বাজেট
একটি দেশের সকল মানুষকে ভিন্ন ভিন্নভাবে স্পর্শ করে। ব্যক্তি, পরিবার,
প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার সবার ক্ষেত্রেই বাজেট একটি ভাবনার বিষয়। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ট্রেজারি প্রধান জেক ল্যু এর মতে, ‘বাজেট শুধু কিছু
সংখ্যা নয়, এটি আমাদের আশা ও আকাংখার বহিঃপ্রকাশ’। বইয়ের ভাষায় বাজেট
হচ্ছে আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব
বিষয়ক হাতিয়ার। অর্থনীতির ভাষায় 'বাজেট হলো নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য
সরকারের আর্থিক পরিকল্পনা, যেটি বর্ণনা করে সম্পদের পরিমান, সে সম্পদ
কিভাবে তা যোগাড় হবে এবং সেই নির্দিষ্ট মেয়াদে সেটি কিভাবে ব্যয় করা হবে।
গইপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বাজেট’ শব্দটির পরিবর্তে ‘বার্ষিক আর্থিক
বিবরণী’ ব্যবহার করা হয়েছে, যা একটি নির্দিষ্ট অর্থ বছরের আনুমানিক
আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখায়। আমাদের সংবিধানের ৮১ থেকে ৯২ পর্যন্ত আর্টিকেলে
বাজেট পদ্ধতির/ প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ
সরকার গতানুগতিক পদ্ধতিতে বাজেট প্রণয়নের পরিবর্তে ‘মধ্যমেয়াদি বাজেট
কাঠামো’র আওতায় বাজেট প্রণয়নের কাজ করে থাকে। মূলত তিনটি ধাপে বাজেট
প্রণয়নের কাজটি করা হয়ে থাকে, যেগুলো হলো- ১) সামষ্টিক অর্থনীতির মডেলিং
ধাপ, ২) অনুমানভিত্তিক হিসাব প্রণয়ন ধাপ, ৩) বাজেট অনুমোদন ধাপ। সরকারের
সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকলেও মূলতঃ
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অর্থ বিভাগের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীন সম্পদ বিভাগ,
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়/ পরিকল্পনা কমিশন এ
প্রক্রিয়ার সাথে সার্বিক ভাবে জড়িত থাকে। তাদের প্রত্যেকের কর্মপরিধিও থাকে
ভিন্ন ভিন্ন।
সরকারে প্রস্তাবিত অর্থবছরে সম্ভাব্য মোট ব্যয়ের পরিমান
(রাজস্ব ও উন্নয়ন) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ও বিভাগের সাথে আলোচনা করে অর্থ
বিভাগ নির্ধারণ করে। অভ্যন্তরীন সম্পদ বিভাগ প্রস্তাবিত ব্যয়ের কতটুকু
অভ্যন্তরীন রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে যোগান দেয়া হবে তার প্রস্তাবনা উপস্থাপন
করে, অর্থনৈতিক সম্পদ বিভাগ বৈদেশিক অর্থায়নের সম্ভাব্যতা তুলে ধরে।
বাজেটের উন্নয়ন ব্যয়ের হিসাবটি পরিকল্পনা কমিশন/ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
কর্তৃক নির্ধারণ করা হয়।
সম্প্রতি ০২ জুন, ২০২৫ তারিখে ২০২৫-২৬ অর্থ
বছরের বাজেট প্রস্তাবনা ঘোষণা করা হয়েছে। এটি ছিল স্বাধীনতাত্তোর
বাংলাদেশের ৫৪ তম বাজেট এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বাজেট। বিভিন্ন
বিবেচনায় এবারের বাজেট ঘোষণাটি ছিল ব্যতিক্রমী। এবারে বাজেট প্রবৃদ্ধি
কেন্দ্রিক অবকাঠামো সম্প্রসারণ চিন্তা থেকে সরে মানুষ কেন্দ্রিক সার্বিক
উন্নয়ন ভাবনাকে সামনে রেখে ঠিক করা হয়েছে। এ বছরের বাজেটের অন্যতম একটি
উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্পদের সমবন্টন নিশ্চিত করার পাশাপাশি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ
গড়া। আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সমতা রক্ষা করা ও একটি বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট
প্রণয়ন ছিল এবারের বাজেটের লক্ষ্য। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল ফোকাস দেয়া হয়েছে
সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে মূল গতি ধারায় ফিরিয়ে আনা, মুল্যস্ফীতির লাগাম টেনে
ধরা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা আদায় করা,
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ বিষয়ক প্রস্তুতি গ্রহণ, মূলধন বাজার
পুনরুজ্জীবিত করা, বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাড়া দেয়া
ইত্যাদি। বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, সামাজিক
সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক সুরক্ষা, রাজস্ব প্রশাসন সংস্কার ও
আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে।
এবারের প্রস্তাবিত বাজটের আকার নির্ধারণ
করা হয়েছে ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা যা বাংলাদেশের জিডিপির আকারের শতকরা
১২.৭ ভাগ। এবারের বাজেটের আকার গত অর্থবছরের তুলনায় যৌক্তিকতার ভিত্তিতে
কম নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সে অর্থে এটি একটি সংকোচনমূলক বাজেট।
প্রস্তাবিত ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের বিপরীতে রাজস্ব আয়ের
লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৫ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে ঘাটতি
দাঁড়াবে ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.৬২ ভাগ। এ ঘাটতি পূরনের
লক্ষ্যে বৈদেশিক উৎস হতে ১ লক্ষ ১ হাজার কোটি অর্থায়ন সংগ্রহ করা হবে
(জিডিপির ১.৬ ভাগ) এবং অভ্যন্তরীন উৎস হতে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা
হয়েছে ১ লক্ষ ২৫ হাজার ৯ শত কোটি টাকা, যা জিডিপির ২.০ ভাগ। অভ্যন্তরীন
উৎসের বেশির ভাগ অর্থায়ন (১ লক্ষ ৪ হাজার কোটি টাকা) সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা
ঠিক করা হয়েছে ব্যাংক খাত হতে।
উল্লেখ্য যে প্রস্তাবিত বাজেটের
সিংহভাগ ব্যয় হবে পরিচলন ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় বাবদ যার পরিমাণ ৪
লক্ষ ৯৮ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, উন্নয়ন ব্যয় বাবদ ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬০৯ টাকা
ব্যয় হবে। বাকি ৪৫ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা অন্যান্য ব্যয় মেটাতে বরাদ্দ রাখা
হয়েছে। মোট রাজস্ব আয়ের ৫ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকার লক্ষমাত্রার সিংহভাগ ৪
