
কুমিল্লার
দেবিদ্বার উপজেলার দুই মেধাবী শিক্ষার্থী রাজিদ আয়মান ও হাসিবুল হাসান
চৌধুরী।ছোটবেলা থেকেএকই সঙ্গে স্কুলে যাওয়া, একই বেঞ্চে বসা, একই পোশাক পড়া
সবকিছুতেই ছিল এক অদ্ভুত মিল। পড়াশোনায় দুজনই সমান মেধাবী। এসএসসি ও
এইচএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে জিপিএ-৫। ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় স্বপ্ন ছিল দুজনের। সেই
স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ২০২৪ সালে তাঁরা উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান দক্ষিণ
কোরিয়ায়। ভর্তি হয়কিউংডংবিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ বিভাগে। পরিবার, আত্মীয়স্বজন
ও গ্রামের মানুষের চোখে ছিল আশার আলো। একদিন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশে
ফিরবে দুজন।কিন্তু নির্মম নিয়তি কেড়ে নিলো সেই আশার আলো।
গত মঙ্গলবার
(২৭ আগষ্ট) রাত ১১টার দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ওনজু শহরে একটি স্কুটি দুর্ঘটনায়
গুরুতর আহত হয় দুই বন্ধুসহ তিনজন। পরে তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে
নেয়া হলে তিনজনকেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি রাখা হয়। এখন
তারা শুয়ে আছে হাসপাতালের সাদা বিছানায়। চারপাশে শুধু যন্ত্রের শব্দ
মনিটরের বিপ বিপ, অক্সিজেনের হাওয়া। যে চোখ একসময় ভবিষ্যতের স্বপ্নে ঝলমল
করত, তা আজ বন্ধ। যে ঠোঁট একসময় পরিবারের জন্য নতুন পরিকল্পনা বলত, তা আজ
নীরব নি:স্তব্ধ।
রাজিদ আয়মান (২০) কুমিল্লার দেবিদ্বারউপজেলার পৌর
ফতেহাবাদ গ্রামের মো. নান্নু মিয়া মাস্টারের ছেলে এবং হাসিবুল হাসান চৌধুরী
(২১) একই উপজেলার ধামতী ইউনিয়নের ধামতী গ্রামের মো.ওমর ফারুক চৌধুরীর
ছেলে। অপরজনের নাম শিহাব তার বাড়ি জেলার বুড়িচং উপজেলা বলে জানা গেছে। তার
পরিচয় সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।
বুধবার (৩ আগষ্ট) বিকালে রাজিদ ও
হাসিবুলের গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, পুরো এলাকায় এখন এক ধরনের শোক ও
প্রার্থনার আবহ বিরাজ করছে। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে শিক্ষকসবাই হাত তুলে
দোয়া করছেন। শিক্ষকরা বলছেন, যাদের হাতে ছিল পরিবারের আশা, যাদের কাঁধে ছিল
ভবিষ্যতের দায়িত্ব, তারা যেন আবারও ফিরে আসে জীবনের আলোয়।সবার বিশ্বাস,
তাদের বন্ধুত্বের মতোই অটুট থাকবে জীবনও। আর একদিন তারা আবারো নতুন স্বপ্ন
আঁকবে, নতুন গল্প লিখবে।
এদিকে রাজিদ ও হাসিবুলের সহপাঠী ও শিক্ষকরা
আইসিউতে ভর্তি থাকা দুইজনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে দোয়া
চেয়েছেন। তারা আবেগঘন পোস্টে লেখেন “ওরা দুজন সবসময় একসঙ্গে থাকত। এখনো একই
সঙ্গে মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছে, জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। আমরা বিশ্বাস
করি, ওরা আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে।’’
হাসিবুলের বাড়ি থেকে দেখা
গেছে,দূর দেশে সন্তানদের এমন অবস্থার খবর শুনে ভেঙে পড়েছে তার পরিবার।
হাসিবের বাবা-মা বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন, আরবলছেন,‘আল্লাহ আমার ছেলেকে
