেকে দ‚রে থাকার জন্য বনে যায়। মনের কামপ্রবৃত্তি যদি দ‚র না হয়,
তাহলে বনে গেলে কি রক্ষা পাওয়া যায়? সে যেখানে যাক না কেন, মনের প্রবৃত্তি
যখন প্রবল হয়ে উঠে তাকে ঠেকিয়ে রাখে কে? এখানে নারী বলতে শুধু স্ত্রীলিঙ্গ
বুঝানো হয়নি। বরং জাগতিক ও সাংসারিক বিষয়-আশয়কে বোঝানো হয়েছে। সাংসারিক
কাজকর্ম ত্যাগ করে সাধু হওয়ার দরকার নেই। সাংসারিক কাজকর্ম করেও সাধু হওয়া
যায় এবং সেটাই যথার্থ। এ ব্যাপারে লালন অনুরাগী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বলেন, “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয় / অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহা আনন্দময়/
লভিব মুক্তির স্বাদ! এই বসুধার।’
বৈরাগ্য সাধন করে, ইন্দ্রিয় দ্বার
রুদ্ধ করে, সবকিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে যোগাসনে বসে ধ্যান করে মুক্তি।
সে মুক্তির দরকার নেই। তা রবীন্দ্রনাথ চাননি। লালনও চাননি। লালনের ছিল
দেশব্যাপী অসংখ্য শিষ্য। গান ও বাহাস করতে তিনি দ‚রদ‚রান্তে ঘুরে
বেরিয়েছেন। গান করে তিনি আয় করতেন। তারপরে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
করতেন। তার ছিল পানের বরজ।
তিনি মৃত্যুকালে নগদ ২ হাজার রুপি রেখে গিয়েছিলেন। তিনি ঘরবাড়ি, জমি, অর্থ তার কন্যা, পুত্রতুল্য শিষ্যদের মধ্যে উইল করে দিয়ে যান।
মার্কসীয়
বস্তুবাদী দর্শনের ম‚ল কথা হচ্ছে, জীবনের ম‚ল উদ্দেশ্য আনন্দ বা শান্তি
প্রাপ্তি। এর জন্য দরকার পণ্য বা বস্তুর। বস্তুর জন্য দরকার উৎপাদন।
উৎপাদনের জন্য দরকার শ্রম। তাহলে মানুষ শ্রম দিয়ে বস্তু উৎপাদন করবে,
তারপরে তা ভোগ করবে। জীবনের জন্য দরকার বস্তু বা অর্থ। জীবন অর্থ বা
বস্তুকে কেন্দ্র করে আবির্ভ‚ত হয়। বস্তুবাদী জীবনের সঙ্গে দরকার ভাববাদী
চেতনার। সংসার বিরাগী হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করার মধ্যে
সম্মান নেই, মর্যাদা নেই, আনন্দ নেই। সংসারে সংসারী সাজতে হবে, নিত্য কাজ
করতে হবে। সেই সঙ্গে ভাববাদী চেতনায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। দুটোর সমন্বয়
দরকার। তবেই জীবন হবে গতিশীল, সতেজ, সরস, রসের, আনন্দের, মহিমান্বিত।
লালন
দর্শনে সন্ন্যাসব্রত ও বৈরাগ্য তো দ‚রের কথা, উদাসীনতা, কর্মবিমুখতা,
অলসতার কোনো স্থান নেই। সময়, জীবন- যৌবন একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না।
তখন আপসোস করে কোনো লাভ হয় না। সময়ের কাজ সময়ে কর, সময়ের সদ্ব্যবহার
কর-এটাই বুদ্ধিমানের কাজ। লালন বলেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না/ দিন থাকিতে
দিনের সাধন কেন করলে না।'
শুধু কাজ করলে হবে না, সময়মতো কাজ করতে হবে।
সময় ফুরিয়ে গেলে কাঁদলেও কাজ হয় না। যা করার তা এখনই করো, পরে করব-এ কথা
মুখে আনিয়ো না। লালন বলেন, ‘অসময়ে কৃষি করে মিছামিছি খেটে মরে/ গাছ যদিও হয়
বীজের গুণে ফল তো ধরে না।'
অসময়ে কৃষি করা আর মিছামিছি খেটে মরা একই
কথা। আমি কৃষকের সন্তান। ছোটবেলায় দেখতাম, নামিতে (দেরিতে) বা শীতের শেষে
ছোলা, গম বা পায়রা বুনলে গাছ ভালো হতো, কিন্তু ফল ধরত না। ফল ধরার আগেই
দক্ষিণা লু হাওয়ায় গাছ চমকে যেত।
ফলে তার পক্ষে ফল দেওয়া সম্ভব হতো না।
সময়ের কাজ সময়ে না করলে তা সফল হয় না। তা শুধু বীজ বপনের বিষয় নয়। বিয়ে
বলুন, অধ্যয়ন বলুন, খেলাধুলা বলুন, সাধন- ভজন বলুন সময়মতো না করলে তার ফল
ভালো হয় না।
মার্কসীয় দর্শন বস্তুবাদে ভরপুর। আর লালন দর্শন বস্তুবাদ ও
ভাববাদের সমন্বয়। আনন্দের জন্য দরকার ভোগ, ভোগের জন্য দরকার বস্তু, বস্তুর
জন্য দরকার উৎপাদন এবং উৎপাদনের জন্য দরকার শ্রম।
লেখক : লালন গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস, সম্পাদক, এনসিটিবি