লক্ষ ৯৯ হাজার কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উৎস হতে সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক
করা হয়েছে। বাকি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ব্যতিরেকে অন্যান্য উৎস এবং
অ-কর আয় বাবদ সূত্র হতে সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। বাজেটের ব্যয়
মূলতঃ ১) সামাজিক অবকাঠামো খাত, ২) ভৌত অবকাঠামো খাত ও ৩) সাধারণ সেবা খাত
-এ তিন খাতে ব্যয় হয়।
এবার বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.৫০ শতাংশ,
মূল্যস্ফিতি ৬.৫০ শতাংশ , রপ্তানি, আমদানি ও রেমিট্যান্স এর প্রবৃদ্ধি ঠিক
করা হয়েছে যথাক্রমে ১০.০, ৮.০ ও ৮.০ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋনের প্রবৃদ্ধির
টার্গেট ধরা হয়েছে ১১ শতাংশ। নমিনাল জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৬২ লক্ষ ৪৪
হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিদেশী মুদ্রা রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা
হয়েছে ৩৪.০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে
তুলতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিজ্ঞান-ভিত্তিক, প্রযুক্তি-চালিত এবং
কর্মসংস্থান-ভিত্তিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এই বছরের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতের জন্য ৩৫,৪০৩ কোটি টাকা,
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য মোট ৪৭,৫৬৩ কোটি টাকা, কারিগরি ও মাদ্রাসা
শিক্ষা বিভাগের জন্য ১২,৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয়
উন্নয়নে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও
পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪১,৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা
হয়েছে। এই সমস্ত প্রস্তাবিত বাজেট গত বছরের বরাদ্দের তুলনায় বেশি।
এ
বছরের বাজেটে দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং দরিদ্র, প্রান্তিক ও
ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সুবিধাভোগীর সংখ্যা
এবং মাথাপিছু বরাদ্দ বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাবদ ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দের
প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বছরের বাজেটে। বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির
ভাতার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি, সুবিধাভোগীর সংখ্যাও যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে
বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায়
সুবিধাভোগী হিসেবে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করার জন্য একটি ডায়নামিক সোশ্যাল
রেজিস্ট্রি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
২০২৫-২৫ অর্থবছরের বাজেটে
বিদ্যমান কর ব্যয় কাঠামোকে যৌক্তিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন থেকে
অবারিত সময়ের জন্য কর অব্যাহতি প্রদান নিরুৎসাহিত করা হবে। সরকার আগামী বছর
স্বাভাবিক ব্যক্তি শ্রেণির সকল করদাতার জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল
বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা ৩
লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বলবৎ থাকবে। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষের জন্য
স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার
টাকা করা হয়েছে। গেজেটভূক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এ আহত ' জুলাই
যোদ্ধা' করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা
নির্ধারন করা হয়েছে। কর প্রদান সংস্কৃতির বিকাশ, করজাল সম্প্রসারণ এবং কর
প্রদানে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নতুন করদাতাদের ন্যূনতম করের পরিমাণ ১০০০
টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কৃষি উৎপাদন উৎসাহিত করার জন্য, একজন ব্যক্তির
কৃষি থেকে অর্জিত আয়ের সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত করা হয়েছে ।
কিডনি, লিভার, ক্যান্সার এবং হৃদরোগের চিকিৎসা ছাড়াও, মস্তিষ্কের
অস্ত্রোপচার এবং কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য কর্মচারীদের প্রাপ্ত
চিকিৎসা ব্যয় করমুক্ত করা হয়েছে;। স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা এবং সন্তানদের
পাশাপাশি, ভাই এবং বোনদের করমুক্ত দানের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১
(এক) লক্ষ টাকার পরিবর্তে ৩ (তিন) লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ব্যালেন্সের
উপর আবগারি শুল্ক অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে; আগামী অর্থ বছরে দেশে উন্নত
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে, রেফারেল হাসপাতালের পাশাপাশি, ৫০ টিরও
বেশি শয্যা বিশিষ্ট সকল হাসপাতালে যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রপাতি আমদানির উপর
শুল্ক হ্রাস প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ই-বাইকের স্থানীয় উৎপাদনকে
উৎসাহিত করার জন্য একটি নতুন প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট
প্রণয়নের কাজটি যেমন কঠিন, তার সুষ্ঠু ও কার্যকর বাস্তবায়ন আরো বেশি কঠিন।
দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সকল নাগরিকের কার্যকর অংশগ্রহনের মাধ্যমেই
বাজেটের কাংখিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভবপর হবে। মনে রাখা দরকার বাজেটের সফল
বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমাদের এ প্রিয় দেশ তার কাংখিত উন্নয়ন অভিযাত্রায়
সফলভাবে এগিয়ে যাবে। আসুন প্রিয় মাতৃভূমির উন্নয়ন যাত্রায় সবাই শরীক হই।
লেখকঃ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।