শিক্ষাই
যেখানে দেশের উন্নয়নের প্রধান ভরসা, সেখানে শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দেওয়া না
হলে শিক্ষকরা অবহেলিত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষার উন্নতির সঙ্গে
রাষ্টের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং শিক্ষার সাথে
কর্মসংস্থানের ও সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এ
খাতে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, উন্নততর
গবেষণার প্রয়োজনে আলাদা অর্থ বরাদ্দ ও সময় উপযোগী শিক্ষার বাজেট প্রয়োজন।
শিক্ষা
ও গবেষণা খাত একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখনো
দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী যুগোপযোগী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। গ্রামীণ
অঞ্চলে বিদ্যালয় রয়েছে, কিন্তু নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক কিংবা আধুনিক শিক্ষা
উপকরণ। শহরাঞ্চলেও শিক্ষার মান আশানুরূপ নয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
শ্রেণিকক্ষের সমস্যা, শিক্ষকের পদ শূন্য, দক্ষ শিক্ষক সংকট। এছাড়া ও
যুগোপযোগী মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তকের সংকট রয়েছে ।
অর্থ এবং বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ২
জুন ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে প্রস্তাব করেন। শিক্ষা খাতে ৯৫ হাজার ৬৪৪
কোটি টাকা বরাদ্দের কথা উল্লেখ করা আছে। এটি মোট জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের
মতো। আগের বছর এর চেয়ে সামন্য কম ছিল। এবারের বাজেটের মধ্যে প্রাথমিক ও
গণশিক্ষা খাতে ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি, মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা খাতে ৪৭ হাজার ৫৬৩
কোটি ও কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্ধের
প্রস্তাব ছিল।
উচ্চতর শিক্ষা গবেষণায় আমরা কেন পিছিয়ে আছি, কেন শিক্ষিত
বেকার বাড়ছে, কেন মেধাবিরা শিক্ষকতা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, কেন মেধাবিরা দেশ
ছাড়ছে- এরকম অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যে গুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি।
এবারের
বাজেটে শিক্ষা ও গবেষণা ভিত্তিক উন্নয়নের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়
তৈরি হতে পারত যদি আলাদা গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ থাকতো।
এই বাজেটে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ শিক্ষায় এবং ২ শতাংশ গবেষণায় বরাদ্দ
রাখা যেত। যে বরাদ্দে দেওয়া হয়েছে তা ব্যবহার হতে হবে কৌশলগত, স্বচ্ছ ও
সুসংহত কাঠামোর মাধ্যমে। গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যালয় নির্মাণ, উপযুক্ত শিক্ষক
নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যবই উন্নয়নে নির্ধারিত বরাদ্দ থাকা আবশ্যক।
পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণাগার, আধুনিক যন্ত্রপাতি,
গবেষণা ফান্ড ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পরবর্তী
বাজেটে স্মার্ট শিক্ষা অবকাঠামোর জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং ভোকেশনাল
ট্রেনিং ও টেকনিক্যাল শিক্ষা সম্প্রসারণে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা
যেতে পারে, যা শিক্ষা ও গবেষণা খাতকে ঢেলে সাজাতে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও
ভবিষ্যৎমুখী সিদ্ধান্ত হতে পারে।
আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি, প্রযুক্তির
ব্যবহার এবং মনোবিজ্ঞানভিত্তিক ক্লাসরুম পরিচালনার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের
ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য
কেন্দ্রীয়ভাবে ফান্ড গঠন, গবেষণার ফলাফল সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে
অন্তর্ভুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশে সহায়তা প্রদানের
ব্যবস্থা করা উচিত দৃশ্যমান। গবেষণা একটি জাতির মেধাসম্পদ বিকাশের শ্রেষ্ঠ
উপায়। অথচ বাংলাদেশে গবেষণার জন্য বাজেটে যে সামান্য বরাদ্দ রাখা হয়, তা
উন্নত দেশগুলোর ধারে-কাছেও নেই।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট
বরাদ্দ ছিল জাতীয় বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ। গবেষণার জন্য ছিল মাত্র ৫০০ কোটি
টাকা যা গভীর হতাশাজনক। ইউনেসকোর মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত জিডিপির ৪-৬
