যে পরিবারে এবং পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের জন্ম এবং বয়ঃপ্রাপ্তি ঘটে সেখানে তাঁর পক্ষে কবি, কাহিনীকার, গীতরচয়িতা, অভিনেতা, নাট্যকার ও নাট্যাচার্য হওয়ার মতো চিত্রকর হয়ে ওঠা আদৌ অকল্পনীয় ছিল না। গুণেন্দ্রনাথ ছবি আঁকতেন; রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সে যিনি ছিলেন তাঁর প্রধান সহায় সেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রচুর ছবি স্কেচ করেছিলেন; অবনীন্দ্র-গগনেন্দ্র তো চিত্রকর হিসেবেই খ্যতিমান। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিছুটা ড্রয়িং শিখেছিলেন; তাঁর তরুণ বয়সে আঁকা কিছু স্কেচের সন্দান মেলে মালতী পুঁথিতে (১৮৭৮) এবং পকেটবুকে (১৮৮৯); কয়েকটি মুখ, পাখি, একটি নারী, কিছু নমুনা আছে হেঁয়ালি চিত্রে (১৮৯২)। কিন্তু এসবের মধ্যে কোনও বিশিষ্টতার স্বাক্ষর নেই। আরও কয়েকবছর পরে জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি (শিলাইদহ, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০০) থেকে জানা যায় তিনি ‘একখানা স্কেচবুক নিয়ে বসে বসে ছবি’ আঁকছেন। তবে ‘যত পেন্সিল চালাচ্ছি, তার চেয়ে ঢের বেশি রবার চালাতে হচ্ছে।” এই স্কেচবুকটি পাওয়া যায়নি।
চিত্রকলা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যৌবন ও মধ্যবয়সের নানামন্তব্য বা রচনা থেকে মনে হয় না এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কোনওরকম মৌলিকতার অধিকারী। তরুণ বয়সে তিনি লেখেন, রবিবর্মার ছবির ‘দিশি বিষয় এবং দিশি মূর্তি ও ভাব’ তাঁর ‘সত্যি বেশ লাগে।’ আরও কিছুকাল পরের রচনায় তিনি স্বদেশিয়ানার সমর্থক (১৯০৫), তবে গগনেন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে কয়েক বছর পরে লেখেন, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিগুলি আর্য আদর্শের বিৃকতি বলে তাঁকে কিছুটা পীড়া দেয়। তাঁর ধারণা অনার্য প্রভাবের দ্বারা বিকৃত না হলে এ দেশের শিল্প গ্রিক ধরনেই গড়ে উঠত (১৯০৯)। পশ্চিমী আধুনিকতার প্রথম পর্বে অর্থাৎ বিশ শতকী চিত্রবিপ্লবের আগেকার বেশ কিছু ছবি তিনি তরুণ বয়সে দেখেছেন, কিন্তু তাঁর চেতনায় বড় কোনও ঢেউ ওঠেনি। অপরপক্ষে অবনীন্দ্রনাথরা যে আন্দোলন করছিলেন তার দুর্বলতা তাঁর মনে বাংলার সমকালীন আন্দোলনের অন্তঃসারশূন্যতাকে স্পষ্টতর করে তোলে। মীরা দেবীকে চিঠিতে ক্ষোভ জানিয়ে স্যানফ্রানসিস্কো থেকে লিখেছেন: ‘আশা করেছিলাম বিচিত্রা থেকে আমাদের দেশে চিত্রকলার একটা ধারা প্রবাহিত হয়ে দেশের চিত্তকে অভিষিক্ত করবে। কিন্তু এর জন্যে কেউ সত্যভাবে নিজেকে নিবেদন করতে পারলে না। ...কিছুরই সৃষ্টি হল না, কিছুই প্রাণ পেল না...সেই বেদনা কোথায়, কল্পনা কোথায়, আত্মদান কোথায় যার জোরে বিধাতার অভিপ্রায়কে মানুষ সার্থক করে তোলে?
