বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনকালে এমন কোনো
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে দুর্নীতি, অপচয় ও
লুটপাট হয়নি। বাংলাদেশের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের গত এক যুগের
দুর্নীতির চিত্র কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে যেভাবে উন্মোচিত
হয়েছে, তা শুধু ভয়াবহই নয়, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার সর্বাত্মক অবক্ষয়ের
নগ্ন দলিল। ১২ বছরে মাত্র ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সওজের মোট কাজের ৯০
শতাংশ বাগিয়ে নিয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ
অধিদপ্তরটির তালিকাভুক্ত ঠিকাদারের সংখ্যা এক হাজারের বেশি।
সওজের এই অনিয়ম-লুটপাটের নেপথ্যে ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও তাঁদের ঘনিষ্ঠজনরা।
প্রতিবেদন
অনুযায়ী, সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও তাঁর ঘনিষ্ঠজন, সাবেক এমপি
নিজাম হাজারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা
তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনসহ প্রভাবশালী
ব্যক্তিবর্গের বদৌলতে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেত। দরপত্রের শর্ত
নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারদের যোগ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্ধারণ করা হতো
এবং প্রকল্পের কাজ পেতে ঠিকাদারদের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো, যা
রাজনীতিক ও প্রকৌশলীদের পকেটে যেত। এটি একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতি চক্রের
প্রমাণ করে, যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা যোগসাজশে
রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল
বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণাও এই দুর্নীতির ব্যাপকতা নিশ্চিত করে। তাদের
তথ্য অনুযায়ী, সওজের বিভিন্ন প্রকল্পে ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত দুর্নীতি
হয়েছে, যা প্রকল্প ব্যয়ের বিশাল অংশ। প্রকল্প পরিকল্পনার শুরু থেকেই শুরু
হতো অনিয়ম : ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রণয়নে অনিয়ম, ফরমায়েশি
সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ঠিকাদারদের লাইসেন্স ভাড়া বা কার্যাদেশ কেনাবেচার মতো
অবৈধ কর্মকাণ্ড। এমনকি কিছু ঠিকাদার জাল ও ভুয়া নথি জমা দিয়েও কাজ বাগিয়ে
নিয়েছেন।
এই ধরনের দুর্নীতি কেবল আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং দেশের
দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিম্নমানের কাজের কারণে নির্মিত
সড়কগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে আবার মেরামত বাবদ জনগণের অর্থ
ব্যয় করতে হয়। কিন্তু দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নেওয়ার কোনো উদাহরণ নেই। দুর্নীতির অভিযোগে কোনো রাজনীতিক বা প্রকৌশলীর
শাস্তির নজির নেই।
একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে জড়িত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
এত
বড় আকারে দুর্নীতি উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া চলতে পারে না।
ফলে এ থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। অন্যথায় রাজা যায় রাজা
আসের মতো বিপুল রক্তক্ষয়ে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক
পটপরিবর্তন কোনো পরিবর্তন আনবে না। অন্তর্র্বতী সরকার সওজের লুটপাটের চক্র
ভাঙতে না পারলে সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জনগণের অর্থ লুটের এই প্রক্রিয়া
অব্যাহত থাকবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সুশাসনের পথকে বাধাগ্রস্ত করবে।