শতাংশ শিক্ষায় এবং ১-২ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করা। সেই নিরিখে বাংলাদেশের
অবস্থা একেবারেই নৈরাশ্যজনক।
ইউনেস্কোর মতে, জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা
খাতে বরাদ্দ অন্তত ৬ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে
বাজেটে বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। প্রতি অর্থবছরে এই
বাজেট বরাদ্দ কমছেই। বাংলাদেশের বাজেটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে
বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে জিডিপির ১.৬৮ শতাংশ, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে
সর্বনিম্ন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ,
২০২২-২৩ অর্থবছরে ১.৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২.০৮১ শতাংশ। অথচ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটানের শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্দ জিডিপির
৬.৬ শতাংশ, আফগানিস্তানে ৪.১ এবং ভারত বরাদ্দ ২.৯ শতাংশ।
সূচকে আমাদের
চেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতেও শিক্ষকদের বেতন বেশি। বর্তমানেশিক্ষকদের বেতন
দ্বিগুণ করা হলেও একজন প্রভাষকের মূল বেতন হয়েছে ২২ হাজার টাকা। বর্তমানে
নেপালে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২৮ হাজার ১৯২ টাকা। উন্নত দেশগুলোতে
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা অনেক বেশি। আমাদের দেশের শিক্ষা খাত বরাবরই
উপেক্ষিত। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার বাস্তব প্রচেষ্টা ও জ্ঞানের মজুত
বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট গবেষণা নেই। একজন মেধাসম্পন্ন শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন
একজন প্রতিভাসম্পন্ন শিক্ষার্থী। তাই আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি
করে মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির পরিমান শিক্ষকতা পেশায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ
শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে বেসরকারি
মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান (এমপিওভুক্ত) প্রায় ১৮৯৬৮টি, সরকারি মাধ্যমিক
প্রতিষ্ঠান ৬৮৪ টি। বেসরকারি কলেজ (এমপিওভুক্ত) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩৩৪১টি,
সরকারি কলেজ ৬৩৭ টি। এই পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যায় সরকারি শিক্ষকদের চেয়ে
বেসরকারি শিক্ষকদের পরিমাণ অনেক বেশি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশি,
শিক্ষক বেশি, শিক্ষার্থী বেশি হলে ও সুযোগ সুবিধার সময় সীমীত। এভাবে
শিক্ষার পরিবারের বড় একটি অংশকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেশের শিক্ষার অগ্রগতি ধীর
হবে এটাই বাস্তবতা।
আর্থিক সুযোগ সুবিধার সমস্যায় শিক্ষকতা পেশা
দিন দিন অনেকের ক্ষেত্রে বিপদের পেশা হয়ে পড়ছে। অনেকে অন্য কোনো চাকরি পেলে
শিক্ষকতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এখনও এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাজার
হাজার শিক্ষকের পদ খালি। অনেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের
সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েও শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এর মূল
কারণ বেশিরভাগ শিক্ষকদের মানবতার জীবন যাপন করা। এত স্বল্প টাকা বেতন পেয়ে
কোনোভাবেই তাঁরা চলতে পারছেন না। আমরা এখন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে
যাচ্ছি। এই সময়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার উন্নয়ন সবার আগে জরুরি হয়ে পড়েছে।
সরকার বার বার নতুন নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে। সেখানে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ
অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ
নেওয়া হয়নি।
গত সরকার বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন করছেন
ঠিকই কিন্তু শিক্ষার গুনগত উন্নয়ন হচ্ছে তুলনামূলক কম। সরকারকে বিভিন্ন বড়
বড় প্রকল্পের মতো শিক্ষা খাতকেও বড় প্রকল্পের আওতায় আনা সময়ের চাহিদা।
বিশেষ করে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে বিজ্ঞানমনস্ক
জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষায় ও গবেষনায় আরো বাজেট বাড়ানোর
প্রয়োজন ছিল।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ,বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।