বিধাতার অভিপ্রায় জানবার উপায় নেই, কিন্তু সেই বেদনা ও কল্পনার জন্য আরও একযুগের প্রস্তুতিপর্ব লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথ যে শেষ বয়সে ছবি আঁকায় মেতেছিলেন, শুধু মাতেননি প্রায় আড়াই হাজার স্কেচ এবং ছবি এঁকে নাটকীয় একাকীত্বে বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিক যুগ প্রবর্তন করেছিলেন, এই রহস্যের উৎস অবশ্যই তাঁর অতুলনীয় এবং বহুমুখী প্রতিভা। কিন্তু সেই উৎসবের কথা স্মরণে রেখেই হয়তৈা বলা চলে বিশের দশকে ত্রিবিধ অভিজ্ঞতার সমাবেশ তাঁর পোটো প্রতিস্বিকতার উদ্দীপনে সহায়ক হয়েছিল। পশ্চিমে চিত্রসাধনার ক্ষেত্রে যে বিপ্লব সেজান, মানে, গোগ্যাঁ, ভ্যান ঘঘ্ প্রভৃতির কাজের ভিতর দিয়ে সূচিত হয়েছিল তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় ১৯২০-২১ সালের ইউরোপ ভ্রমণের সময়ে। প্যারিস, আমষ্টারডাম, লাইডেন, ডার্মস্টাট-এ তিনি দ্বিতয়ি পর্বের আধুনিকদের কাজকর্ম দেখে ভরসা পান যে বাস্তবের অনুকরণ অথবা পরিচিত কাহিনী বা চারিত্রের অবলম্বন ছাড়াও সার্থক চিত্রকর্ম সম্ভব, যে প্রকাশের অনুকরণ অথবা পরিচিত কাহিনী বা চারিত্রের অবলম্বন ছাড়াও সার্থক চিত্রকর্ম সম্ভব, যে প্রকাশের প্রবল তাগিদ থাকলে আদিকালের মানুষের অশিক্ষিতপটুত্ব ছবি আঁকার পক্ষে যথেষ্ট। ১৯২৫ সালে পশ্চিমযাত্রীর ডায়রিতে তিনি লেখেন, ‘ইউরোপে আজকাল চিত্রকলার ইতিহাসে একটি বিপ্লব এসেছে, দেখতে পাই...আদিকালের মানুষ তার অশিক্ষিতপটুত্বে বিরল রেখায় যে-রকম সাদাসিধে ছবি আঁকত, ছবির সেই গোড়াকার ছাঁদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তর ভারপীড়িত আর্টের উদ্ধার নেই।’ তাঁর উদ্যেগে এবং ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের আমন্ত্রেণে বাউহাউস শিল্পীগোষ্ঠীর কাজের প্রদর্শনী হয় কলকাতায় ১৯২২ সালে; এই প্রদর্শনীতে ছিল অন্যান্য আধুনিকদের সঙ্গে লাওনেল ফাইনিংগার, পোল ক্লে এবং হ্বাসিলি কানডিন্স্কির কিছু ছবি। এঁরা সচেতনভাবে বস্তুরূপের অনুকরণ পরিহার করেছিলেন, রঙে রেখায় প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন আপন আপন অন্তর্লোককে। রবীন্দ্রনাথের ছবির উপরে এঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাব করতে চেয়েছিলেন আপন আপন অন্তর্লোককে। রবীন্দ্রনাথের ছবির উপরে এঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাব হয়তৈা অল্পই পড়েছিল; কিন্তু এঁদের সাফল্য তাঁকে সাহস যুগিয়েছিল, সঙ্কোচজয়ে সহায়ক হয়েছিল। তাঁর ছবির সঙ্গে জার্মান এক্সপ্রেশনিষ্টদের ছবির আত্মীয়তার কথা জার্মান সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন; প্রাণপ্রাবল্যে, রহস্যময়তায়, প্রক্ষোভের প্রকাশে সেই আত্মীয়তার সূত্র মেলে।
দ্বিতীয়ত, বিশের দশকে একদিকে যেমন বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতনের গুরুদেবি এবং ভারতত্মার প্রতিনিধি ও প্রবক্তা হিসেবে তাঁর স্বনির্বাচিত ভূমিকা ক্রমেই অত্যন্ত গুরুভার হয়ে ওঠে-‘আছি বার্লিনে-বড়োলোক সেজে বড়ো কথা বলতে হবে-বড়ো খ্যাতির বোঝা বয়ে চলতে হবে দিনের পর দিন” অন্যদিকে তেমনি সত্যাগ্রহ ও অসহযোগের রাজনীতি তাঁর পারক্য ও মানস নিঃসঙ্গতাকে প্রকটতর করে তোলে। তাঁর এ সময়ে একান্ত প্রয়োজন হয়েছিল এমন নির্ভৃতির, এমন কোনও গোপন ভাষার যেখানে নিজের নিরুদ্ধ অস্তিত্বকে মেলে দেওয়া যায়, যেখানে বাণী বিতরণের অথবা স্বনির্মিত মুখোশ পরার দায় নেই, সেখানে প্রকাশ স্বয়ংসিদ্ধ এবং ব্যাখ্যাতীত। গুরুদেবি জোব্বা কখনও-সখনও খুলে ফেলে, বাঙ্গালী ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে ব্যাখ্যা করবার দায়িত্ব মাঝে মাঝে বিস্মৃত হয়ে, নিজের তৈরি জীবনদেবতার আদলে নিজেকে রচনার দুঃসহ কর্তব্য সাময়িকভাবে সরিয়ে রেখে, বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের বিড়ম্বনা থেকে অল্পক্ষনের জন্য হলেও মুক্ত হয়ে শৈশবের গরুত্নতী কল্পনায় ফিরে যাওয়া, নির্জ্ঞানের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া, অপরনিরপেক্ষ নিরভিমান একান্ত কোনও সান্দ্র ভাষায় নিজের নিরুদ্ধ আবেগ ও কামনাকে প্রকাশ করা-ঘনায়মান অন্ধকারে এই প্রয়োজন তীব্রতর হয়েছিল। আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্বের বিষয়মুক্ত, চেতনাবিমুখ, নির্জ্ঞানপুষ্ট, পরস্পরাবিনাশী, একান্ত ও স্বপ্রকাশ ছবির জগতে তিনি সেই নিভৃতি এবং পরিবেশনিরপেক্ষ ভাষার সন্ধান সম্ভবত পেয়েছিলেন।
আর বিশের দশকে তাঁর জীবনে সব চাইতে স্মরণীয় এবং ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা ভিকটোরিয়া ওকাম্পোর বন্ধুত্ব। কিছুকাল আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রভক্তদের কাছে ভিকটোরিয়ার পরিচয় ছিল শুধু একজন বিদেশিনী রবি-অনরাগিনী হিসেবে। ডরিস মায়ার কৃতমায়ার কৃত ওকাম্পোজীবনীটি (১৯৭৯) প্রকাশিত হবার পর আমরা জানতে পারি আপন ব্যক্তিত্বে, বৈদগ্ধ্যে এবং বহুমুখ সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের সম্পন্নতায় ভিকটোরিয়া রবীন্দ্রনাথের যথার্থ আত্মীয় ছিলেন। ভিকটোরিয়া এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র ও সম্পর্ক নিয়ে কয়েক বছর যাবৎ কেতবী কুশারী ডাইসন যে গবেষণা করেছেন সেটি গ্রন্থকারে প্রকাশিত হলে অনেক নতুন তথ্য আমাদের গোচরে আসবে। আমার বক্তব্যের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই আমার, তবে বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে ডরিস মায়ার-এর বইটি এবং কেতকীর গবেষণার প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ আমার অবশ্য কর্তব্য মনে করি।
আমার নিজের ধারণা রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল দীর্ঘ জীবনের মাত্র দুটি নারীই তাঁর অস্তিত্বে প্রবল এবং স্থায়ী আলোড়ন তুলেছিলেন। প্রথম জন ছিলেন তাঁর কবিতার আধিপর্বের প্রধান উৎস; এই বিদ্যুন্নিভ অভিমানিনীর যৌবনে আত্মহত্যা কবির মনে জীবনব্যাপী বেদনা ও গ্লানি রেখে যায়। বিশেষ কোনও নারীর প্রতি কামনা-উদ্বেল ভালবাসাকে ক্রমে তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলতে শেখেন। কল্পিত জীবনদেবতার রাগ-অনুরাগে, মান-অভিমানে প্রেমকে অধ্যাসিত করে তিনি তাঁর গানে এবং কবিতায় এমন একটি সুপ্রত¦র স্রোতস্বিনী প্রবাহিত করেন যা বৈষ্ণব-বাউল পরস্পরার সঙ্গে যুক্ত হয়েও বিশেষভাবে রাবীন্দ্রিক। গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য এবং গীতালি পর্বের (১৩১৫-১৩২১) শেষে এই সযত্ন প্রবাহিত স্রোত শীর্ণ হয়ে আসে। বলাকায় (১৩২১-২২) এবং পলাতকায় (১৩২৫) জোরালো ঘোষণা, যুক্তি, ব্যাখ্যা, কাহিনী ইত্যাদি আছে, কিন্তু অনুভবের গভীরতা দুর্লভ। এসব কবিতা আবৃত্তি করবার, নির্ভৃতে পড়াবার নয়। ব্যক্তির যেটি তীব্রতম, ভঙ্গুরতম, সরসতম এবং আর্ততম সম্পর্ক সেটির অভাব প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথের কাছে কতটা দুঃসহ ঠেকেছিল জানি না, কিন্তু পূরবীর প্রথম দিকের কবিতাগুলির বাকবিস্তারের আড়ালে অন্তর্লোকের কিছুটা আভাস হয়তো পাওয়া যায়। প্রেয়সীর পীড়িত প্রার্থনা শুনে আচম্বিতে জাগবার ইচ্ছে শুধু কি কালের অধীশ্বরের? নিদ্রাহীন বেদনায় শেষবার কোন রমণীর স্পর্শের জন্য হারনা মারু জাহাজে তিনি প্রতীক্ষমান? অতীতকালের ফসল ফলানো কোন রমণীকে সঙ্গীহীন সৌন্দর্যহীন শূন্যঘরে ভুলে যাওয়ার জন্য তাঁর সকরুণ ক্ষমা প্রার্থনা। নিদ্রাহীন প্রার্থণা?
