একটি ভবন
গড়ে ওঠা থেকে শুরু করে এর কার্যক্রম চলা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপের সঙ্গে
সরাসরি ছয়টি সংস্থা যুক্ত থাকে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি
করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য
মন্ত্রণালয়ও সংযুক্ত রয়েছে। কারণ, এসব সেবা সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের
মধ্য দিয়ে এসব ভবন গড়ে ওঠা ও এর কার্যক্রম চলার কথা। কিন্তু কার্যত
নিয়মকানুন কোনো কিছুই মেনে চলা হয় না। সেখানে সিঁড়ি,
অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, ভবনের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ এবং আলো-বাতাস চলাচলের
ব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে ইমারত বিধিমালার লঙ্ঘন হয়েছে।
অগ্নিনিরাপত্তার প্রথম শর্ত অনুযায়ী উন্মুক্ত স্থানে সিলিন্ডার রাখার সুযোগ
নেই। আর ভবনের জরুরি নির্গমন (ফায়ার এস্কেপ) পথেও এ ধরনের সিলিন্ডার রাখা
যাবে না। অথচ ভবনটির জরুরি নির্গমন পথ রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস
সিলিন্ডার সজ্জিত করে রাখা হয়েছে।
যদি কোনো কারণে সেখানে সিলিন্ডার
বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটত, তাহলে আগুন পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত। কাচ দিয়ে ঘিরে
যেভাবে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিও সঠিক নয়। ঢাকার অনেক বাণিজ্যিক
ভবনের বিভিন্ন তলায় রেস্তোরাঁ বানিয়ে ব্যবসা করার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে
বহুদিন থেকেই। এসব রেস্তোরাঁয় রাখা গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর কারণে ভবনগুলো
‘টাইম বোমা’য় পরিণত হয়েছে। একটি নিয়ম অনুযায়ী ভবনের নির্মাণ কাঠামো ও নকশা
করতে হয়। ইচ্ছা করলেই বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ করার কোনো সুযোগ
নেই। বিশেষ করে রেস্তোরাঁর জন্য যে ধরনের রান্নাঘর দরকার হয়, তা সাধারণ
বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য তৈরি করা ভবনে থাকে না। রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের
জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা দরকার হয়। ঢাকার অনেক বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায়
রেস্তোরাঁ আছে। সেসব ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা কতটুকু মেনে চলা হচ্ছে, সেটি
কখনো ভেবে দেখা হয় না। ভবনগুলো একেকটি টাইম বোমার মতো বসে আছে।
বাংলাদেশ
এ রকম একটি দেশ, যে দেশে বছরে আট মাস এসি ছাড়া থাকা যায়। সেখানে এ ধরনের
কাচঘেরা আবদ্ধ ভবন তৈরি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ ধরনের ভবনে বায়ু
চলাচলের কোনো ব্যবস্থা নেই। এগুলোয় বেশি বেশি এসি ব্যবহারের কারণে অতিরিক্ত
বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। ঢাকার ভবনগুলো নিরাপদ করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সরকারের চেষ্টায় মাত্র আড়াই বছরে সর্বোচ্চ সবুজ শিল্পের দেশে রূপান্তরিত
হয়েছে বাংলাদেশ। টাস্কফোর্স গঠনের মধ্য দিয়ে মাত্র তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে
ভবনগুলো নিরাপদ করা সম্ভব।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার
সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের আইন ও
বিধিমালা মেনে ওই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে এবং নির্মাণের পর সেখানকার সব
কাজও যে আইন মেনেই হচ্ছে, সেই মর্মে একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভবন মালিককে
একটি সার্টিফিকেট তথা সনদ দেবে। সনদ প্রাপ্তির পর ভবন মালিক সেটিকে ফলক বা
নোটিশ আকারে ভবনের সামনে টাঙিয়ে রাখবেন। যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো
উদ্যোগ দেখা যায় না। এর কারণ ‘এই সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য একক কোনো
কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই।’ আমাদের এখানে একটা ভবন করা হলে ধরেই নেওয়া হয় যে
সব সংস্থার অনুমোদন নিয়ে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে,
ঘটনা ঘটার পর কর্তৃপক্ষ হাত গুটিয়ে বলছে যে আমার অনুমোদন নেয়নি। কেউ বলছে,
নিয়েছিল কিন্তু ব্যত্যয় করেছে।
‘সার্টিফিকেশন’-এর নিয়ম বিশ্বের সব দেশে
আছে। পৃথিবীর সব দেশেই একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন সার্টিফিকেশন দেয় এবং
সেটা প্রকাশ্যে লাগিয়ে রাখতে হয় যে এই ভবনটি সব আইনকানুন মেনে পরিচালনা করা
হয়েছে। তবে শুধু সার্টিফিকেট প্রাপ্তিই শেষ কথা না, প্রতি বছর তাকে
নবায়নযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। একটা ভবন নিরাপদ কি না, সেটা সাধারণ মানুষ
বুঝতে পারছে না; রাষ্ট্র এখানে সবচেয়ে বড় অপরাধ করছে। যেহেতু রাষ্ট্র এখনো
শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না যে তার রাষ্ট্রের সব ভবন নিরাপদ; সেহেতু একটি
ভবন যে নিরাপদ, সেটার অনুমোদন প্রকাশ্যে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা
জরুরি। এটিকে একটি উন্মুক্ত স্থানে সাধারণের জন্য প্রদর্শন করতে হবে।
রাজধানী
উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি ভবন অনুমোদনের জন্য যে বিষয়গুলো নজরে রাখা দরকার
সেটা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই ভবন কোনোভাবে অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য নয়।
রেস্টুরেন্ট করা বাণিজ্যিক কিচেন ইত্যাদি অনেক জটিল নকশা। এটি না দেখে
ইচ্ছামতো অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়। অনুমোদন না নিয়ে সিটি করপোরেশন কার্যক্রম
পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে, সেটিও কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ সরকারকে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ রকম একটি ভবনের
যারা অনুমোদন দিয়েছেন তাদের সবাইকে এবং এই সংস্থার প্রধানকে অবহেলাজনিত
হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। সাধারণত দেখা
যায়, আগুনে পুড়ে যতটুকু না ক্ষতি হয়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে তার চেয়ে বেশি
মানুষের প্রাণহানি হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
কোনোভাবেই নিবাস নির্মাণের যে নীতিমালা আছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না
হওয়ার কারণে অনুমোদন দিতে পারে না। অনুমোদন দিতে গেলে কিছু নিয়মকানুন লক্ষ
রেখে অনুমোদন দিতে হয়। অনুমোদন না নিয়ে সিটি করপোরেশন কখনো ট্রেড লাইসেন্স
দিতে পারে না। ফায়ার ব্রিগেড সতর্ক করার পরও জোরপূর্বকভাবে এরা তাদের
কার্যক্রম চালিয়েছে, যা নীতিবহির্ভূত।
বর্তমানে আবার আরেকটা বিষয় চোখে
পড়ার মতো। তা হলো- ফুটপাতের অধিকার শুধু পথচারীদেরই, আর কারও নয়। হকাররা
বসছেন। সিটি করপোরেশন চাঁদাবাজদের রুখতে পারছে না। হকারদের বন্ধের দিন একটা
নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনায় বসতে দেওয়া যেতে পারে। তবে আমি আবারও বলছি, ফুটপাত
ব্যবহারের অধিকার শুধু পথচারীদেরই। ফুটপাতে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আলোকে
হকারদের বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বন্ধের দিন সময়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা
দরকার। কিন্তু এ জন্য তেমন কোনো সমীক্ষা বা পাইলট প্রকল্প হয়নি। এ জন্য
আসলে যে মানবিক মানসিকতা দরকার সেটি নেই। রাজনৈতিক দলের মাস্তান ও পুলিশ
ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি করে। এদের একটা সিস্টেমে আনতে পারলে ভালো হবে।
সেজন্য একটা স্ট্রাকচার্ড সিস্টেম দরকার। তাহলে সিটি করপোরেশন ফুটপাতে
চাঁদাবাজি কিছুটা হলেও রুখতে পারবে।
লেখক: স্থপতি ও পরিবেশবিদ; সহসভাপতি
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)