বাঁচিয়ে দিন’ হাসিবুলের বাবা নির্বাকআর বুক চাপড়ে কাঁদছেনতার মা। দু’টি
পরিবারই এখন নিস্তব্ধ শোক আর উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
রাজিদ ও
হাসিবুলের বন্ধুআহমেদ শুভ বলেন, তাদের শুধু মেধা নয়, স্বপ্নও ছিল একই রকম।
ছোটবেলা থেকেই রাজিদ ও হাসিবুল ছিলেন ভদ্র, মেধাবী ও পরিশ্রমী।তারা দুইজনে
একই স্কুলে পড়ত, একই পোশাক পড়ত।ক্লাসে কেউ ফাস্ট বয় কেউ সেকেন্ড বয় থাকত সব
সময়ই। ২০২২ সালে এইচএসসিতে জিপিএ গোল্ডেন ৫ পাওয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য
দেশের বাহিরে যাবে এমন কথা আমাকে বলছিল। তারা দুইজনই পরিবারকে না জানিয়ে
দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ^বিদ্যালয়ে বিবিএ ভর্তির আবেদন করেনএবং একই সঙ্গে
কোরিয়ান ভাষা শিখেন।পরে পরিবার তাদের উচ্চশিক্ষায় বাধা না হয়ে দক্ষিণ
কোরিয়ার পাঠায়।
ওনজুর হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা ব্যয় প্রতিদিনই বাড়ছে।
পরিবারের পক্ষে এ বিপুল ব্যয়ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দূর দেশে
চিকিৎসার জটিলতা, অর্থনৈতিক চাপ এবং মানসিক যন্ত্রণায় পরিবারগুলো দিশেহারা
হয়ে পড়েছে। স্বজনদের দাবি, সরকারের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের এগিয়ে
আসা এখন জরুরি।
রাজিদ আয়মানের বাবা স্কুল শিক্ষক নান্নু মিয়াবলেন,
ছোটবেলা থেকেই আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষায় বিদেশে লেখা পড়া করবে।
দুই বন্ধু উচ্চ শিক্ষার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কিউংডং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ
ভর্তির আবেদন করে। মেধা তালিকায় সেখানে চাঞ্চ পাওয়ার পর আমি অনেক কষ্টে
টাকা ম্যানেজ করে তাকে সেখানেই পাঠাই। মঙ্গলবার রাতে স্কুটি দুর্ঘটনায় তারা
দুইজন আহত হয়ে এখন হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি। তার এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
সেখানে তাদের সহপাঠিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। আমি আমার ছেলের জন্য
সবার নিকট দোয়া চাই ‘আল্লাহ যেন আমার ছেলেকে আমার বুকে ফিরায় দেন’।
হাসিবুল
হাসান চৌধুরীর বাবা ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, রাজিদ ও হাসিবুল মঙ্গলবাররাতে
ওনজু শহরের একটি বাজারে কেনাকাটা করেবাসায় ফেরার পথে শিহাব
নামেবিশ^বিদ্যালয়ের তাদেরঅপর এক বড় ভাই তাদের বাসায় পৌছে দেওয়ার জন্য
স্কুটিকে জোর করে তুলেন। স্কুটি চালাচ্ছিলেন শিহাব। কিছুদূর যাওয়ার পর
সড়কেরস্পিডব্রেকারে (গতিরোধক) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে।এতে
তিনজনইগুরুতর আহত হয়। পরে পুলিশ এসে তিনজনকেই হাসপাতালে নেওয়া হলে অবস্থা
আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদেরআইসিইউতে ভর্তি করা হয়।আমার ছেলে ও তার বন্ধু
এখনমৃত্যুশয্যায়,৮দিন পার হলেও তাদের কারও জ্ঞান ফেরেনি। তার মা বাসায়
কান্নাকাটি করছে,জানিনা ছেলে বেঁচে ফিরবে কিনা। আমার ছেলে ও তার বন্ধুর
জন্য আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।