পূরবীর শেষের দিকের কবিতাগুলি থেকে খবর মেলে যে ভিকটোরিয়া ওকাম্পোর সান্নিধ্যে এসে তাঁর ভিতরে বিস্মৃত প্যাশনের আরেকবার প্রজ্জলন ঘটেছিল। যে নারী তাঁর প্রবাসের দিনগুলি মাধুর্যসুধার পরিপূর্ণ করে দিয়েছিলেন সন্ধ্যালোকে তাঁর চোখে তিনি দেখেছিলেন নিজের বার্ধক্যাক্রান্ত নিঃস্বর্তাকে, তাঁর কাছে সকাতরে চেয়েছিলেন একটি ফাল্গুন। কিন্তু সঙ্গে ছিলেন বিবেকী যুবক এল্ম্হার্স্ট; রবীন্দ্রনাথের অনুরাগিনী ভিকটোরিয়ার প্রেম সে সময় ছিল বন্য পুরুষের সমর্পিত; এবং প্যাশনের আগুনে খ্যাতির জোব্বাখানি পোড়ানোর বেহিসেবীপনা রবীন্দ্রনাথের অনুশীলিত চরিত্রে সম্ভব ছিল না। ‘একলা প্রাণের মুগ্ধ ডাক’ তাই তিনি সরাসরি ভিকটোরিয়াকে শোনাতে পারেননি। আরও কিছু ফসল ফলেছিল সামান্য সময়ের ব্যবধানে মহুয়ার কবিতায়। কিন্তু প্রজ্বলিত আগুনের অনেকটাই চালিত হল ভিন্ন পথে; ছবির নিরভিধান, আদিম, অনুভূতিবেদ্য কিন্তু প্রসঙ্গরিক্ত ভাষায়।
ত্রিবিধ অভিজ্ঞতার সমকালীন উপাদান থেকে প্রতিভা যার স্ফুরণ ঘটালো তার প্রথম অনিশ্চিত পর্বের বিবরণ বহুকথিত। পূরবীর পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটিগুলিকে জোড়ার সময়ে নানা অপরিকল্পিত কিন্তুুত রূপ আকার নিতে শুরু করে। ভিকটোরিয়া সেই আঁকিবুঁকি দেখে মুগ্ধ অনুমতি নিয়ে পাণ্ডুলিপির কয়েকটি পৃষ্ঠার ফটো তোলেন। কবিকে সেই কলমের আঁচড়ে কাটাজোড়ার খেলায় বিশেষ উৎসাহিত করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরে নানা সময়ে এর বিবরণ দেন। “কবিতা লিখতে কাটাকুটি করতুম, সেই কাটাকুটিগুলো যেন রূপ নিতে চাইতো, তারা হতে চাইতো, জন্ম নিতে চাইতো। তাদের সে দাবী আমি অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। পড়ে থাকত লেখা, সেই কাটাকুটিগুলোতে রূপ ফলাতুম, পারতুম না তাদের প্রেতলোকে ফেলে রাখতে। এই ভাবে আমার ছবি শুরু।” কাটাকুটি থেকে শুরু হলেও এই নতুন খেলা সেখানেই আটকে পড়ে রইল না। ভিকটোরিয়ার সূত্রে জানা যায় যে রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্রভাবে ছবি আঁকার কথা তাঁকে বলেন। রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা শুরু হয় সম্ভবত ১৯২৭ সাল থেকে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত তিনি অজস্র ধারায় ছবি আঁকেন। তাঁর সর্বশেষ আঁকা যে ছবিটি আমি দেখেছি সেটির তারিখ ২৩শে চৈত্র, ১৩৪৭। মৃত্যুর চার মাস আগে কালো রঙ্খড়িতে আঁকা এই ছবিটিতে যে নারীর আবক্ষ-রূপ বিধৃত তার মাথায় আধখানা ঘোমটা, কালো চুলের স্রোত গাল বেয়ে এসে পড়েছে কাঁধে, চোখদুটি নিচের দিকে নামানো, মুখের ভাব গম্ভীর, আত্মনিমগ্ন। খুব অল্প কয়েকটি রেখায় ফুটে উঠেছে রহস্যময় একটি অস্তিত্ব, চুলের রেখারাশি আঙুল দিয়ে ঘষে দেওয়ার ফলে মুখের ডৌল স্পষ্টতা পেয়েছে। ফলত তাঁর জীবনের শেষ পর্বে কবিতা অথবা গানের চাইতে তিনি বেশি ছবি এঁকেছেন, এবং তাঁর বিরাট ও বিচিত্র কৃতির বিচার দূরের কথা প্রাথমিক পরিচয় পর্যন্ত এতাবৎ অলিখিত।
চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের কাজ যে কত বিচিত্র ও বিরাট পরিমাণ, প্রত্যক্ষভাবে তা জানবার সুযোগ ঘটে যখন ১৯৯২ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ওপর উচ্চতর গবেষণার জন্য। সেই সময় শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে আমার সম্যক পরিচয় ঘটে। সব ছবি রবীন্দ্রভবনসংগ্রহে নেই। পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটি ও স্কেচ ছাড়া যে ১৫৭৪টি ছবি ওই সংগ্রহে আছে তাদের ভিতরে অনেকগুলিতে স্বাক্ষর নেই, অনেকগুলিতে তারিখ নেই, অনেকগুলির স্বাক্ষর দেখে সন্দেহ হয় সেগুলি আঁকার সময় স্বাক্ষরিত হয়নি। সম্ভবত পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ রথীন্দ্রনাথের আগ্রহে সেগুলিতে পাইকারিভাবে সই করেছিলেন। ফলে প্রায় পনের বছরের সমগ্র চিত্রকৃতিতে সুনির্দিষ্ট সময়ক্রম হিসেবে সাজানো খুবই কঠিন, হয়তো বা একেবারেই অসম্ভব। তবে যে ছবিগুলিতে তারিখ আছে সেগুলির বিষয়, উপাদান, অঙ্কনপদ্ধতি এবং মেজাজ অভিনিবেশের সঙ্গে লক্ষ করে এবং ১৯৩২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামের আগে ‘শ্রী’ বর্জন করেন একথা স্মরণে রেখে ভবনসংগ্রহের ছবিগুলির একটি প্রাথমিক এবং পরীক্ষামূলক পর্ববিন্যাস হয়তো করা যেতে পারে।
সমস্ত মিলিয়ে এই চিত্রসম্ভারের ভিতরে যে বৈশিষ্ট্যগুলি সুবেদি দর্শকের মনে ঢেউ না তুলেই পারে না সেগুলি হল এদের অন্তরে নিহিত অন্ধকার আকুতি, এদের প্রবল এবং অসংস্কৃত প্রাণশক্তি, বাইরের জগতের প্রতিফলন নয়, এদের ভিতরে মগ্নচেতন লোকের অপরিকল্পিত উৎক্ষেপণ। রবীন্দ্রনাথ রাণী মহলানবিশকে লিখেছেন, “কবিতার বিষয়টা অস্পষ্টভাবেও গোড়াতেই মাথায় আসে, তারপরে শিবের জটা থেকে গোমুখী বেয়ে যেমন গঙ্গা নামে, তেমনি করে কাব্যের ঝরণা কলমের মুখে তা রচনা করে, ছন্দে প্রবাহিত হতে থাকে। আমি যেসব ছবি আঁকার চেষ্টা করি, তাতে ঠিক তার উলটো প্রণালী-রেখার আমেজ প্রথমে দেখা দেয় কলমের মুখে, তারপর যতই আকার ধারণ করে, ততই সেটা পৌঁছতে থাকে মাথায়” (২১শে কার্তিক, ১৩৩৫)। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে জানিয়েছেন: আমি কোনো বিষয় ভেবে আঁকিনি দৈবক্রমে একটা অজ্ঞাতকুলশীল চেহারা চল্তি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে।” (২রা পৌষ, ১৩৩৮)। কোনও নির্দিষ্ট ভাবের সচেতন প্রতিমারচনা, কোনও পরিচিত ঘটনা কিংবা চরিত্রের দ্বিমাত্রিক বর্ণন, কোনও দৃশ্যরূপ বা ব্যক্তি বা বস্তুর সঠিক প্রতিফলন-এসব এদের উদ্দেশ্য নয়। নিজের ভিতরে নিহিত যে অস্তিত্ব নানা প্রকাশ্য-ভূমিকার আড়ালে নিরুদ্ধ হয়েছিল তারি প্রবল এবং অপরিকল্পিত প্রকাশ এদের প্রাণবন্ত করেছে, প্রয়োগের স্বল্পপটুতায়, অনুভবের আর্তিতে, বিষাদের অন্ধকারে বিদ্যুতাগ্নি আহিত করেছে।
