বাংলাদেশের
গ্রামীণ অর্থনীতিতে বহুল পরিচিত সবজি কচু ও কচুর লতি। একসময় যা ছিল
কেবলমাত্র গ্রামের রান্নাঘরের জনপ্রিয় খাবার, এখন সেটিই দেশের সীমানা
ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের
বাজারে। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়া এই লতি আজ বিদেশি
প্রবাসী বাংলাদেশি ও স্থানীয়দের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিদিন
বরুড়া থেকে প্রায় ৮০ টন লতি রপ্তানি হচ্ছে, যা টাকার অংকে দাঁড়াচ্ছে প্রায়
৩০ থেকে ৩২ লাখ। মাসিক হিসেবে আড়াই থেকে তিন লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে
বাংলাদেশে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বরুড়ার আগানগর, ভবানীপুর, খোশবাস ও
শিলমুড়ি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রামে এ মৌসুমে ১০০ হেক্টরের বেশি জমিতে কচু ও
লতির চাষ হয়েছে। উর্বর মাটি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের কারণে লতির গুণগত
মানও ভালো। কৃষকরা জমিতে জিংক ব্যবহার করছেন, ফলে স্বাদ উন্নত হচ্ছে এবং
খেলে গলায় চুলকানি হয় না।
চাষীরা জানান, একবার কচু রোপণ করলে টানা ৯ মাস
পর্যন্ত লতি পাওয়া যায়। ফলে খরচ কম অথচ লাভ বেশি। এ কারণেই প্রতিনিয়ত
কৃষকদের মধ্যে লতি চাষের আগ্রহ বাড়ছে।
লতি ও কচুকে ঘিরে বরুড়ায় সৃষ্টি
হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। প্রতিদিন স্থানীয় ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ীরা কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে লতি সংগ্রহ করেন। পরে তা ট্রাকে করে
ঢাকা-চট্টগ্রাম পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন এজেন্সি বাছাই করা লতি
রপ্তানি করছে বিদেশে। বর্তমানে বরুড়ায় অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যাপারী
সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
চাষী আব্দুল মতিন বলেন, এখন আর আমাদের বাজারে
যেতে হয় না। ব্যবসায়ীরাই বাড়ি থেকে লতি সংগ্রহ করে নেয়। মোটা লতি বিক্রি
হচ্ছে কেজি প্রতি ৪৫-৫০ টাকায় আর চিকন লতি ২৫-৩০ টাকায়।
আরেক চাষী এরশাদ
মিয়া বলেন, লতির চাহিদা বেড়ে গেছে। আশপাশের উপজেলা, এমনকি অন্য জেলা থেকেও
চাষীরা চারা কিনতে আসছেন। সরকার সহযোগিতা করলে বরুড়ায় আরও বড় আকারে লতির
চাষ করা যাবে।
রপ্তানিকারকরা জানান, বরুড়ার লতি বর্তমানে ঢাকায়
প্যাকেটজাত হয়ে বিমানে বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে
দুবাই, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। এছাড়া
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের অনেক দেশেও নিয়মিত যাচ্ছে এ সবজি।
বিদেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও এ লতির স্বাদে অভ্যস্ত
হয়ে উঠছেন।
উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া
জানান, এখানকার কৃষকরা পরিচ্ছন্ন পরিবেশে লতির চাষ করছেন। চাষাবাদে কৃষকরা
বৈজ্ঞানিকভাবে পোকা দমন করছেন। ফলে উৎপাদন বেড়েছে, আর গুণগত মানও ভালো
থাকছে। এ লতি ভোক্তাদের গলা চুলকায় না। যার কারণে জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
জেলা
কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক শেখ আজিজুর রহমান বলেন, রপ্তানির কারণে
প্রান্তিক কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছেন। মাঠে গিয়ে পাইকাররা সরাসরি লতি সংগ্রহ
করায় পরিবহন খরচও কমে গেছে। উপজেলা ও জেলা কৃষি অফিস সার্বক্ষণিক তদারকি
করছে এবং কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে।
এদিকে কৃষকদের অভিযোগ,
মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে প্রকৃত লাভের একটি অংশ হাতছাড়া হচ্ছে। তারা চান
সরাসরি রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রির সুযোগ। তবে তারপরও লতির আন্তর্জাতিক
বাজার তৈরি হওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে।
বর্তমানে
বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে বরুড়ার কচুর লতি যেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে,
তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও এটি বড় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে
দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে।