বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শীর্ষ উৎস হচ্ছে বৈদেশিক শ্রমবাজার। এ খাত থেকেই রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশে আসে সবচেয়ে বেশি অর্থ। কিন্তু দিন দিন এই শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক শ্রমবাজার ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হয়ে চলেছে। গত এক বছরে এই শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির হার প্রায় ৩০ ভাগ কমেছে। বিশ্বের মাত্র ৩টি দেশের ওপর নির্ভর করে এখন চলছে বৈদেশিক শ্রমবাজারের ৯০ ভাগ। স্বাভাবিকভাবেই এই শ্রমবাজার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি না হওয়া এবং কয়েকটি বড় শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় ক্রমেই কমে যাচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৬৯ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ৯৫ ভাগ কর্মী গেছেন মাত্র পাঁচটি দেশ- সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এই সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায় কম।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসের জনশক্তি রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ হাজার কমেছে। তবে এ বছরের মে ও জুন- এই দুই মাসে কিছুটা বেড়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে এ বছর বৈদেশিক কর্মসংস্থানের যে প্রবণতা তা ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার ইঙ্গিত বহন করছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশের তিনটি বড় বৈদেশিক শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ওমান। এ ছাড়া সৌদি আরব ও কাতারের মতো দেশে জনশক্তি রপ্তানি কমে গেছে। এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়া নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছিল, সেই জট এখনো খোলেনি।
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রবেশের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে যোগ্যতা ও দক্ষতা। কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের তারুণ্যনির্ভর সম্ভাব্য শ্রমশক্তি পিছিয়ে আছে। উল্লিখিত দেশগুলো ছাড়াও দূরপ্রাচ্য এবং ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে শ্রমবাজার রয়েছে। কিন্তু দক্ষতার অভাবে উন্নত দেশগুলোতে তারা প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন না। দক্ষতা নির্ভর করে যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণের ওপর। ভাষা-দক্ষতা থাকাও বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রবেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। এখন এই দুটি দিকের ওপরই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারকেই বহির্বিশ্বের উপযোগী প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। কিছুদিন আগে শিক্ষা উপদেষ্টা একটি সেমিনারে বৈদেশিক শ্রমবাজারের উপযোগী প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির উদ্যোগের কথা বলেছিলেন। এই কাজগুলোই এখন সরকারকে জোরেশোরে করতে হবে।
দেশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার নানা ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু শুধু এভাবে বৈদেশিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করা যাবে না। এ জন্য প্রাথমিকভাবে দুটি কাজ করা জরুরি: প্রথমত, বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধান করে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করতে হবে; দ্বিতীয়ত, সেসব শ্রমবাজারের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের উন্নত দেশগুলোতে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, এ রকম কোনো তথ্য নেই।
পৃথিবী দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অধিকাংশ দেশের শ্রমবাজার প্রধানত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স- এআই) যুগে প্রবেশ করেছে বর্তমান পৃথিবী। কায়িক শ্রমনির্ভর, এমনকি কারিগরি শ্রমবাজারের দিন শেষ হয়ে আসছে। এ কারণেই বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এখন প্রয়োজন সমকালীন বিশ্বের উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। এই দুটি বিষয়ের প্রতি সরকারের আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। একদিকে পূর্বতন বাজারগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা, অন্যদিকে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে পাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আশা করছি, সরকার এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে শ্রমবাজারের সংকট দূর করার চেষ্টা করবে।