সাধারণভাবে এইসব বৈশিষ্ট্যের কথা সত্য হলেও বেশ কিছু ব্যতিক্রমও রবীন্দ্রভবনসংগ্রহে চোখে পড়ে, এবং বিভিন্ন পর্বে মেজাজ, রীতি, অঙ্কনপদ্ধতি ও বিষয় সমারোহেও কিছু কিছু পার্থক্য ও পরিবর্তন দেখা যায়। মুখ্যত কলম এবং নানা রঙের ওয়াটার প্রুফ কালির উপরে নির্ভর করলেও কোনও কোনও পর্বে তুলি, গুঁড়ো রং, টিউব রং, ক্রেয়ন, প্যাস্টেল, চারকোল ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে বা কমেছে; কখনও ক্কচিৎ তেলরং নিয়েও পরীক্ষা করেছেন। গোড়ায় যা হাতে পেয়েছেন তাতেই এঁকেছেন। পরে জার্মানী থেকে উৎকৃষ্ট কাগজ আনিয়েছেন, সংগ্রহ করেছেন ফরাসী কালি। রাণী মহলানবিশকে লিখেছেন, “আমার ছবি রেখার ছবি, রঙের ছবি; ভাবের ছবি নয়”, কিন্তু তিরিশের দশকের বেশ কিছু ছবিতে পরিকল্পনার, প্রতিকৃতি আঁকার চেষ্টা নজর এড়ায় না। চর্চার ফলে প্রায়োগিক নিপুণতা বেড়েছে, সচেতন নির্দেশ অবচেতন-উদ্ভূত বিক্ষোভকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে, চেতন-মগ্নচেতনের সংঘর্ষ কখনও তীব্রতর, কখনও শিথিলতর হয়েছে। তবু সব মিলিয়ে অধিকাংশ ছবিই একান্তভাবে ব্যক্তিমাত্রিক, স্বসমুত্থ, সংজ্ঞামুক্ত, এবং এই চারিত্রবলেই ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক যুগের প্রবর্তক এবং প্রথম শক্তিমান শিল্পী। তিনি যে সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেন তারি আকর্ষণে প্রচলের সঙ্কীর্ণ প্রদক্ষিণ থেকে বেরিয়ে আসেন রামকিঙ্কর, পানিক্কর, ফিদা হুসেন, সতীশ গুজরাল প্রমুখ শিল্পীরা। যামিনী রায় লিখেছিলেন, “গত দু’শ বছর ধরে, রাজপুত আমল থেকে আজ পর্যন্ত, আমাদের দেশের ছবিতে যে-অভাব বেড়ে চলেছিল, রবীন্দ্রনাথ সেই অভাবের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করতে চান, ছবির জন্যে খোঁজেন সতেজ শিরদাঁড়া।” এই শিরদাঁড়া অ্যানটমির ব্যাপার নয়-এর অন্য নাম স্বকীয়তা বা ব্যক্তিত্ব, যে ব্যক্তিত্ব আরোপিত নয়, যা ভ্রান্তি, দ্বন্দ্ব, প্রক্ষোভ, আর্তি, অনুসন্ধান সবকিছুর ভিতর দিয়ে হয়ে ওঠে এবং নিজেকে প্রকাশিত করতে চায়। রবীন্দ্রনাথের ভিতরে যে ডাওনিসিয়ান অস্তিত্ব সংজ্ঞানির্ভর ভাষায় স্বচ্ছন্দ প্রকাশ পায়নি ছবির অভিপ্রায়হীন, তাৎপর্যবিমুখ উদ্গতিতে তার প্রকাশ মেলে।
কিন্তু যতই না কেন আদিমতা, শৈশবের অনবমিত কল্পনাবিস্তার, অবচেতনের প্রবল প্রক্ষোভ আধুনিক শিল্পীর প্রেরণার উৎস হোক, নিপুণতাহীন প্রক্ষোভ বা কল্পনা শিল্প হয়ে ওঠে না। এই স্ববিরোধ আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্বের শিল্প-আন্দোলনের কেন্দ্রে সক্রিয় এবং রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এই স্ববিরোধ ক্রমে স্পষ্টতর হয়েছে। ১৯২৮ সাল থেকে চিত্রকর্মে নিমগ্ন হওয়া সত্ত্বেও গ্যালারি পিগালে (২রা মে, ১৯৩০) প্রথম প্রদর্শনী না হওয়া পর্যন্ত তিনি সে সম্পকে নিতান্ত অনিশ্চিত ও দ্বিধাগ্রস্ত। তারপর বার্মিংহ্যামে, লন্ডনে, বার্লিনে, ড্রেসডেনে, কোপেনহেগেনে, জেনিভায়, মস্কোতে এবং বস্টন ও নিউইয়র্কে একই বছরে পর পর অনেকগুলি প্রদর্শনী হওয়ার ফলে এবং পশ্চিমী সমালোচকরা তাঁর এই নতুন কৃতির তারিফ করায় তিনি তাঁর ছবি আঁকাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। তখন ব্যবহৃত উপাদানের উৎকর্ষের দিকে নজর যায়, কিছুট প্রায়োগিক নিপুণতা অর্জনের দিকে আগ্রহ বাড়ে, ভিতরকে প্রকটিত করবার প্রয়োজনে বাইরের রূপভেদ ও সাদৃশ্যজ্ঞানের উপযোগিতা একেবারে আর অবান্তর ঠেকে না। গোড়ার দিকে প্রাকপুরাণিক কিম্ভূতের, মগ্নচেতনিক বিক্ষোভের প্রাবল্য যতটা ব্যাপক, পরের দিকে সে তুলনায় কলম, তুলি, খড়ি বা পেন্সিলের নিপুণতার প্রয়োগে নিসর্গচিত্র এবং মুখাকৃতি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। সাদৃশ্য আনবার চেষ্টা করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু এই সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তত এই প্রয়াসের প্রেষ থেকে তিরিশের মধ্য এবং শেষভাগের বেশ কিছু ছবি জন্ম নিয়েছে, যেগুলিতে দৃঢ় মুখাকৃতি ও স্থির ল্যান্ডস্কেপের রং ও রেখাঙ্কন অবচেতনিক প্রাণশক্তির প্রক্ষোভে রহস্যময় ও বেগবান।
১৯২৮-২৯-৩০ এর ছবিগুলি মুখ্যত কলম দিয়ে কালির রেখায় আঁকা। কিছু ছবিতে সরলরেখা ও কৌণিক প্রখরতা প্রবল, কিছু ছবিতে আঁকাবাঁকা রেখায় অদ্ভুত, অদৃষ্টপূর্ব নানা রূপ আকার পেয়েছে। অনেক ছবিতে তিনি হালকা রঙের উপরে কলম দিয়ে কাটাকুটি করে সেই রঙেরই ঘন বুনোট দিয়েছেন। প্রায় ছবিতেই পশ্চাদ্পট অন্ধকার, তা থেকে উত্থিত জনকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছেন শাদা ফাঁকের ঘের দিয়ে (দ্রষ্টব্য ঝরণা কলম এবং ওয়াটারপ্রুফ কালিতে আঁকা হিংস্র জলঢরের মুখ, তারিখ এবং স্বাক্ষরহীন)। পাখী এবং সরীসৃপদের অবলম্বন করে আঁকা কাল্পনিক আকারের সমারোহ ১৯৩১-৩২ পর্যন্ত বেশি দেখা যায়। এই সময়ে ওয়াটারপ্রুফ কালির সঙ্গে জররঙ-ও ব্যবহার করেন (দ্রষ্টব্য তালিকা সংখ্যা ২১৬০, রবীন্দ্র-সাক্ষরিত, কিন্তু তারিখহীন)। এই সময়ে আঁকা কিছু নিসর্গচিত্রে কলম এবং তুলি, ওয়াটারপ্রুফ কালি এবং জলরঙের নিপুণ সমন্বয় লক্ষণীয়। সায়াহ্নিক আকাশের সোনায় অপেক্ষামান রাত্রির ছায়া, নিচে গাছপালার পুঞ্জিত অন্ধকার, অন্তর্লোকের একটি বিশেষ অবস্থাকে দৃশ্যমান করে তুলেছে।
১৯৩৫-৩৬ থেকে তাঁর ছবিতে মানুষের রূপই ক্রমশ প্রাধান্য পায়। নানারকমের মুখ-মানুষের লোভ, হিংসা, সন্দেহ, ধ্বংসের প্রবণতাও যেমন ব্যঞ্জিত রূপ পেয়েছে তেমনই মাঝে মাঝে উদ্ভাসিত হয়েছে মানুষের দার্ঢ্য, আভিজাত্য, আত্মসমাহিত গাম্ভীর্য। ১৯৩৬ সালের ১০ই বৈশাখে আঁকা তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতে তাঁর অন্তর্লোকের যেমন পরিচয় মেলে অপরের আঁকা পোর্ট্রেট বা কোনও ফটো থেকে তার আভাসও মেলেনি। তুলি এবং কলম দুই ব্যবহার করেই ছবির বুনোট বয়নে এবং অন্ধকার পশ্চাদ্পটের বৈপরীত্যে আকৃতির বর্ণাঢ্য অস্তিত্বকে পরিস্ফুট করায় তাঁর অর্জিত নিপুণতা এই সময়ে যেন পরাকাষ্ঠায় পৌঁছয় (দ্রষ্টব্য তালিকা সংখ্যা ২৬১৮, স্বাক্ষরিত ও তারিখ সংবলিত দন্ডায়মান নারীমূর্তি, ১.৮.১৯৩৯; পেন্সিলে টানা নকশার উপরে কলম ও তুলি দিয়ে কমলা, মাদামি ও কালো ওয়াটারপ্রুফ কালির প্রয়োগ)। ১৯৩৭ থেকে তাঁর রেখায় কিছুটা দুর্বলতা চোখে পড়ে, কিন্তু ১৯৪০ পর্যন্ত ছবি আঁকার স্রোতে শীর্ণতা আসেনি। পেন্সিলের নকশার উপরে কলম আর তুলি দিয়ে ওয়াটারপ্রুফ কালিতে অনেক ছুরি এঁকেছেন, বিশেষ করে নারীমূর্তি, তাদের মধ্যে বুনোটের ফাঁক থাকলেও স্বকীয়তা দীপ্যমান (দ্রষ্টব্য তালিকা সংখ্যা ২৫১৩, স্বাক্ষরিত তারিখ ১৯৩৯)। হাতের জোর কমে আসায় চওড়া তুলির ব্যবহার বেড়েছে, কিন্তু কখনও কখনও অসামান্য নিপুণতায় সূক্ষ্ম কলমের আঁচড়ে শাদার উপরে কালো কালি দিয়ে নিগূঢ় সংকেমময় মুখাকৃতি এঁকেছেন-যেমন ঘন তার বুনোট তেমনি দৃঢ় তার চরিত্র (দ্রষ্টব্য তালিকা সংখ্যা ২৯৮৩, স্বাক্ষরিত ও তারিখ সংবলিত ১১.১১.১৯৩৯)। ১৯৩৯ সালেরও এঁকেছেন অনেক নারীমূর্তি, রং-এর প্রলেপহীন বিশুদ্ধ রেখায় টানা মুখ, আবার কলম এবং মোটা তুলিতে আঁকা মুখ-যৌবনবতীরা কেউ বিষণ্ন, কেউ উদাস, কেউ আর্ত, আবার কারো বা চোখেমুখে ব্যঙ্গমিশ্রিত কৌতুকের আভাস। ১৯৪০ সালেরও বেশ কয়েকটি যুবতীমুখ এঁকেছেন-তাদের কারও চোখে ক্ষুব্ধ অভিযোগ, মুখের একপাশ চুলের অন্ধকারে আবৃত (দ্রষ্টব্য তালিকা সংখ্যা ২৫৩১)। তাছাড়া বাদামি কালিতে ন্যাকড়া চুবিয়ে এঁকেছেন জোরালো মুখোস (দ্রষ্টব্য তালিকা সংখ্যা ৩৪১৩, স্বাক্ষরিত ও তারিখ সংবলিত ১৬.৪.১৯৪০)। ১৯৪১ সালে নারীরূপের কথা আগেই উল্লেখ করেছি (তালিকা সংখ্যা ২৩০২ স্বাক্ষরিত, তারিখ সংবলিত ২৩ চৈত্র ১৩৪৭)। ফলত গানের ভিতর দিয়ে হয়তো তিনি শান্তিপারাবারের সন্ধান পেয়েছিলেন, কিন্তু ছবিতে তাঁর বিক্ষুব্ধ অবচেতন প্রায় শেষ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।
তবে এসবই প্রস্তাবনা মাত্র। যোগ্য আলোচকের জন্য পটুয়া রবীন্দ্রনাথকে হয়তো এখনও বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। চিত্রবিচারে পারঙ্গম, রবীন্দ্রচর্চায় বিদগ্ধ, আধুনিক যুগের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সুপণ্ডিত, সুবেদি, নিষ্ঠাবান এবং অধ্যবসায়ী -এতগুলি গুণসম্পন্ন ব্যক্তি সহজে মেলবার কথা নয়। কিন্তু যে যোগ্য আলোচক এ কাজটি করবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁর কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ বোধ করবে, তাতে সন্ধেহ নেই।